দিনমজুরের হাতেলেখা পত্রিকা আশা ছড়াচ্ছে পটুয়াখালীতে

ফিচার

13 May, 2022, 09:35 pm
Last modified: 24 January, 2023, 10:58 am
হাসান পারভেজ একাধারে একটি পত্রিকার সম্পাদক, লেখক, প্রকাশক এবং হকার। এসব ছাড়া তার আরেকটি পেশা আছে। তিনি একজন দিনমজুর। তার কিছু প্রতিবেদকও তার সঙ্গেই ইটভাটায় কাজ করেন।

হাসান পারভেজ একাধারে একটি পত্রিকার সম্পাদক, লেখক, প্রকাশক এবং হকার। এসব ছাড়া তার আরেকটি পেশা আছে। তিনি একজন দিনমজুর।

এর বাইরেও হাসানের অনেকগুলো পরিচয় আছে। এর মধ্যে কয়েকটির কথা বলতে তিনি রীতিমতো লজ্জা পান।

প্রথমেই যেটা আসে তা হলো হাসান পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় আন্ধারমানিক নামে হাতেলেখা একটি পত্রিকা বের করেন। মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা। আশেপাশের মানুষ ও ভিন্ন সব ব্যক্তিত্বই তার লেখায় গল্প হয়ে ধরা দেয়।

কাজের মধ্য দিয়ে হাসান অসংখ্য পাঠক পেয়েছেন। তার লেখাগুলো সত্যিকারের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।

একবার স্থানীয় এক মেয়ের কাহিনি তাকে এতটাই নাড়া দেয় যে তিনি মেয়েটিকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। জসীমউদ্দিনের আসমানী কবিতার অনুকরণে তিনি 'রুবিনাকে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও'- নামে একটি কবিতা লেখেন। সেখানে উঠে আসে মেয়েটির দুঃখ ও সংগ্রামের গল্প।

ভিটে-বাড়িহীন ছোট্ট রুবিনা তার বৃদ্ধ নানী ও মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের সঙ্গে থাকে। মাকে বেঁধে রাখে শিকলে।

পরিবারটিকে সাহায্য করা মতো কেউ ছিল না। গ্রামে ঘুরে ঘুরে রুবিনাকে তাই ভিক্ষা করতে হতো। যেদিন ভিক্ষা করতে বেরুতে হতো না, রুবিনা স্কুলে যেত।

আন্ধারমানিকের প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার কপি | ছবি: সংগৃহীত

হাসান নিজে দরিদ্র মানুষ হলেও রুবিনার কষ্ট তার মনে এক গভীর ক্ষত তৈরি করে। সেখান থেকেই তিনি রুবিনাকে নিয়ে লিখেন।

"রুবিনার এই কষ্ট দেখে খুব খারাপ লেগেছিল," বলেন হাসান। "আমি যখন ফেসবুকে কবিতাটি পোস্ট করি, তখন তা ভাইরাল হয়। কবিতাটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। পরবর্তীতে রুবিনা সরকারের কাছ থেকে এক খণ্ড জমি ও একটি বাড়ি পায়।"

রুবিনা ছাড়াও আন্ধারমানিক পত্রিকায় হাসান যাদের গল্প লিখেছেন, তাদের অনেকেই উপকৃত হয়েছে।

২০১৯ সালের পয়লা মে থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।

৩০০ কপি পত্রিকা ছাপান হাসান। এখন পর্যন্ত আন্ধারমানিকের ১১টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।

পত্রিকাটি অন্যসব পত্রিকার মতো নয়। এই পত্রিকায় মারামারি, হানাহানি, খুন ও ধর্ষণের খবর নেই। এর প্রায় সবই বিভিন্ন মানুষকে কেন্দ্র করে লেখা। বিশেষ করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে এমন লেখাই বেশি।

তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের সফলতার গল্প তুলে ধরেন যেগুলো অন্যদের অনুপ্রাণিত করেন। আবার কখনো প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তুলে ধরেন তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা।

