ভাং যেভাবে ভারতবর্ষের রান্নাঘরে জায়গা করে নিল

ফিচার

জেহান নিজার
03 May, 2022, 09:05 pm
Last modified: 12 May, 2022, 12:06 am
খ্রিস্টের জন্মের এক-দুই হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে ভাং-এর আগমন। এরপর ভাং-জাতীয় মাদকদ্রব্য উপমহাদেশে হয়ে উঠেছে ধর্মীয় আচারের অংশ। সেজন্য যেসব মাদকদ্রব্য মুখ দিয়ে খাওয়া যায়, সেগুলো ক্রমশ ভারতের গৃহস্থালিতেও প্রবেশ করতে পেরেছে।

বেনারসে থাকতে একবার বাবাকে তার বন্ধুরা ভুলিয়ে-ভালিয়ে ভাং খাইয়েছিল। সেবার হোলিতে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ভাং খেয়ে বাবা একটু অদ্ভূত আচরণ করতে শুরু করলেন। সেটা দেখে ভাং নিয়ে আমার ও আমার ভাইয়ের যাবতীয় কৌতূহল সাময়িকভাবে দূর হয়ে গেল। তবে কলেজে ওঠার পর ভাং আবার আমাদের জীবনে ফিরে এসেছিল, সেটা বলা বাহুল্য।

কৃষ্ণেন্দু রায় পড়ান নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি'র ফুড স্টাডিজ বিভাগে। ভাং নিয়ে তার গল্প শোনা যাক। উড়িষ্যার এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে জন্ম তার। ভাং নিয়ে তার পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল 'ইহা স্রেফ উত্তর ভারতের মানুষদের একটা নিচুজাতের জীবনাচরণ'।

ছোটবেলায় রায়ের মা-কে তার সন্তানদের এটা বোঝাতে বেগ পেতে হতো যে, ভাং ও অন্যান্য মাদকজাতীয় দ্রব্য শিবঠাকুরের পুজোতে কেন ব্যবহার করা হয়। কৃষ্ণেন্দু রায় জীবনে একটু দেরি করে টের পেয়েছেন গাঁজা, ভাং ইত্যাকার মাদকদ্রব্য ধর্মীয়ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা হয়।

ভাং পান করা বা গাঁজা খাওয়ার ক্ষেত্রে একটু মেপে খেতে হয়। রায় মনে করেন, ঠিক এ কারণেই ভাং জাতীয় মাদকদ্রব্যগুলোকে মানুষের খাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় আচার-আচরণের সাথে যুক্ত করে ফেলা হয়েছে। সেজন্য যেসব মাদকদ্রব্য মুখ দিয়ে খাওয়া যায়, সেগুলো ক্রমশ ভারতের গৃহস্থালিতেও প্রবেশ করতে পেরেছে।

গবেষণা দাবি করছে, খ্রিস্টের জন্মের এক থেকে দুই হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে ভাং-এর আগমন। খুব সম্ভবত আর্যদের সাথেই এ অঞ্চলে ভাং প্রবেশ করেছে। ভাং-এর উৎপত্তি নিয়ে তত্ত্বের শেষ নেই। ধারণা করা হয়, মধ্য এশিয়ার মঙ্গোলিয়া ও মধ্য-সাইবেরিয়া থেকে শুরু করে হুয়াং হে নদী উপত্যকা, হিন্দু কুশ পর্বতমালা, দক্ষিণ এশিয়া, আফগানিস্তান; এ বিস্তীর্ণ এলাকায় গাঁজা পাওয়া যেত।

ভারতে গাঁজা বিষয়ে সবচেয়ে পুরাতন লিখিত ভাষ্য পাওয়া যায় অথর্ববেদে। খ্রিস্টের জন্মের দেড় হাজার বছর আগে এটি লেখা হয়েছিল। সেখানে ভাংকে দুশ্চিন্তা উপশমে সহায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভাং নিয়ে জানার আগে ভাং তৈরির অন্যতম উপাদান গাঁজা নিয়ে, বিশেষত গাঁজা গাছের বিভিন্ন প্রকারভেদ নিয়ে জানা প্রয়োজন। ক্যানাবাসিয়া পরিবারের ফুলজাতীয় গাছের একটি বর্গ হচ্ছে ক্যানাবিস বা গাঁজা। এর আবার অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে। এ প্রজাতিগুলোর নির্দিষ্ট সংখ্যা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস তার স্পিশিস প্ল্যান্টেরাম নামক গ্রন্থে গাঁজার একটি প্রজাতির কথা বর্ণনা করেছেন যাকে তিনি ক্যানাবিস স্যাটিভা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৭৫৩ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে সে সময়ে জানা থাকা সব গাছের প্রজাতির উল্লেখ ছিল।

