প্রকৃতি ও মানুষ বাঁচাতে দেলোয়ার ও তার বন্ধুদের প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলন

ফিচার

11 April, 2022, 10:05 pm
Last modified: 12 April, 2022, 03:32 pm
প্রাণ বৈচিত্র্য খামারের মাধ্যমেই তারা প্রচার করেন প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের। রাসায়নিক সার, পেট্রিসাইড, হরমোন আর এগ্রো কেমিক্যালের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে কৃষিকে রক্ষা করাই এই আন্দোলনের লক্ষ্য।

বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা প্রজন্মের এক বালক বড় হয়ে কৃষক হতে চেয়েছিল। ছেলেবেলার আর দশটা খামখেয়ালি ইচ্ছার মতো না, কৃষক সমাজের দুর্দশা দেখে দেখে সেই বালক সুদূর পরিকল্পনা নিয়েই শুরু করেছিল কৃষক হওয়ার স্বপ্ন৷ কুষ্টিয়ার গোপালপুর গ্রামে বেড়ে ওঠা বালক পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির সুযোগ নাকচ করে দিয়ে এগিয়েছে কৃষক হওয়ার পথেই। প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করতে চাওয়া সেই বালক দেলোয়ার জাহান এখন সফল কৃষক হিসেবে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় গড়ে তুলেছেন প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র ও প্রাণ বৈচিত্র্য খামার।

কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠার সুবাদে দেলোয়ার শুরু থেকেই কৃষকদের সংকটগুলোর কথা জানতেন। প্রতি বছর সার ব্যবসায়ীরা কীভাবে কৃষকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিষাক্ত সার দিয়ে যেতেন, আর সেসব সারের প্রভাবে কীভাবে কৃষিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ত তা দেখতে হত প্রতিনিয়তই। অনেক কৃষককে একারণে মৃত্যুবরণ করতেও দেখেছেন। তাই ছোটবেলা থেকেই মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল কৃষি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার সংকল্প।

দেলোয়ার জাহানের ভাষ্যে, "কৃষক সমাজকে কীভাবে এই জালের মধ্যে থেকে বের করা যায় তা-ই ছিল চিন্তা। তারপর বাকি জীবনে পরিকল্পনা গুলোকে সাজিয়ে নিয়ে নিজেকে তৈরি করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় পড়েছি কৃষক সমাজ ও গ্রামীণ জনপদের কমিউনিকেশনটাকে বোঝার জন্য৷ আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট তখন থেকেই প্রান্তজনীয় যোগাযোগ গবেষণা (প্রাযোগ) নামে পাঠচক্র করতাম। সেটা দিয়েই পরবর্তীতে প্রান্তজনীয় যোগাযোগ গবেষণা পদ্ধতি বের করি। প্রাকৃতিক কৃষি এবং আমার এখনের সব কাজ এই গবেষণারই ফলাফল।"

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ আট বছর দেলোয়ার যুক্ত ছিলেন একটি জাতীয় দৈনিকের কৃষি প্রতিবেদক হিসেবে। ঢাকায় সাংবাদিকতা করলেও সবসময় গ্রামীণ কৃষির কল্যাণের কথা ভাবতেন। ২০১২ সালে প্রাযোগের বন্ধুদের নিয়ে মানিকগঞ্জে গড়ে তুলেন প্রাকৃতিক কৃষির খামার। সেসময়ে সবার স্বল্প আয় থেকে ৫০-১০০-৫০০ টাকার মতো জমিয়ে লিজ নেওয়া জমিতে শুরু করেছিলেন খামারের কাজ। সাংবাদিকতার কাজে একদিন বন্ধ পেলেই ছুটে যেতেন খামারের কাজে। নিজেরা চাষ করার পাশাপাশি গ্রামের কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন।