"আশা দেখায় এমন সব গল্প লেখি আমরা। ধরা যাক চলতি বছর ভূট্টার উৎপাদন রমরমা হলে, আমরা সেটা নিয়ে লেখব। কেউ গরু কেনার পর দুধ বিক্রি করে সচ্ছলতা অর্জন করলে সেই গল্প লিখি। কিংবা বিধবা কোনো নারী মুরগি পেলে কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করে সেই গল্পও বলি আমরা," বলেন হাসান।

"প্রতি দুই মাস পরপর প্রকাশিত হয় আন্ধারমানিক। আমাকে দিনমজুরি করে সেই কাজের ফাঁকে পত্রিকার কাজ করতে হয় বলে নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না," বলেন তিনি।

জীবিকা নির্বাহ করতে হাসান কখনো ইটভাটায় কাজ করেন, আবার কখনও যান মাছ ধরতে। কিন্তু কোনোকিছুই তার পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছাশক্তিকে দমাতে পারেনি।

হাসানের যাত্রা

ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির ঝোঁক ছিল তার। কিন্তু দারিদ্র্যের বেড়াজালে আটকে পড়ায় লেখক হওয়ার বাসনাকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল।

"১৯৯৬ সালে এসএসসি পাস করার কথা ছিল আমার। কিন্তু টাকার অভাবে পরীক্ষায় বসতে পারিনি," বলেন হাসান।

প্রায় ২০ বছর পর ২০১৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বসেন তিনি। ২০১৭ সালে পাশ করেন এইচএসসি। বর্তমানে কলাপাড়া সরকারি কলেজে পড়শোনা করছেন তিনি।

শত দুর্দশার মাঝেও হাসানের কবিসত্ত্বা বেঁচে ছিল।

আন্ধারমানিকের কার্যালয় | ছবি: সংগৃহীত

"২০০৫ সালে বরিশালের গণ স্বাক্ষরতা কর্মসূচি থেকে 'স্বভাব কবি'র উপাধি পাই। আমার কাছে একটি সনদও আছে," বলেন হাসান।

নিজেকে উদ্দীপ্ত রাখতে হাসান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সংবাদ পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠান। "আমি অনেক জায়গায় লেখা পাঠিয়েছি। কিন্তু কখনো জবাব পাইনি।"

দীর্ঘ সময় কাটলেও হাসানের দৃঢ়তায় মরচে পড়েনি। শেষে একদিন ভাগ্যও সহায় হয়। ২০১৬ সালে হাসানের সঙ্গে একজন সাংবাদিকের সাক্ষাৎ হয়। তিনি তার লেখার প্রশংসা করে লেখালিখি চালিয়ে যেতে বলেন।

হাসান সেই সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখে এবং তাকে নিজের 'গুরু' মনে করে।

কয়েক বছর পর সেই সাংবাদিক গ্রাম ও আশেপাশের সংবাদ নিয়ে ইতিবাচক বার্তা দিতে পারে এমন একটি সংবাদপত্র প্রকাশের পরামর্শ দেন হাসানকে।

"আমার গুরু আমাকে বলেছিলেন তুমি লাভ করবে না কিন্তু গ্রামবাসী তোমার কথা জানবে, তাদের আশেপাশে কী হচ্ছে সেসব জানবে; এখান থেকেই ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হবে," বলেন হাসান।

"যতদিন বেঁচে থাকি কাজ চালিয়ে যাব বলে আমি তার কাছে প্রতিজ্ঞা করি- কোনো স্বীকৃতির জন্য না।"

এভাবেই তার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে নেমে পড়েন হাসান--একটি কাগজ ও কলম।

কালো জলে এক টুকরো রুবি

"আন্ধারমানিক আমাদের স্থানীয় এক নদী। এই নদীর বৈশিষ্ট্য হলো আপনি অন্ধকারে ঢিল ছুড়লে এক ধরনের আলো নিঃসৃত হবে। পানি লবণাক্ত হওয়ায় এটা হয়। যেসব রুবি অন্ধকারে জ্বলে তারা আন্ধারমানিক," বলেন হাসান। "উপকূলীয় অঞ্চলে থাকি বলেই পত্রিকার নাম এই নদীর নামে রাখা।"

