বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানটি কি আবার উড়তে পারবে?  

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
04 May, 2022, 12:45 pm
Last modified: 04 May, 2022, 01:11 pm
বিমানটির সামনের অংশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে অবস্থা দেখে একে মেরামতের অযোগ্য বলেই মনে হয়।

ধ্বংসপ্রাপ্ত আন্তোনোভ এএন-২২৫ এর ছবিগুলো এখন বিশ্বব্যাপী উড়োজাহাজ প্রেমীদের জন্য শুধুই স্মৃতি।

বিমানটি ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত স্পেস শাটল বহন করার জন্য নির্মিত হয়। স্নায়ুযুদ্ধের পরে বিশ্বের বৃহত্তম কার্গো পরিবহনকারী হিসাবে দ্বিতীয়বারের মতো কার্যক্রম শুরু করে বিমানটি। সব ধরনের রেকর্ডই অর্জন করেছিল বিমানটি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে কিয়েভের অনতিদূরে হোস্টোমেল এয়ারফিল্ডে এটি ধ্বংস হয়।

মাইরিয়া নামক বিমানটিকে উদ্দেশ্য করে আন্তোনভ কোম্পানি টুইটারে লিখেছে, "স্বপ্নটি কখনই মরবে না"। ইউক্রেনীয় ভাষায় মাইরিয়া অর্থ 'স্বপ্ন'।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে 'এএন-২২৫' কি আবার উড়তে পারবে?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রথমে বিমানের ক্ষয়ক্ষতির দিকে একটু নজর দেয়া যাক।

এপ্রিলের শুরুতে সিএনএন-এর ভাস্কো কোটোভিও ইউক্রেনের পুলিশের সাথে হোস্টোমেল এয়ারফিল্ড পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনি তখন কাছে থেকে বিমানটির ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের খুব প্রথম থেকেই হোস্টমেল ছিল তীব্র যুদ্ধের একটি স্থান। মস্কো বাহিনী বিমানঘাঁটি দখল করার চেষ্টা করেছিল, যাতে তারা এটিকে একটি ফরোয়ার্ড অপারেটিং ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারে, এখান থেকে যাতে তারা অতিরিক্ত স্থল ইউনিটে বিমান পরিচালনা করতে পারে। এজন্য, তারা যুদ্ধ হেলিকপ্টার দিয়ে একটি বিমান হামলা চালায়"।

তিনি আরও বলেন, "তাদের কিছু প্রাথমিক সাফল্য ছিল বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়াও খুব দ্রুত ছিল। যে কোনো ধরনের রুশ অবতরণ প্রতিরোধ করতে বিমানক্ষেত্রে তারাও দ্রুত এবং শক্তিশালী আক্রমণ করেছিল"।

১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত স্পেস শাটল বহন করার জন্য বিমানটি নির্মিত হয়

বিমানের অবস্থা দেখে এটিকে মেরামতের অযোগ্য বলেই মনে হয়। কোটোভিও বলেন, "বিমানটির সামনের অংশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সরাসরি কোনো কামানের আঘাতের শিকার হয়েছিল এটি। এছাড়াও, ডানা এবং ইঞ্জিনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লেজের শেষ অংশে শ্র্যাপনেল বা বুলেটের কয়েকটি গর্ত ছাড়া খুব বেশি ক্ষতি হয়নি"।

তিনি বলেন, "বিমানের সামনের অংশে সরাসরি আঘাত না করা হলে, এটি মেরামত করা যেতে পারতো। বিমানটির চারপাশ গোলাবারুদ, ধ্বংসকৃত রাশিয়ান ট্যাঙ্ক, ট্রাক এবং সাঁজোয়া যানবাহন দিয়ে ঘেরা ছিল।

দ্বিতীয় আরেকটি বিমান আসছে

কিয়েভের প্রকৌশলী এবং বিমানচালনা বিশেষজ্ঞ আন্দ্রি সোভেনকো ১৯৮৭ সাল থেকে আন্তোনোভ কোম্পানিতে কাজ করেছেন। বিমানটিতে তিনি টেকনিক্যাল টিমের অংশ হিসাবে ছিলেন। তিনি বিমানের ধ্বংসাবশেষ ভিডিও এবং ছবিসহ ক্ষয়ক্ষতির একটি বিশদ তালিকা তৈরি করেছেন।

তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, ফিউজেলেজের কেন্দ্র এবং ককপিট ও ক্রু রেস্ট কম্পার্টমেন্ট সহ বিমানের সামনের অংশটি ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্লেনের অনবোর্ড সিস্টেম এবং সরঞ্জামাদি।

তিনি বলেন, "এগুলো পুনরুদ্ধার করা সবচেয়ে কঠিন হবে। কারণ, 'এএন-২২৫' এ ব্যবহৃত বেশিরভাগ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সিস্টেম, পাম্প এবং ফিল্টারগুলো সবই ১৯৮০ এর দশকের। এগুলো এখন আর তৈরি করা হয় না। তাই এগুলোকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না আর"।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে, কিয়েভের অনতিদূরে হোস্টোমেল এয়ারফিল্ডে বিমানটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়

তবে, আশার কথা হলো ফ্ল্যাপ এবং আইলারনের মতো এরোডাইনামিক সার্ফেস সহ ডানার অংশগুলো সামান্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এগুলো উদ্ধার করা যেতে পারে।

ধারণা করা হচ্ছে, ছয়টি ইঞ্জিনের অধিকাংশই অক্ষত রয়েছে। প্লেনের পুরো লেজের অংশটির শুধুমাত্র শ্র্যাপনেলের আঘাত লেগেছে। ফলে এখনো এটি গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আছে। 

আন্তোনোভ এয়ারলাইন্সের ইতিহাস সম্পর্কে একটি বই লিখেছিলেন ওভেনকো। মাইরিয়াতে যাত্রার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন যে, হোস্টোমেলের বিমানটি মেরামতের অযোগ্য। তিনি বলেন, "এই বিমানটির মেরামত বা পুনরুদ্ধারের কথা বলা অসম্ভব। আমরা কেবলমাত্র অন্য একটি মাইরিয়া নির্মাণের বিষয়ে কথা বলতে পারি"।

তিনি দ্বিতীয় 'এএন-২২৫' এয়ারফ্রেমের কথা উল্লেখ করেন, যা কিয়েভের একটি বড় ওয়ার্কশপে অ্যান্টোনভ এখনো সংরক্ষণ করছে। এটি দুটি 'এএন-২২৫' নির্মাণের একটি মূল পরিকল্পনার অংশ ছিল। যদিও এটি কখনোই বাস্তবতার মুখ দেখে নি।  

সোভেনকো বলেন, "এটি একটি সম্পূর্ণ ফিউজলেজ। এটিতে ইতিমধ্যেই একটি নতুন কেন্দ্র বিভাগের সাথে ডানাগুলোর ভার বহনকারী কাঠামো এবং লেজের ইউনিট বসানো হয়েছে। এক কথায়, এটি প্রায় সম্পূর্ণ হওয়া একটি এয়ারফ্রেম। আমি যতদূর জানি, এটি প্ল্যান্টে রাশিয়ান আর্টিলারি আক্রমণের সময় কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল"।

একটি নতুন ডিজাইন

সোভেনকো বলেন, "ঠিক একই নকশা এবং সরঞ্জাম সহ একই বিমান তৈরি করা অসম্ভব। যদি তা করা হয়, তবে আন্তোনভ কোম্পানি দুটি বাধার সম্মুখীন হবে। প্রথমত, নতুন এবং পুরাতন উপাদানগুলোকে একসাথে কাজ করানো। এবং দ্বিতীয়ত, এটির বায়ুযোগ্যতা এবং বর্তমান নিয়ম নীতির সাথে সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করতে বিমানটির নতুন করে অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হবে।

কোম্পানির প্রথম ইস্যুতে অভিজ্ঞতা রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে 'এএন-২২৫' এর অনেক সিস্টেমই আপডেট করা হয়েছে এবং পুরানো সোভিয়েত প্রযুক্তিকে ইউক্রেনের আধুনিক সমতুল্য প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু একটি সম্পূর্ণ নতুন অনুমতিপত্রের জন্য সময় লাগবে এবং এতে খরচও বৃদ্ধি পাবে।

সোভেনকোর বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত এটি প্রায় অনিবার্য বলেই মনে হচ্ছে। ৪০ বছরের পুরাতন ডিজাইনের সাথে আজকের একটি বিমান তৈরি করা অর্থহীন। তবে এটাও সম্ভব যে, মূল বিমানের অপারেটিং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিমানের নকশায় নতুন করে পরিবর্তন করাই উপযুক্ত"।

