হাসান মনসুর: জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা

ফিচার

12 May, 2022, 10:45 pm
Last modified: 18 May, 2022, 01:09 pm
বাংলাদেশে প্যাকেজ ট্যুর জনপ্রিয় করেন তিনি। গোটা একটা মুসাফিরের জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন হাসান মনসুর। পুরো পরিবার মিলেমিশে ভালোবেসে একটি পর্যটন ব্যবসা দাঁড় করানোর বিরল নজির স্থাপন করেছেন তিনি।

একচল্লিশ সপ্তাহ ছিলেন আমেরিকায়। দেশে ফিরলেন একাত্তরে। যুদ্ধ শুরু হলে পর চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে যার অতিথি হলেন তার শ্যালিকার মন কেড়ে নিলেন। শ্যালিকার নাম তপতী। জলপাইগুড়িতে শিক্ষক, বয়স ২৬, হাসান মনসুরেরও সমান বয়স। কলকাতার আলীপুরে তখন তপতী ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন। আর সেই সুযোগেই তপতী আর হাসান মনসুরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বসে বাদাম খাওয়া। তারপর দেশ স্বাধীন হলো। মনসুর ২১ ডিসেম্বর দেশে ফিরলেন, তপতীর জন্য একটি ট্রেনের টিকেট রেখে এলেন ২৪ ডিসেম্বরের। বলে এলেন, যদি আমায় বিশ্বাস করো, বাঁধতে চাও ঘর, তবে উঠে পড়ো ট্রেনে, চলে এসো স্টেশনে, আমি অপেক্ষায় থাকব। তখন তো আর এপার-ওপার করা কঠিন ছিল না। দিনাজপুর থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে গিয়েছিলেন হাসান, মন বেঁধে ট্রেনের কোণে বসেছিলেন তপতীও, তারপর হাতে রেখে হাত তারা স্বাধীন দেশে চলে এলেন। ঘর বাঁধলেন, সরকারের কৃষি বিভাগের চাকরি মনসুরের আগে থেকেই ছিল। 

ছিয়াত্তর সালে যাচ্ছিলেন দিনাজপুর। প্লেনে পাশের আসনে ছিলেন একজন বিদেশী ভদ্রলোক। কথায় কথায় জানা হলো মানুষটি বাংলাদেশে সিডার প্রোগাম ম্যানেজার। আসলে ছিলেন হিপ্পি (ষাটের দশকের একটি প্রথাবিরোধী জীবনাচার)। বাড়ি সুইডেনে। স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে, খুব দুঃখে আছেন। হাসান মনসুরের মায়া লাগল মানুষটাকে দেখে। নাম জানলেন ক্রিশ্চিয়ান জুডভিগ। আরো জানলেন, জুডভিগের একটা পার্টটাইম বিজনেস আছে। সেটা হলো মানুষদের দেশ দেখানো। সুইডেনের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্রিশ লিফলেট দেয়, জানায় এশিয়ার দেশগুলো সম্পর্কে। যে লোকগুলো বেড়ানোর জন্য নাম লেখায় তাদের নিয়ে কর্মশালা করে, মানচিত্র দেখায়, দেশগুলোর সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা জানায়। বিশেষ করে ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বেড়াতে নিয়ে আসে ক্রিশ সুইডিশদের। 

মনসুরের মন আগে থেকেই কাজে বসছিল না। দুম করে চাকরি ছেড়েই দিলেন। তারপর গেলেন নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসা করতে। সেইসঙ্গে বছরে দু-তিনবার জুডভিগের হয়ে নেপালে নয়তো মালয়েশিয়ায় ট্যুরের আয়োজন করেন। ১৯৭৭ সালে ভারত আর নেপাল যখন গেলেন তখন ক্রিশও ছিল সঙ্গে। ৪৫ জন ট্যুরিস্ট ছিল দলে। তখন সীমান্তের কাঁটাতারে ধার বেশি ছিল না, তবে পরিবহন ব্যবস্থা ছিল নাজুক, আবাসিক ও খাওয়ার হোটেল পেতে কষ্টই হতো। এভাবে চলল বছর দুই। মনসুর বুঝলেন পাটের ব্যবসা তার জন্য নয়। এর মধ্যে আবার ক্রিশের চাকরির চুক্তি ফুরাল। ক্রিশ ফিরল দেশে। গিয়ে বলল, মনসুর, ভাবছি পেশা বদলাব। ট্যুরিজমকেই জীবিকার উপায় করব। তুমি আমার হয়ে এশিয়ার অংশটা দেখতে পারবে? 