এই পত্রিকা ছাপাতে খরচ পড়ে প্রায় ৭ টাকা।

"আমি ১০ টাকায় বিক্রি করি। কিছু কপি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। তাই সবমিলিয়ে আমার কোনো লাভ হয় না। প্রতি দুই মাস পর পর পত্রিকা প্রকাশ করি, আমার লোকসানই হয়," বলেন হাসান। গ্রামের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নিজেই পত্রিকা ফেরি করেন তিনি।

এই লোকসানের মধ্যেও কোন জিনিসটি তাকে কাজ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করে?

"আমার এলাকায় আলো হয়ে এসেছে এই কাগজ। অনেকের ঘরবাড়ি ছিল না। আমার পত্রিকায় তাদের খবর ছাপার পর তারা বাড়ি পেয়েছে। সম্প্রতি আমি ঘটনা লেখার পর তিনজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বাড়ি পান," বলেন তিনি।

হাসান নিজেই অস্বচ্ছল। কিন্তু তা সত্ত্বেও গরীব মানুষজন তার ছোট্ট ঘরের সামনে সাহায্যের আশায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনিও সবসময় তাদের পাশে দাঁড়ান।

মানুষের জন্য লড়াই, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় থাকার কারণে হাসান ও তার পরিবারের সদস্যরা জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগী।

"আমার দাদা পাকিস্তান আমলে সেনাসদস্য ছিলেন। নদী ভাঙনে সব হারানোর আগে আমরা বরিশালের হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ অঞ্চলে ছিলাম। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় যখন আসি, আমাদের কিছু ছিল না।"

গত বছর জনপ্রিয় বাংলাদেশি টেলিভিশন অনুষ্ঠান ইত্যাদি হাসান পারভেজ ও তার আন্ধারমানিক পত্রিকার গল্প তুলে ধরে।

উপকূলের সুখ-দুঃখের কথা উঠে আসে আন্ধারমানিকের পাতায় পাতায় | ছবি: সংগৃহীত

অনুষ্ঠানটিতে হাসানের এই নিঃস্বার্থ কার্যক্রম প্রশংসিত হয়। তাকে দুই লাখ টাকাও দেওয়া হয়।

"ইত্যাদিতে পাওয়া টাকা দিয়ে আমি এক টুকরো জমি কিনি। আমি এখনও অন্য মানুষের জমিতে থাকি। কিন্তু নিজের জায়গায় বাড়ি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি।"

১৫ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রতিবেদক হাসানের জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেন।

তার কিছু প্রতিবেদক তার সঙ্গেই ইটভাটায় কাজ করেন। কেউ বিধবা, আবার কারও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। তবে তারা সবাই লিখতে-পড়তে জানেন।

হাসানের পত্রিকা শুধু মানুষকে অনুপ্রাণিতই করে না। ভালো জিনিসকে উৎসাহিত করে।

"পাশের গ্রামে কেউ পোলট্রি ব্যবসা করে ভালো করছে, এধরনের খবর পড়ে গ্রামবাসীরা নিজেরাও ভাগ্য বদলাতে সেই কাজ করার পরিকল্পনা করে। মানুষ যেমন অনুপ্রাণিত হচ্ছে, তেমনি এক গ্রামের মানুষ আরেক গ্রামের সংবাদ পাচ্ছে।"

"সকালে উঠে আপনি পড়লেন পাশের গ্রামের খালেক হাওলাদার গত বছর দুটি ছাগল কিনে এখন আটটির মালিক। গরীব খালেক এখন মাসে ৮ হাজার টাকার দুধ বিক্রি করে। এই খবর পড়ে আপনার মুখে হাসি দেখা যাবে। খুশি হওয়ার পাশাপাশি অনুপ্রেরণাও পাবেন।"

আর হাসানের কাগজ শুরু থেকে যা করে আসছে তাই অনুপ্রেরণা।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.