বিখ্যাত ফরাসি জীববিজ্ঞানী জ্যঁ ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক গাঁজার দুইটি প্রজাতির কথা প্রস্তাব করেছেন। ক্যানাবিস স্যাটিভা ও ক্যানাবিস ইন্ডিকা। এর মধ্যে ক্যানাবিস স্যাটিভা পশ্চিমে বেশি চাষ হতে দেখা যায়। অন্যদিকে ক্যানাবিস ইন্ডিকা মূলত ভারত ও এর আশেপাশের দেশগুলোতে পাওয়া যায়। রাশিয়ান জীববিজ্ঞানী ডিই জ্যানিশেভিস্কি ১৯২৪ সালে ক্যানাবিস রুডেরেইলস নামে তৃতীয় আরেকটি গাঁজার প্রজাতির কথা উল্লেখ করেন।

খাবারের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ কেটি আচায়া তার আ হিস্টোরিক্যাল ডিকশনারি অব ইন্ডিয়ান ফুড গ্রন্থে অথর্ববেদে বর্ণিত ভাং যে আদৌ ক্যানাবিস স্যাটিভা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন এটি ইন্ডিয়ান সান-হেম্প প্রজাতিও হতে পারে, কারণ এ দুটো গাছ দেখতে প্রায় একই।

তবে কোন বইয়ে কোন গাঁজার কথা বলা আছে তা নিয়ে বিস্তর দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও, গাঁজা থেকে তৈরি ভাং-এর মতো মাদকদ্রব্যগুলোকে কয়েকটি নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ করা যায়। আচায়া'র মতে 'ভাং বলতে শুকনা গাঁজাপাতা ও পুষ্পমঞ্জরী, গাঁজা বলতে স্ত্রী গাঁজা গাছের শুকনা ফুলের শীর্ষ অংশ, এবং চরস বলতে গাঁজা গাছ থেকে পাওয়া নির্যাসকে বোঝায়।'

ভারতে অনেক আগে থেকেই ধর্মীয় ও চিকিৎসাজনিত কারণে বিভিন্নপ্রকার মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হয়। হিন্দুদের অনেক দেবতার পূজায় গাঁজা বা ভাং ব্যবহার করা হয় এবং পরে সেগুলো ভক্তরা প্রসাদ হিসেবে পান। এর ফলে এখানে ভাং, খৈনি ইত্যাদির মতো মাদকদ্রব্যও খুব স্বাভাবিক একটি আহার্য বস্তু হিসেবে দেখা হয়।

ভাং বানানোর প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন রাজস্থানের হোটেল ব্যবসায়ী আজওয়াদ রাজা। প্রথমে গাঁজা পাতাকে শুকানো হয়। এরপর সেগুলো হামানদিস্তায় পেষা হয়। এরপর সেই পেষানো গুঁড়ার সাথে খানিক পানি মিশিয়ে এটিকে আধাতরল কাই-এ পরিণত করা হয়।

এরপর ওই কাইকে কাপড়ের টুকরা দিয়ে ছাঁকা হয়। ছাঁকার ফলে পাওয়া তরল পদার্থই ভাং হিসেবে পান করা হয়। কেউ কেউ ভাং মিষ্টি করার জন্য শুকনো ফল (ড্রায়েড ফ্রুট) মিশিয়ে খান। দুধ, পানি ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরি করা এ ধরনের সুমিষ্ট ভাং-এর শরবত বর্তমানে ভারতে হোলি বা দোল উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।

দিল্লির বাসিন্দা খাদ্য বিষয়ক লেখক শিরিন মেহরোত্রা জানিয়েছেন ভাং-এর আরেকটি পরিবশনের কথা। লক্ষ্ণৌ ও বারাণসীতে ঠাণ্ডাই নামে একটি জনপ্রিয় পানীয় পাওয়া যায়। হোলির সময় লক্ষ্ণৌতে, এবং     মহাশিবরাত্রির সময় বারাণসীতে ঠাণ্ডাই-এর সাথে ভাং মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। মেহরোত্রা বলেন, 'এ সংস্কৃতির বড় একটা অংশ হয়ে গেছে ভাং মেশানো ঠাণ্ডাই। আপনি দেখবেন সরকারের অনুমোদিত বিভিন্ন দোকানে এটি খোলামেলাভাবেই বিক্রি হচ্ছে। তবে চাইলে আপনি ভাং ছাড়া ঠাণ্ডাইও খেতে পাবেন।'