মনসুর বললেন, নিশ্চয়ই পারব। 

মনসুরের মনে একটা কাঁটা অবশ্য খচখচ করছিল। এ কাঁটা তিনি বয়ে বেড়াচ্ছিলেন সেই নেপাল যাওয়ার পর থেকে। সেখানে দরবার স্কয়ারে বসে জিরাচ্ছিলেন একদিন। পাশ থেকে হঠাৎ একজন বলে উঠেছিল, বিদেশীগুলা আমার দেশটার কাপড় খুলে নিচ্ছে, এ ডাহা বেইজ্জতি। 

ছবি: সংগৃহীত

ক্রিশের সঙ্গে পরে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সময়ের তুলনায় বেশ অগ্রসর। ক্রিশ চিতোয়ানের (নেপালের একটি ন্যাশনাল পার্ক) আদিবাসীদের পাড়ায় গিয়ে তাদের সংস্কৃতি দেখে আসার পক্ষে ছিল, ট্যুরিস্ট স্পটে ডেকে এনে তাদেরকে নাচানোর ঘোরতর বিপক্ষে ছিল। ক্রিশ ট্যুরিস্টদের কোনো একটা জায়গায় ঘোরাতে এনে ইতিহাস আর দর্শনীয় বিষয়গুলো জানিয়ে দিত, তারপর বলত, এবার নিজের মতো করে ঘুরে নাও। ঢিলেমি বা আলসেমি বা বাবুগিরির কোনোটাকেই পাত্তা দিত না ক্রিশ বেড়াতে নিয়ে এসে। মনসুর তাই বলছিলেন, 'ক্রিশ পুরো ব্যাপারটাকেই দেখত উল্টোদিক থেকে। কমিউনিটি ট্যুরিজমের ধারণা সেকালে ছিলই না বলতে গেলে। অথচ ক্রিশের কাছে সবটাই ছিল পরিষ্কার। কোথায় কোনটা ফেলতে হয়, কোনটা হয় না, স্থানীয় লোকেদের সম্মান করা, টাকা দিয়েই সব কেনা যায় না, পরিবেশকে কোনোভাবেই বিরক্ত না করা ইত্যাদি ভাবনাগুলো খুব পরিষ্কার ছিল ক্রিশের। আর তাতেই আমার মনে কাঁটা দূর হয়েছিল।'

তাই ক্রিশ যখন বলল, পারবে আমার হয়ে এশিয়ার অংশটা দেখতে? মনসুর রাজি হয়ে গিয়েছিলেন সহজে।   

তারপর তো আজ নেপাল তো কাল ভুটান। এভাবে চলতে চলতে এবং আরো চলতে চলতে আধা যুগ পার হলো। মনসুর ভাবলেন এবার নিজের একটা ব্যবসা নয় কেন? কারণও অনেকগুলো—তিনি সংসারের বড় ছেলে, পরে আছে আরো ১০ ভাইবোন। তাছাড়া পুত্র সৌরভ আর রুবাইয়েরও ততদিনে দেশ বিদেশের ন্যাশনাল পার্কগুলো ঘোরা হয়ে গেছে। ওদেরও গতানুগতিক জীবনে মন নেই বেশি। জিএমএমই করিম নামে পর্যটনের একজন বড় কর্তা ছিলেন, তিনি বললেন, আপনি দেশের জন্য কিছু করছেন না কেন? দেশটাকে বিদেশীদের কাছে তুলে ধরুন।

মনসুর ভাবলেন, এ তো হক কথা। হিল্লী-দিল্লী দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন একে-ওকে-তাকে, অথচ নিজের দেশটা দেখানোই হলো না , নিজেও দেখলেন না মনভরে। তিনি অনেক ভাবনা-চিন্তা করে ১৯৮৯ সালে নিউ ইস্কাটনে একটি অফিস নিয়ে ফেললেন। ভাড়া ৮ হাজার টাকা। 

