প্রত্যন্ত এক গ্রামে মিমের পুর্তলিকা ফুলের আশ্চর্য গল্প
ফিচার
ছোট ছোট বাহারী রঙের লাল, হলুদ, গোলাপী পুর্তলিকা, যে ফুল নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মিমের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি জীবনেও রঙ এনে দিয়েছে। বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলার লাউহাটি উপজেলায় নিজ বাড়ির পাশেই উদ্যোক্তা মিম আক্তারের পুর্তলিকা ফুলের বিশাল বাগান রয়েছে। সফল এই উদ্যোক্তার বর্তমান মাসিক আয় প্রায় অর্ধ-লক্ষ টাকা। পুর্তলিকা ফুলের সাথে অনেকের পরিচয় থাকলেও এই নামের সাথে পরিচয় খুব কম মানুষের। অঞ্চলভেদে এই ফুলের নানা নাম রয়েছে। পুর্তলিকা গাছের পাতা দেখতে অনেকটা ঘাসের মতো হওয়ায় অনেক অঞ্চলে এটাকে ঘাসফুল নামেও ডাকা হয়। পুর্তলিকা হচ্ছে কয়েক প্রজাতির ছোট ছোট বাহারি রঙের এক জাতের ফুল। কম-বেশি প্রতিটি বাড়ির ছাদে, বারান্দায় ও বাড়ির সদর দরজার আঙ্গিনায় সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এই ফুলের গাছ লাগাতে দেখা যায়।
শখ থেকে সফলতা
উদ্যোক্তা মিম আক্তার টাঙ্গাইলের কুমুদিনী সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছেন। কলেজ পড়ুয়াকালীন যাওয়া-আসার ভাড়া বাবদ বাড়ি থেকে যে টাকা তিনি পেতেন তা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন। বরাবরই তার গাছের প্রতি ভালোবাসা ছিল তীব্র, কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়ে জন্ম নেওয়ায় সংসারের নানা টানাপোড়ন যেন রোজকার জীবনে বেঁধে থাকতো। তাইতো শখের বশে টাকা দিয়ে গাছ কেনাকে বিলাসিতা আর অর্থের অপচয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতেন না তার মা।
তারপরও নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে পারেননি মিম। জমানো টাকা থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ১৫০ টাকা দিয়ে পছন্দের পুর্তলিকার চারা কিনেন। অন্যদের দেখতেন বাড়ির ছাদে বিভিন্ন ফুলের চারা রোপণ করে ছাদ-বাগান করতে। কিন্তু তার সেই সুবিধে না থাকায় বাড়ির পাশে খালি জমিতে কিনে আনা ফুলের চারা লাগিয়ে দিলেন। তার কিছুদিন পরেই আবার তিনি ১২০ টাকার নতুন কিছু পুর্তলিকার চারা কিনলেন। তারপর দিন যতো যাচ্ছিল তার বাগানে একটি থেকে আরেকটি করে গাছের জন্ম হতে হতে বাগান ফুলে ভরে উঠতে শুরু করে। কিন্তু তখনো তিনি বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করা ও তা বিক্রি করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। বুঝতে পারছিলেন না একা হাতে কীভাবে সবটা সামলে উঠবেন এবং প্রথমদিকে এই ব্যাপারে পরিবারের সহায়তাও ছিলো না খুব একটা।
এসব নিয়ে ভাবতে থাকা মিম যখন কোথাও খেই পাচ্ছিলেন না, তখন তার হাতটি শক্ত করে ধরেন তার হবু স্বামী। পরিবার থেকেই তাদের বিয়ে ঠিক করে রাখা হয়েছিল। মিম ভাবতেও পারেননি যে সহযোগীতা ও সমর্থন সে তার পরিবার থেকে পাননি, তা এই মানুষটির কাছ থেকে পাবেন। হবু স্বামীর অভয়ে মিম পুরোদমে উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপের সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু বেশ কিছু গ্রুপে যুক্ত হতে পারলেও গাছ বিক্রির জন্য পোস্ট দেওয়া নিয়ে তাকে বেশ কিছু ঝামেলায় পড়তে হয়েছিলো।