ছবি: সংগৃহীত

বৈদিক ভারতে সোমলতা নামের একটি মাদক গুল্মের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বর্গদেব ইন্দ্রকে পূজা করার জন্য সোমরস ব্যবহার করা হতো। তবে সোমলতার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি কখনো। রান্নাবিষয়ক ইতিহাসবিদ কলিন টেইলর সেন তার ফিস্টস অ্যান্ড ফাস্টস আ হিস্ট্রি অব ফুড ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে সোমলতাকে ভারতের রান্নার ইতিহাসে সবচেয়ে অমীমাংসিত রহস্য বলে উল্লেখ করেছেন। সেন জানাচ্ছেন, ঋগবেদে সোমরসের কথা প্রায় শখানেক বার উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে সোমলতার তালাশ কখনো পাওয়া না গেলে আজকের ভারতে এত জনপ্রিয় ভাং-এর পূর্বসূরি হিসেবে সোমকে অনায়াসে মেনে নেওয়া যায়।

গাঁজাসমৃদ্ধ পানীয় যে কেবল উত্তর ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাও নয়। ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ও খাদ্য বিষয়ক লেখক শ্বেতা মহাপাত্রের জন্ম উড়িষ্যার উপকূল অঞ্চলে। তিনি জনাচ্ছেন ভাং মিশিয়ে তৈরি করা একধরনের পানা'র কথা। পানা হচ্ছে ফল থেকে তৈরি করা মিষ্টি তরল শরবত। বাংলাদেশে বেল দিয়ে তৈরি বেলপানা শিবচতুর্দশীতে শিবপূজার একটি অতি প্রয়োজনীয় অর্ঘ্য। উড়িষ্যা অঞ্চলে নতুন বছর উদযাপনকে পানা সংক্রান্তি বলা হয়। তখন বিভিন্ন ফলের এই পানা শরবতে ভাং-এর ব্যবহার করা হয়। এক সময়ে পানা হাত দিয়ে তৈরি করা হলেও আজকাল ব্লেন্ডার মেশিনেই পানা তৈরি করা হচ্ছে।

তরল উপায়ের বাইরেও স্রেফ চিবিয়ে খাওয়ার মতো করেও ভাং খাওয়ার ইতিহাস রয়েছে ভারতে। ১৮৪২ সালে আইরিশ চিকিৎসক তার দ্য বেঙ্গল ডিপেন্সারি বইয়ে দুধ দিয়ে তৈরি গাঁজা মিশ্রিত মাজুন-এর কথা উল্লেখ করেছেন। মাজুনের ক্ষেত্রে ঘি, চিনি, দুধ-এর সংমিশ্রণ শক্ত করে পরে তাতে গাঁজাপুষ্ট মাখন মিশিয়ে ওই শক্ত টুকরোগুলোকে কেটে পরিবেশন করা হতো।

ভারতীয় মিঠাই যতই বিবর্তিত হচ্ছে তা-তে ভাং যোগ করার অবকাশ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। হালে ভাং ফ্লেভারের ডাম্পলিংও পাওয়া যাচ্ছে ভারতে। শিরিন মেহরোত্রা বলছেন, লাড্ডু বা পেড়ার সাথেও ভাং মেশানো সম্ভব।

উত্তরাখণ্ডের খাবারদাবার নিয়ে লিখেন ঘিলদিয়াল। তিনি জানিয়েছেন ভাং-এর চাটনির কথা। উত্তরাখণ্ড অঞ্চলের স্থানীয় এ বিশেষ খাবারটির কথা শুনলে মানুষ নাকি সবার প্রথমে ঘিলদিয়ালের কাছে প্রশ্ন রাখেন, এ চাটনি খেলে মাদকের অনুভূতি পাওয়া যাবে কিনা। তবে এ চাটনি গাঁজা গাছের বীজ থেকে তৈরি করা হয়, আর বীজগুলোর কোনো নেশার ঘোর সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই।

বর্তমানে বিভিন্ন ভারতীয় খাবারে ভাং মেশানো হলেও একসময় ভাং-এর মতো মাদকদ্রব্যগুলো কেবল নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণীর মানুষ ব্যবহার করতেন। স্কটিশ চিকিৎসক ও পদার্থবিদ জর্জ স্কট তার দ্য ডিকশনারি অব ইকোনোমিক্স প্রোডাক্ট অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে জানাচ্ছেন, শ্রমিক, ভিক্ষুক বা বাড়ির চাকর-বাকরেরাই মূলত ভাং-এর প্রধান ভোক্তা। মধ্যবিত্ত ও উচ্চশ্রেণীর মানুষেরা কেবল নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময়ই ভাং গ্রহণ করতেন, এবং তাও যৎকিঞ্চিত পরিমাণে।


  • জেহান নিজার চেন্নাইভিত্তিক ফিচার লেখক ও ফুড ব্লগার। তিনি  চেন্নাইয়ের এশিয়ান  কলেজ অভ জার্নালিজম-এ ফিচার লেখার ক্লাসও নেন।
  • ভাষান্তর: সুজন সেন গুপ্ত

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.