অফিস তো করলেন, কিন্তু চালাবেন কী দিয়ে? তখন ট্যুরিজম বলতে কেবল পর্যটন করপোরেশনকেই বোঝাত। দেশের কোনো ব্র্যান্ডিং ছিল না। দূতাবাসগুলোয় গিয়ে কেউ কোনো তথ্য পেত না। কক্সবাজার বলতে হোটেল শৈবালকে বোঝাত, যার ঘর ছিল ১৮টি। একদল বুকিং নিয়ে ফেললে অন্য দলকে অপেক্ষা করতে হতো। 

ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনে তখনো ট্যুরিজম চালুই হয়নি। রাঙামাটির কিছু নাম ছিল, তবে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত বেশি ছিল না। তাহলে কেমন করে চলবে বা চালাবেন? হাসান মনসুর প্রথমে বিদেশ থেকে ব্রোশিওর আনালেন। আগে তো জানাতে হবে দেশটায় কী কী আছে। বিদেশের ব্রোশিওর দেখে নিজের দেশের উপযোগী ব্রোশিওর বানিয়ে নিলেন। তাতে সুন্দরবনের, পার্বত্য চট্টগ্রামের বা উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্য স্থাপনাগুলোর পরিচয় তুলে ধরলেন। 

হাসান মনসুর বুঝেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আর সুন্দরবনই হবে তার তুরুপের তাস। উত্তরবঙ্গে হেরিটেজ ট্যুরের কথাও থাকল মাথায়। আর ঢাকার ধারে শীতলক্ষ্যায় একটা নৌকা নামালেন, নাম রাখলেন রূপসী। লোহার বডির নৌকাটি দোতলা। নদীতে ভেসে ভেসে একটি ডে ট্যুরের জন্য রুপসী নাম করে ফেলল। শুধু বিদেশী ট্যুরিস্টরা নয়, রুপসীতে চড়তে ভালোবাসত দেশী পর্যটকরাও। অনেকে কাজের সূত্রে সারাদিনের জন্য রুপসীতে চড়ে বসতেন, যেমন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আকাশ, পাখি, গাছ আর পানির ছবি তুলতে ভালোবাসতেন রূপসীতে চড়ে।

হাসানের প্রথম টার্গেট ছিল জাপানীরা। তখন মোবাইল ফোন দূরের কথা, ফ্যাক্সও ছিল না। টেলেক্স ব্যবহার করে জাপানী একটি কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকলেন মনসুর। তাদেরকে ট্যুর প্রাইস জানালে তারা বললেন, এক্সপেনসিভ। ভারতে ভ্রমণ খরচ আরো কম। মনসুর তাদের কি যেয়ে যেয়ে বোঝাবেন যে এখানে সবকিছুই তৈরি করে নিতে হচ্ছে, কোনোকিছুই আগে থেকে ছিল না। তাই দাম একটু বেশি পড়ছে। শেষে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদের রাজি করাতে পেরেছিলেন মনসুর। ইস্কাটনের অফিসে যে একটা ব্ল্যাকবোর্ড ছিল মনসুরদের, সেখানে প্রতিদিনকার পর্যটক তালিকা লেখা হতো। এক-দুজন পেলেও খুশি হয়ে যেতেন মনসুর। 

ছবি: সংগৃহীত

একটা ট্যুরিজম কোম্পানি শুরু করতে কী কী লাগে? প্রশ্নটা হাসান মনসুরকেই করার সুযোগ মিলল। 