খামার করার জন্য মানিকগঞ্জকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে দেলোয়ার বলেন, "ঢাকায় সাংবাদিকতা করতাম বলে এমন জায়গা বেছে নেওয়া দরকার ছিল যেখানে একদিনের নোটিশে ঢাকা থেকে এসে কাজ করে যেতে পারি।  যে জায়গায় আগামী ২০ বছরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিউশন হবেনা। যেখানের সোসাইটিতে সব ধরনের মানুষ আছে, ডাইভারসিটি আছে। যে জায়গায় যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ আছে।" মানিকগঞ্জের গ্রামগুলো তার সব কয়টি চাহিদা পূরণ করতে পেরেছিল।

সব ধরনের প্রাণের আশ্রয়, নিরাপত্তা, প্রাণের জাগরণের ধারণা নিয়ে ২০১৮ সালে নিজস্ব অর্থায়নে কাউটিয়া গ্রামে দেলোয়ার গড়ে তুলেন তার প্রাণ বৈচিত্র্য খামার। এই খামারের মাধ্যমেই তারা প্রচার করেন প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের। রাসায়নিক সার, পেট্রিসাইড, হরমোন আর এগ্রো কেমিক্যাল আছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে কৃষিকে রক্ষা করাই এই আন্দোলনের লক্ষ্য।

"আমরা চাই মানুষ নিরাপদ খাবার খাক, এই নিরাপদ উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা কোনো রাসায়নিক বা পেট্রিসাইড হরমোন দিব না। কোনো এগ্রো কেমিক্যাল ব্যবহার করব না। পোকামাকড়, কীটপতংগ, পাখি, অন্য প্রাণী আর মাটির ভেতর যেসব প্রাণ থাকে তা যেন ভালো থাকে এবং পরিবেশ যেন ভালো থাকে সে চেষ্টা করব," বলেন দেলোয়ার।

কৃষিকে আরো ভালো করে বোঝার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রি ইকোলজিতেও পড়েছেন দেলোয়ার। কিন্তু তিনি বলেন, "আমি যা করছি এগুলো আসলে কোনো প্রতিষ্ঠানে শেখায় না৷ আমি লেখাপড়া করে জেনে বুঝে এসব করছি এমন না। দশ হাজার বছর ধরে কৃষকরা যা চর্চা করছে সেগুলোর মধ্য  থেকে চিহ্নিত করে, যেগুলো পরিবেশবান্ধব, যেগুলো প্রাণবান্ধব, যেগুলো স্বনির্ভর কৃষক সমাজ তৈরি করবে সেগুলোকে আলাদা করে কাজ করেছি আমি।"  

রাসায়নিক ছাড়া পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল কে কীভাবে বাঁচানো যায় এমন প্রশ্নের উত্তরে দেলোয়ার হেসে বলেন, "এই যে আক্রমণের কথা বললেন, এটা কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র না। ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ না এটা! আপনি ক্ষেত করতে গেলেন আর পোকামাকড় এসে আপনার সব খেয়ে ফেললো এমন না বিষয়টা৷ পোকামাকড়-রোগবালাই সব জায়গায় আছে। যেখানে বিষ দেওয়া হয় সেখানেও আছে।"

"প্রাকৃতিক ভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পোকা মাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য পোকা আছে, ছত্রাক, অণুজীব আছে যেগুলো পোকামাকড়কে মেরে ফেলতে পারে। পাখি আছে, ব্যাঙ আছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নিয়ে আসলে পোকামাকড়, রোগবালাইয়ের উৎপাত থেকে এম্নিই রক্ষা পাওয়া যায়।"

স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থায় কোনো কিছু বাজার থেকে কেনার পক্ষপাতি না দেলোয়ার। কৃষকের বাড়িতে যা যা আছে সেগুলো ব্যবহার করে ও মানুষের বাইরের নানা প্রাণকে সক্রিয় করেই ব্যবস্থা নেন। চালের গুড়া, গোবর, গুড়, ভাত ইত্যাদি ঘরে থাকা নানা উপাদানকে কাজে লাগিয়েই প্রাকৃতিক সার বানিয়ে নেন তিনি। এসব সার মাটির উপাদানগুলোকে সক্রিয় করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।