'এএন-২২৫' কখনই বাণিজ্যিক মালামাল বহনের জন্য ডিজাইন করা হয়নি। এর বিশাল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, বিমানটি ক্রুদের দিক থেকে পরিচালনা করতে অসুবিধাজনক ছিল। কার্গো লোড করার জন্য এটিকে সামনের দিক থেকে নামাতে হতো, অনেকটা হাতি যেভাবে হাঁটু গেড়ে বসে, তেমন একটি পদ্ধতি।

এর অনন্য ডিজাইনের কারণে, প্লেনের শুধুমাত্র সামনের অংশ খোলে এবং এটির পিছনে কোনও র‌্যাম্প নেই। কার্গো ফ্লোরেও নতুন কিছু সংযোজন করা যেতে পারে এবং বিদ্যমান বিমানবন্দর অবকাঠামোর সাথে বিমানের নির্ভরতার মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে।

মিলিয়ন নাকি বিলিয়ন?

দ্বিতীয় মাইরিয়া তৈরি করতে প্রচুর খরচ করতে হবে। তবে ঠিক কত খরচ হবে তা নির্ধারণ করা কঠিন। অপারেশন ব্যয় ৩ বিলিয়ন ডলার শোনার পর ইউক্রেনের জাতীয় বার্তা সংস্থা ইউক্রিনফর্ম অবাক হয়েছিল। ২০১৮ সালে আন্তোনোভ অনুমান করেছিল দ্বিতীয় এয়ারফ্রেম তৈরীতে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ হবে। যদিও সেই পরিসংখ্যানটি এখন সংশোধন করার প্রয়োজন হতে পারে।

সোভেনকো বলেন, "এই মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে কিছুই জানা যাচ্ছে না। বিমানটির অক্ষত অংশগুলো কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার উপর খরচ নির্ভর করবে। সেইসাথে নির্ভর করবে কতগুলো পরিবর্তন এবং নতুন সরঞ্জামের প্রয়োজন হবে তার উপর। খরচের একটি বড় অংশ সার্টিফিকেশন পরীক্ষার পরিমাণের উপর নির্ভর করবে। তবে যে কোনও ক্ষেত্রে, আমাদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত এই খরচের পরিমাণ শত শত মিলিয়ন ডলারেই হবে, বিলিয়ন নয়"।

এয়ারোডাইনামিক অ্যাডভাইজরির একজন বিমান বিশ্লেষক রিচার্ড আবুলাফিয়া সহমত পোষণ করে বলেন যে, "বিমানটি নিছক একটি প্রোটোটাইপ হবে কিনা বা তারা এটিকে সম্পূর্ণ সার্টিফিকেশন সহ বাণিজ্যিক পরিষেবায় যুক্ত করতে চায় কিনা তার উপর নির্ভর করে অনুমতিপত্রসহ ৫০০ মিলিয়ন ডলার-ই যুক্তিসঙ্গত নির্মাণ ব্যয়।

আবুলফিয়া বলেন, "আসল প্রশ্ন হচ্ছে এর জন্য অর্থ প্রদান করবে কে? এই প্লেনের জন্য সত্যিই খুব বেশি বাণিজ্যিক আবেদন নেই, এবং তাছাড়া এত টাকা আসবে কোথা থেকে?"

তিনি আরো বলেন, "এটা ভাবা সহজ যে বেশিরভাগ খরচ অ্যান্টোনভ বহন করবে। কিন্তু অন্যান্য বেশ কয়েকটি বিমান এবং সেবা ধ্বংসপ্রাপ্তের মাধ্যমে কোম্পানিটি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এজন্য কোম্পানিটির ভবিষ্যত অনিশ্চিত"।

সোভেনকো বলেন, "আমি একজন আশাবাদী। আমি আন্তরিকভাবে এবং গভীরভাবে কামনা করি যে আন্তোনভের বিমান ভবিষ্যতের আকাশে উড়তে থাকবে। কিন্তু আমি একজন বাস্তববাদীও। আমি পুরোপুরি বুঝতে পারি যে চলমান যুদ্ধের পরে দ্বিতীয় বিমানটি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ মাইরিয়াকে আন্তোনভের আর্থিক সামর্থ্য এবং এই বিমান পরিষেবা থেকে প্রত্যাশিত আয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে"।

  • সূত্র- সিএনএন

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.