হাসান মনসুর: একটা মানচিত্র নিন প্রথমে। গোলাকার সব চিহ্ন দিন যে যে জায়গায় পর্যটক যেতে চাইবে। তারপর ভাবুন জায়গাগুলোয় যাওয়ার উপায় কী। যদি স্থলপথে যাওয়া যায় তবে ভাবুন বাহন কেমন হবে? টুরিস্ট কোচ না রুট বাস বা ট্রেন। ট্রেন হলে এসি কোচ না শোভন চেয়ার? আমরা তো কাঠবডি বাসেও সুইডিশদের সীমান্ত অবধি নিয়ে গেছি। এরপর আসুন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে। রাস্তায় বাস থামিয়ে হোটেলে খাওয়ালে কোন ধরণের হোটেলে খাওয়াবেন? এরপর আসুন নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। আর নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ তাই জলপথের ভ্রমণের ব্যাপারটিও ভালো করে খতিয়ে দেখুন। বিশেষ করে বিদেশীরা জলপথে ভ্রমণ পছন্দ করে। তবে তারা সাঁতার জানবে না, তা আপনাকে ধরে নিতে হবে। তাই খেয়াল রাখতে হবে, যে বাহনে তারা চড়বে সেটি তাদের জলের সৌন্দর্য দেখাবে কিন্তু জলের ভয় দেখাবে না মোটে। এরপর ভাবতে হবে তাদের যেন মশা, মাছি, পোকায় না কামড়ায়। তারা যতক্ষণ আপনার সঙ্গে থাকে যেন আনন্দে থাকে, মানে কিছু না কিছু অ্যাক্টিভিটিতে থাকে। 

প্রশ্ন: কিন্তু সুন্দরবনে তো অ্যাক্টিভিটির সুযোগ কম? তাহলে সেখানে তিনরাত চারদিনের মতো দীর্ঘ প্যাকেজ কতটা কার্যকর হয়?

হাসান মনসুর: দারুণ কার্যকর এবং উপভোগ্য। এর পেছনে কিন্তু আমাদের বেশি ভূমিকা নেই। প্রায় সবটা কৃতিত্বই বনটাকে দেওয়া চলে। পর্যটককে আপন করে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা বনটার আছে। বনটা যে নীরবতা চায়, পরিচচ্ছন্নতার দাবি জানায়, তা পর্যটককে বলে দিতে হয় না। যদিও আমরা লঞ্চ ছাড়ার আগে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার একটি ব্রিফিং দিই তবে যতই বনের গভীরে যেতে থাকে ততই মানুষ সংযত ও সংহত হতে থাকে। 

প্রশ্ন: আপনারা প্রথম লঞ্চ বানাতে গেলেন কবে?
হাসান মনসুর: ১৯৮৫ সালে। ক্রিশ এসেছিল ঢাকায়। সে একটা বোট বানাতে চাইছিল। বিআইডব্লিউটিসির তৌফিক নামের এক নেভাল আর্কিটেক্টের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। তাকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি লঞ্চ ডিজাইন করার অনুরোধ জানালাম। তিনি ডিজাইন শেষও করলেন, আর বললেন, লঞ্চ আপনারা বানাবেন কোথায়? এখানে তো কোনো ডক নাই আর লঞ্চ বানানোয় অভিজ্ঞ লোকও নেই। লোকটা আমাদের ক্ষতি করে দিল। তখন মারুফা নামের একটা লঞ্চ ভাড়া করে আমরা কাজ চালাচ্ছিলাম। কিন্তু নিজেদের একটা লঞ্চ না হলে কাজ চালানো কঠিন হচ্ছিল। তাই মাওয়া, নারায়ণগঞ্জ ছোটাছুটি করছিলাম। শেষে মারুফার মালিককেই বললাম লঞ্চটা আমাদের কাছে বিক্রি করে দিতে। তিনি রাজিও হয়েছিলেন, কিন্তু পরের দিন এসে বললেন, মা লঞ্চটা বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। তারপর আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম। দিনার নামের একটি লঞ্চ পেয়েও গেলাম। কিনতে যাওয়ার ঠিক আগে আগে বিআইডব্লিউটিএর সচিব ছিলেন ফসিউর রহমান, তাকে বলেকয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার সঙ্গে নিলাম। তারেক নামের প্রকৌশলী সে ভদ্রলোক দারুণ একটি উপকার করেছিলেন। তিনি লঞ্চটি ভালো করে দেখলেন আর বললেন আপনারা একটি লঞ্চ বানান না কেন? আমি তো অবাক, আমাদের এখানে নাকি বানানোর সুযোগই নেই, তাহলে কিভাবে বানাব? অবশেষে তারেক আমাদের সব পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে আমরা একটি জাহাজ বানিয়ে ফেলেছিলাম। নাম রেখেছিলাম, ছুটি। ২০ জন মানুষ এতে চড়তে পারে। সদরঘাটের ওপারে কালীগঞ্জে এটি বানানো হয়েছিল, খরচ পড়েছিল ৩৫ লাখ টাকা। 

প্রশ্ন: সুন্দরবনকে জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব কি আপনাদের দেওয়া যায়?