পরিবেশের ক্ষতিতে পরোক্ষভাবেও যেন প্রভাব না ফেলেন সেজন্যও বেশ সচেতন দেলোয়ার জাহান। তাই প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র পুরোটাই চলে সৌর বিদ্যুতে।    

আশেপাশের গ্রামসহ দেশের নানা প্রান্তের বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের প্রাকৃতিক কৃষির প্রশিক্ষণ দেন দেলোয়ার জাহান ও তার দল। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ছয়-সাত হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারা। 

"আমরা চেষ্টা করি কৃষকদের সংকট গুলো বুঝতে, তাদের সমস্যা তাদের কাছেই তুলে ধরতে। তারা যেন বুঝতে পারে নিজেদের সংকটগুলো," বলেন দেলোয়ার। এসব সংকট সমাধানের জন্য কৃষকদের সাথে মিলে কাজ করেন তারা।

মোহাম্মাদপুরে শহীদ সলিমুল্লাহ রোডে রয়েছে প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র। মানিকগঞ্জের খামার ছাড়াও বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, ঝিনাইদহ অঞ্চলের নানা জায়গার প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতিতে চাষ করা ফসল আনা হয় সেখানে। সপ্তাহের সাত দিনই এই বিপণন কেন্দ্র থেকে সরাসরি ফসল কেনার পাশাপাশি ঢাকা শহরের ভেতর হোম ডেলিভারিও নিতে পারেন ক্রেতারা।

প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র ও প্রাণ বৈচিত্র্য খামারে প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে দুই-তিন দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন দেলোয়ার। এপর্যন্ত এখান থেকে ২১টি ব্যাচে প্রায় ২১০ জন কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সামনের বৈশাখ মাসের দুই আর তিন তারিখে আবার আয়োজন হয়েছে এই প্রশিক্ষণের।

বর্তমানে দেলোয়ারের নিজের দুই বিঘা জমি আর লিজ নেযয়া আরো ১৪ বিঘা জমি সহ মোট ১৬ বিঘা জমিতে মানিকগঞ্জের প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র ও প্রাণ বৈচিত্র্য খামার অবস্থিত। ২০২০ সাল থেকে স্ত্রী আর পুত্র-কন্যাসহ তিনি খামার বাড়িতেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন। দেলোয়ারের পেশা, নেশা, চিন্তার জায়গা, গবেষণার জায়গা, দর্শনের জায়গা সবই কৃষি।

নিজের জীবন ধরণের প্রতি দৃঢ় আস্থা নিয়ে দেলোয়ার বলেন, "অধিকাংশ মানুষ-ই নগর জীবন থেকে বেরোতে চায়, বেরোতে কিন্তু পারে না। হয় আজিমপুর গোরস্থানে যায় এসব আশা নিয়ে নিয়ে অথবা অন্য কোনো গোরস্থানে তাদের জায়গা হয়। আমি সেটা করতে চাই নাই। কোনভাবেই আশা নিয়ে লাশ হয়ে গ্রামে ফেরার পক্ষে না। আমি যা করতে চাইছি, আমি যা বলছি ছোটবেলা থেকে, আমি তা করে ছাড়ছি। আমার কাছে এরকম না যে এক ধরনের রোমান্টিসিজিম ছিল কৃষিটা। আমার কাছে এইটাই জীবন। আমি এই দর্শন মানি, এই জীবনযাপনের মধ্যে দিয়েই আমি থাকি। আমার কাছে মনে হয় জীবন এরকমই থাকা উচিত।"

"প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণের মতোই আমারও এক জীবন, আমি সবার সাথে মিলে মিশে থাকি। এবং এমন জীবনযাপন করি যে জীবনযাপন অন্যের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর না হয়। পাখির জন্য না হয়, কীটপতঙ্গের জন্য না হয়, মাছের জন্য না হয় এবং মানুষের জন্যও না হয়।"
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.