তিনি গাছ বিক্রির জন্য পোস্ট করলেও দেখা যেত গ্রুপের অ্যাডমিন সেটা এপ্রুভ করছিলো না। এভাবে তার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে বসেছিলো। সেখানেও তাকে মানসিকভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে আসলো তার হবু স্বামী, যিনি সবসময় তার পাশে বন্ধুর মতো ছিলেন। তার আশ্বাস পেয়ে মিম আক্তার নিজেই 'পুর্তলিকা সমাহার' নামের একটি অনলাইন গ্রুপ খুললেন। প্রথমদিকে তাকে এই গ্রুপটি দাঁড় করাতে পূর্ব পরিচিত দুজন সহায়তা করেন। তারপর ধীরে ধীরে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং মিম আক্তারের চারা বিক্রির জন্য অর্ডার আসতে শুরু করে। বর্তমানে তার 'পুর্তলিকা সমাহার' গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১ লক্ষ ৩৭ হাজার।
বাড়ির পাশের ২০ শতাংশ জমি নিয়ে মিম আক্তারের পুর্তলিকার বাগান। ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ১ মাসে তার ৮ হাজার টাকার ফুলের চারা বিক্রি হয়। তারপর করোনাকালীন সবাই ঘরবন্দি জীবনে গাছ লাগানো ও গাছের পরিচর্যা নিয়ে সময় কাটাতে শুরু করলে ব্যবসায়ী মিম আক্তারের জন্য সময়টা ছিল আশীর্বাদস্বরুপ। ২০২১ সালে মাত্র পাঁচ মাসে মিম আক্তারের ১ লক্ষ টাকার পুর্তলিকার চারা বিক্রি হয়। কিন্তু এই সুখ বেশিদিন টিকতে পারেনি, তারপরই বন্যার আঘাতে জমিতে পানি উঠলে চারার অনেক ক্ষতি হয়। এই বছর মার্চ মাস থেকে এপ্রিলে তার বিক্রি হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। কিন্তু বিনিয়োগস্বরুপ ও নতুন গাছের চারা বাবদ তাকে একটি টাকাও খরচ করতে হয়নি। শুরুর দিকের মাত্র ১৫০ ও ১২০ টাকাই ছিল সব মিলিয়ে এই ব্যবসার বিনিয়োগ। সম্প্রতি জমিতে চাষের ফলন বৃদ্ধির জন্য ট্রাক্টর দিয়ে মাটি মাড়াই বাবদ ৩০০ টাকা খরচা হয়েছে। এটাই ছিলো তার এই বছরের পুর্তলিকার বাগানে করা বিনিয়োগ।
নানা রঙের নানা ফুল
পুর্তলিকার ছোট ছোট ফুলগুলি করেক রকম প্রজাতি ও রঙের হয়। কোনোটির নাম মসরোজ, পুর্তলিকা সিঙ্গেলফুল; কোনোটিকে আবার ডাকা হয় টায়রা, জায়েন্ট ফুল ও রিং পুর্তলিকা নামে। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পুর্তলিকার এক জাতের থেকে অন্য জাতের কিছুটা ভিন্নতা থাকায় এদেরকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। 'মসরোজ' জাতের ফুলগুলো দেখতে অনেকটা গোলাপের মতো, কিন্তু আকারে এরা ছোট এবং চিকন পাতা বিশিষ্ট। অন্যদিকে 'টায়রা' জাতের ফুলগুলো সিঙ্গেল পুর্তলিকার মতো হলেও গাছের পাতাগুলো দেখতে মসরোজের পাতার মতো। পুর্তলিকা ফুলের 'জায়ান্ট' প্রজাতির গাছগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে-এর পাতা মসরোজ ও ফুল সিঙ্গেল পুর্তলিকার মতো দেখতে হলেও আকারে বড় ও মোটা হয়। 'রিং পুর্তলিকা' দুই জাতের ফুলের মিশ্রণের মতো দেখতে। এর ভেতরটা মসরোজের মতো এবং বাইরের পাপাড়িগুলো সিঙ্গেল পুর্তলিকার মতো হয়।
বর্তমানে মিম আক্তারের বাগানে ভিন্ন ৫টি জাতের ৯০ রঙের পুর্তলিকার চাষ করা হয়। বাগানে ৩০ রকম প্রজাতির কাটামুকুট ফুলগাছ, ৫৩ প্রজাতির রেইনলিলিসহ আরও রয়েছে ৫০ এর অধিক ক্যাকটাস সাকুলেন্ট। তিনি ৫০ রঙের ৭০টি ডাল বিশিষ্ট পুর্তলিকার চারা বিক্রি করেন ২৫০ টাকায়। কেউ চাইলে ডাল বাড়িয়ে নিতে পারেন, এক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ কিছুটা বেড়ে যাবে। উদ্যোক্তা মিম বলেন, "অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা পুর্তলিকার অর্ডার দেয়, তাই তাদেরকে অর্ডারটি কনফার্ম করার জন্য সম্পূর্ণ অর্থ অগ্রিম বিকাশ করতে হয়। তারপর আমরা তাদের ঠিকানায় পুর্তলিকার চারাগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেই। এছাড়াও ক্রেতাদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে উপহার স্বরুপ তাদের অর্ডারকৃত চারার সাথে কিছু শিউলি ও সরিষা ফুলের বিজ পাঠানো হয়। যদি কোনো চারায় সমস্যা থাকে বা অর্ডারকৃত চারার চেয়ে কম থাকে, তাহলে আমরা তা যাচাই-বাচাই করে পুনরায় সে ক্রেতার ঠিকানায় তা পাঠিয়ে দেই। বিভিন্ন সময় আলাদা আলাদা করে গাছ তোলা, সেগুলো প্যাকিং ও কুরিয়ার করার কাজটি কষ্টসাধ্য ও একইসাথে ব্যয়বহুল। তাই আমরা পেজে আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অর্ডার নেই। তারপর একসাথে সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠিয়ে দেই।"
কেমন ছিল উদ্যোক্তা হওয়ার শুরুটা
পরিবার থেকে শুরুতে সহায়তা পাননি মিম। তাইতো নিজের পথটা প্রথমদিকে নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়েছিল। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশিরাও তার এই বাগান করার উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখেনি। অনেকেই তার বাবা-মাকে বাড়ি এসে বলে যেতেন এটা নিছক পাগলামী ছাড়া আর কিছু না। এইসব ফুলের গাছ না লাগিয়ে শাক-সবজি লাগালেও একটা কাজে দিতো বলে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মিম আক্তার তার গ্রামে এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাই আজকে তার এই অবস্থানে পৌঁছাতে যতো রকম কষ্ট হয়েছে, তা যেন ছাপিয়ে গেছে তার সফলতার গল্পে।
মিম আক্তার নিজের অর্জনের গল্প গর্বের সাথে বলেন, "একটা সময় ছিলো যখন আমার মা-বাবাকে লোকে কথা শোনাতো মেয়ের বাগান করার শখকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। আমার বাগানে যখন লোক নিয়োগ করে জমি মাড়াই ও আগাছা পরিষ্কারের জন্য বলতাম, তারা ভাবতো আমি তাদেরকে পারিশ্রমিক দিতে পারবো না। ফুলের চারা বিক্রি করে উপার্জন করা যায় এটা তারা ভাবতেই পারতো না। কিন্তু যখন গ্রামের লোক দেখলো আমার এই ফুলের চারা চাষ দিয়ে আমি বেশ ভালো উপার্জন করে পরিবারের হাল ধরতে পেরেছি, তখন তাদের ধারণা পাল্টে গেল।"
"আমি চাই আমার মতো অন্যরা যারা নিজেদের শখকে পেশায় পরিণত করে উদ্যাক্তা হতে চান তাদের পাশে দাঁড়াতে। কারণ আমি জানি আমার মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের এই অবস্থানে আসতে কতটা কাঠ-খড় পোড়াতে পেয়েছে। তাই নতুন উদ্যাগক্তারা যারা আছেন তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথকে সহজ করে তুলতে আমি তাদের পাশে থাকি সবসময়। কারও কারও ক্ষেত্রে টাকা পরে নেওয়ার শর্তেও ফুলের চারা দিয়ে থাকি। সেখান থেকে কেউ টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তার পরিস্থিতি বিবেচনা করে উপহার হিসেবে তাকে চারা গাছ দেই। আমার অনলাইন গ্রুপে চাইলে যেকোনো উদ্যোক্তা নিজেদের চারা বিক্রির জন্য পোস্ট করতে পারেন। যে সুযোগটা উদ্যোক্তা হিসেবে শুরুর দিকে আমি পাইনি, তাই অন্যদেরকে সে সুযোগটা তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখানে আমার কোনোরকম ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই এবং তাদেরকে এজন্য কোনোরকম অর্থ প্রদান করতে হয়না। আমি চাই সবার বাগান করার ইচ্ছা পূরণ হোক।"
মিম আক্তারের ভবিষ্যতে ইচ্ছা, একদিন তার বাগান আরও বড় হবে এবং সেখানে থাকবে হাজাররকম ফুল গাছের সমাহার। সামনের বছর থেকেই এই স্বপ্নপূরণের পরিকল্পনা আছে তার। বর্তমানে তার এই বাগান পরিচালনা, পরিচর্যা ও গাছের চারা তোলার কাজে তার মা-বাবা, ভাই ও চাচা তাকে সাহায্য করছেন।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.