হাসান মনসুর: আমরা সুন্দরবনকে জনপ্রিয় করতে চাইনি, বরং পরিচিত করতে চেয়েছি। পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। ইউনেস্কো একে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা জানতাম সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক ঢাল। বেঙ্গল টাইগারের বাসস্থল এই সুন্দরবন। এর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া জলাশয়গুলো কাইম মাগুর, গ্যানজেটিক ডলফিনের মতো অনন্য সব প্রাণীর বাসস্থল। মাস্কড ফিনফুটের মতো পাখি কেবল এই বনেই মেলে। বনটি আগলে রাখে দারুণ সব লোককাহিনী। তাই বিদেশীদের কাছে বনটি গুরুত্ব পাবে জানতাম। দেশী মানুষদের কাছেও এর গুরুত্ব তুলে ধরা প্রয়োজন। এটি দেখতে যাওয়া যেমন আনন্দের, এর সংরক্ষণও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই বনটিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিলাম। অধিক লোক যেন বনটি দেখার সুযোগ পায় মানে ভ্রমণ ইকনমিক করতে আমরা অবসরের মতো লঞ্চ বানাই ছুটির পরে। ৫০ জনের থাকার ব্যবস্থা করা গেছে লঞ্চটিতে। 

প্রশ্ন: গাইড ট্যুরের প্রথম টিপের কথা মনে আছে আপনার?

হাসান মনসুর: সেটা ছিল কক্সবাজারে একটা স্পেশাল ট্রিপ। আমার ছোট ভাই হাসান মাহমুদ খোকন ছিল গাইড। ট্যুরিস্ট ছিল চারজন, আমেরিকান দূতাবাসের সম্ভবত। সমুদ্রে মাছ ধরা ছিল তাদের লক্ষ্য। সেটা ছিল রোজার মাস। খোকন একটা ট্রলার ভাড়া করেছিল। ট্রলারে ট্যুরিস্টদের উঠিয়ে খোকন পড়েছিল ঘুমিয়ে। লোকগুলো ফিরে এসে বলল, কাকে পাঠালা, সে তো খালি ঘুমায়। দুই দিন পর তারা ফিরে এসেছিল, মাছটাছ কিছুই পায়নি। আসলে সমুদ্রে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে তো অভিজ্ঞতা দরকার হয়, জায়গা চিনতে হয়, সে অভিজ্ঞতা তখনো আমাদের ছিল না। 

প্রশ্ন: রাঙামাটির অভিজ্ঞতা কেমন?

হাসান মনসুর:  সেসব দিনে রাঙামাটিতে অনেক রেস্ট্রিকশন ছিল। জাপানি ট্যুরিস্ট দিয়ে আমরা শুরু করলাম। রুটটা এমন ছিল—জাপানিরা ঢাকায় পৌঁছে দুদিন থাকত, তারপর কক্সবাজার, তারপর যাওয়া হতো রাঙামাটি। সুইডিশ গ্রুপ নিয়েও সুন্দরবন যেতাম। সুন্দরবনে ট্যুরিস্ট বাড়তে শুরু করে আসলে ৯২-৯৩ সালে। ১৮ বছর তো ভাড়া লঞ্চে করেই সুন্দরবন গেছি। কত রকমের সমস্যা, ছুটি হওয়ার পর একটু শান্তি পেয়েছি।

হাসান মনসুর নিজেও স্বীকার করেন, অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুতই সাফল্য পেয়েছেন তিনি। ২০০০ বা ২০০২ সালকে তিনি ক্যারিয়ারের পিক টাইম ধরতে চান। তবে বান্দরবানে রিসোর্ট বানানো শুরু করেন তারও পরে। কিন্তু ততদিনে তার অফিসে ২২টি প্যাকেজ ট্যুরের তালিকা ঝোলানো দেখতে পেল লোকে। কোনোটা হেরিটেজ ট্যুর, কোনোটা জঙ্গল ট্যুর, কোনোটাবা টি ট্যুর, কোনোটা আবার কালচার ট্যুর। ঢাকার লোক ট্যুরিস্ট কোচ লেখা গাড়ি দেখেছে প্রথম হাসান মনসুর মানে গাইড ট্যুরের বদৌলতেই। প্যাকেজ ট্যুরের ধারণাটিও তিনিই বাংলাদেশে জোগান দেন। অতল জলের দেশ সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে ডলফিন আর তিমি দেখার প্যাকেজও আছে গাইড টুরের। হাসান মনসুর যেমন বলছিলেন, 'আমরা যেমনটা দেখাতে চাইতাম মানুষ তাতেই ভালো বোধ করত। দেশের ও বিদেশের সব রকমের পর্যটকই আমাদের সঙ্গে বেড়াতে পছন্দ করত। অনেকেই আছেন যারা আমাদের সঙ্গে বারবার বেড়াতে পছন্দ করেন। সরকারের তরফের, যেমন বনবিভাগের লোকেদেরও আস্থাভাজন হয়েছিলাম আমরা। আমাদের স্লোগানটি দেখুন—উইথ আস, ইউ আর নেভার আ স্ট্রেঞ্জার। আসলে মানুষ অচেনাকে ভয় পায়। কিন্তু পরিচিত হয়ে গেলে সবকিছুই তার আপন মনে হয়। আমরা চাইতাম সব পর্যটকই আমাদের আপন ভাবুক। সেইমতো সব চেষ্টাই আমরা করতাম। স্লোগানটি তৈরি করেছে আমার ছোটছেলে রুবাইয়াত। '

ছবি: সংগৃহীত

একটা পরিসংখ্যান থেকেও গাইড ট্যুরসের অগ্রগতির নমুনা মিলবে। ১৯৯২ -৯৩ সালে গাইড ট্যুর মোট পর্যটক পেয়েছে ১৩১৯ জন। এর মধ্যে বিদেশী ১১৯৩ আর দেশী ১২৬ জন। ওদিকে ১৯৯৬-৯৭ সালে মোট পর্যটক পেয়েছে ৩৬৫০ জন। এর মধ্যে বিদেশী ৩৩৩২ জন আর দেশী ৯১৮ জন। বিদেশীদের মধ্যে জাপানী পর্যটক ছিল ৫৭৮ যাদের মধ্যে আবার নৌ ভ্রমণকারী ১৮৫ জন, শহর দেখা পর্যটক ১২৬ জন, প্যাকেজ ট্যুরে গেছে ২১৭ জন আর সুন্দরবন দেখেছিল ৪৭ জন। জাপানের পরই বেশি পর্যটক এসেছিল ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, আমেরিকা, ডেনমার্ক, সুইডেন থেকে যথাক্রমে ৫৬৩, ৪১৯, ২৩৩, ১৬৭ ও ১০৭ জন ।  

হাসান মনসুর পরে অফিস নিয়ে যান বনানী, তারপর গুলশান ২ নম্বর চক্করে। এর মধ্যে তার ছোট ছেলে রুবাইয়াত সুন্দরবনেই আস্তানা নিয়ে ফেলেছে। বনের নিয়মিত আলোকচিত্রী হয়ে উঠেছিল। প্রচলিত ধারার লেখাপড়ায় সে মন দিতে পারল না। মসুর ও তপতী ব্যাপারটিকে সহজভাবেই নিলেন। বড় ছেলে সৌরভ আর ছোট ছেলে রুবাইয়াতকে নিয়ে মনসুর দম্পতি প্রথম সুন্দরবন গিয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে। তারপর ভারতের কানহা ন্যাশনাল পার্ক, মালয়েশিয়ার তামাংনেগরাসহ আরো সব বন দেখিয়েছেন। তাই প্রকৃতির সঙ্গে তাদের বন্ধুতা গড়ে উঠেছিল শৈশবেই। রুবাইয়াত মৌয়ালদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়িয়েছে, মৌমাছির কামড় খেয়ে জ্বর বাধিয়েছে, কিন্তু বনের মায়া কাটাতে পারেনি। বাঘের ছবি তুলতে গিয়ে তাকে কম ঝামেলায় পড়তে হয়নি। একবার সাঁতরানো বাঘের পুরো এক রিল ছবি পানিতে ডুবে যাওয়ায় অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। আরেকবার কুয়াশার মধ্যে ছবি তোলেন, কিন্তু আলো কম থাকায় স্পষ্ট হয়নি।

বান্দরবানে হাসান মনসুর জায়গা কেনেন ২০০০ সালে। এর আগে ট্যুরিস্টদের নিয়ে রাঙামাটি গিয়ে পর্যটন কর্পোরেশনের বাংলোয় থাকতেন। হাসান মনসুরের আগে বান্দরবানে কেউ রিসোর্ট করেনি। নব্বই সাল থেকেই তিনি জায়গা খুঁজছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি রিসোর্ট করার জন্য। চাকমা রাজা দেবাশীষের কাছেও গিয়েছিলেন। দেবাশীষ তার মামার একটি জমি লিজ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কাগজপত্র চূড়ান্ত করার আগের দিনই সব ভেস্তে গেল। তারপর কথা বলেন বান্দরবানে উ চ প্রুর সঙ্গে (বর্তমান বোমাং রাজা)। তার স্ত্রীর ছিল জায়গাটি। কিন্তু সেখানে পানির ব্যবস্থা ছিল না। এবার হাসান মনসুর আমাদের কাছে জানতে চান, 'পার্বত্য অঞ্চলের কোনো জায়গায় রিসোর্ট বানাতে কি কি জিনিস থাকা লাগে মনে করো?'

আমরা উত্তর দিতে দেরি করছি দেখে নিজেই বললেন, 'তিনটি জিনিস লাগে—ওয়াটার, পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাকসেস।'

যাহোক এক সময় হাসান মনসুর উপযুক্ত জায়গা পেয়ে গেলেন। তৈরি করলেন হিলসাইড রিসোর্ট। বান্দরবান সদর থেকে চিম্বুক যাওয়ার পথে ৪ কিলোমিটার দূরে এ রিসোর্ট। উঁচু পাহাড়ের ওপর বেশ কয়েকটি কটেজ এর–টুনটুনি, মুনিয়া, বম কটেজ, মারমা কটেজ ইত্যাদি। হাসান মনসুর ২০১০ সালে ঠিক করলেন ঢাকার পাট চোকাবেন। তারপর গোছাতে আরো দুই বছর লাগল। ঢাকার এক স্থপতির সঙ্গে আলাপসালাপ করে নিজেদের থাকার জন্য একটি বাড়িও বানালেন রিসোর্টসংলগ্ন এক জায়গায়। তিনতলা বাড়িটি স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতাল নামে ভাগ করা। ঢাকার অফিস বড় ছেলের হেফাজতে দিয়ে গেলেন। ছোট ছেলে রুবাইয়াত খুলনাতেই থিতু হয়েছে। 

বান্দরবান গিয়ে মনসুর দম্পতি পাখি-প্রজাপতির সঙ্গে দিন কাটাতে লাগলেন। মহামারি আঘাত হানলে পরে বড় ছেলে, ছেলের বৌ আর নাতনীদেরও নিয়ে গেলেন নিজের কাছে। নাতনীদের ভর্তিও করিয়ে দিয়েছেন বান্দরবানের পাবলিক ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে। পুরো মুসাফিরের জীবনই কাটালেন হাসান । জিন্দেগি বুঝি এক সফর ভিন্ন আর কিছু নয় তার কাছে । এখন তার বেশিরভাগ সময় কাটে পুরোনো দিনের গান শুনে, ক্রিকেট খেলা দেখে আর নাতনীদের সঙ্গে আনন্দ করে। পুরো পরিবার মিলেমিশে ভালোবেসে একটি ব্যবসা দাঁড় করানোর নজির দেশে খুব বেশি নেই। গাইড ট্যুরস এখানেও দারুণ সফল। তপতী মনসুরের কাছে জানতে চাইলাম, 'গাইড ট্যুরসে আপনার কন্ট্রিবিউশন কী?'

তপতী মনসুর: মেন্যু তৈরি করা, হাউস কিপিং ইত্যাদি আমার পরিকল্পনাতেই হয়েছে। 

হাসান মনসুরের কাছে জানতে চাইলাম, এই এত মানুষের সঙ্গে মিশলেন, এতে কিছু করলেন, দিনশেষে কী পেলেন?

হাসান মনসুর: অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। বলতে পারো একটা পুরো জীবন ভালোবাসায় কেটে গেল।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.