মাদুরে পাতা পোলাও থেকে জনপ্রিয় খাবার ব্র্যান্ড: হাজী নান্না বিরিয়ানীর গল্প 

ফিচার

নুসরাত জাহান লাবণ্য ও শেখ রাফি আহমেদ
05 April, 2022, 02:10 pm
Last modified: 05 April, 2022, 08:38 pm
ঢাকায় বর্তমানে নান্না বিরিয়ানীর ৭টি শাখা রয়েছে। কিন্তু তাদের নাম ব্যবহার করে অন্তত শতাধিক দোকান ব্যবসা করছে।

ভোজনরসিক বিরিয়ানি প্রিয় বাঙালীর কাছে বিরিয়ানি মানেই যেন 'হাজী নান্না বিরিয়ানি'। শুরুর দিকে নান্না মিয়া যখন বিরিয়ানি রান্না করে বিক্রি শুরু করেন, তখন তাদের কোনো দোকান বা বসে খাওয়ার মতো চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা ছিল না। মাদুর পেতে সেই সময় লোকে নান্না মিয়ার বিরিয়ানি খেত। ৬০ বছরের ব্যবধানে নান্না মিয়ার সেই বিরিয়ানিই এখন ঢাকাবাসীর কাছে একনামে পরিচিত ও জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৬২ সালে যখন চারদিকে শিক্ষা আন্দোলনের অস্থিরতা, সেই সময় এক মধ্যবিত্ত ব্যক্তি মাসিক বাজারসদাই করার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে রিক্সা থেকে নেমে পুরান ঢাকার মৌলভিবাজারের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেন। মানুষের ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই হঠাৎ তার নাকে অদ্ভুত সুন্দর এক ঘ্রাণ এসে লাগে, সে সুগন্ধ তাকে বাজার করার কথাও ভুলিয়ে দেন।

ঘ্রাণটা কোন সুস্বাদু খাবারের তা তিনি দ্রুতই বুঝতে পারলেন। তারপর ঘ্রাণের টানে উৎসে পৌঁছে দেখলেন জীর্ণ-শীর্ণ ছোট্ট একটা দোকানে এক লোক চিকেন বিরিয়ানি বিক্রি করছেন। বিরিয়ানির ঘ্রাণ তাকে এতো প্রলুব্ধ করেছিল যে তিনি নিজেকে সামলাতে না পেরে এক প্লেট মোরগ পোলাও অর্ডার করে বসলেন।

এই গল্পটি লেখকদ্বয়ের কল্পনা-প্রসূত। কিন্তু বলে দিতে হবে না যে, স্বাদে-ঘ্রাণে আজ ৬০ বছর পরে এসেও এই নান্না বিরিয়ানি ঢাকাবাসীর কাছে একই রকম জনপ্রিয়!

সেদিন ছোট্ট দোকানে বিরিয়ানি বিক্রি করা ব্যক্তিটি ছিলেন নান্না মিয়া, যার হাত ধরে 'হাজী নান্না বিরিয়ানির' যাত্রা শুরু হয়; তার নামেই দেওয়া হয়েছিল দোকানের নাম।    
নান্না মিয়ার ভাতিজা আবদুল্লাহ বাবুল চাচার মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারী হিসেবে এই দোকানের সব দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

নান্না মিয়ার সাথে তার সম্পর্ক ভালো থাকায় তিনি খুব কাছ থেকে এই ব্যবসার সবকিছু দেখেছেন। আবদুল্লাহ বলেন, "বাবা বলা হোক আর মা- নান্না মিয়া ছিলেন আমার সব। আমার নিজের বাবা-মার থেকেও তিনি আমার আপন ও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ছোটবেলায় পড়াশোনার পাশাপাশি আমি রান্নায় তাকে সাহায্য করতাম। তিনি না থাকলে আমি আজকে এই জায়গায় কখনোই আসতে পারতাম না । তাই আমি তার সম্মান বজায় রাখতে আজীবন চেষ্টা করে যাবো।"

"১৯৬০ সালে যখন আমরা প্রথম মোরগ পোলাও বিক্রি শুরু করি, তখন আমাদের কোন দোকান ও চেয়ার-টেবিল ছিল না বসে খাওয়ার মতো। আমরা মৌলভিবাজারের ছোট্ট একটি দোকানে পাতলা মাদুর বিছিয়ে বিরিয়ানি বিক্রি করতাম। মাত্র ৫-৬ কেজি বিরিয়ানি রান্না করে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হতো। সেই সময় ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হওয়া ব্যবসাই আজ এখানে পৌঁছেছে"।

ঢাকায় বর্তমানে নান্না বিরিয়ানির ৭টি শাখা রয়েছে। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ি, লালবাগ, নাজিরাবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, মিরপুর ও বেনারসি পল্লিতে নান্না বিরিয়ানির শাখাগুলো অবস্থিত। মৌলভিবাজারে নান্না বিরিয়ানির যাত্রা শুরু হলেও পরে সেটা পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ির সরদার ভবনে নেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকার মধ্যেই নান্না বিরিয়ানির নাম ব্যবহার করে অন্তত শতাধিক দোকান ব্যবসা করছে। আসল নান্না বিরিয়ানির নাম ও ব্যবসা এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বর্তমানে আবদুল্লাহ নান্না বিরিয়ানির প্রধান শাখা বেচারাম দেউড়ির দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। নাম ব্যবহার করে আসা ভুয়া প্রতিষ্ঠান নিয়ে আবদুল্লাহ বলেন, "শুধুমাত্র ঢাকার মধ্যেই এমনটা হচ্ছে তা নয়, দুবাই থেকে সিঙ্গাপুর অনেকেই নান্না বিরিয়ানির নাম ব্যবহার করে দোকান চালাচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে নাজিরাবাজারেও এমন একটি দোকান রয়েছে, যাদের দোকান আমাদের দোকানের চাইতেও বড় এবং সেখানে অনেক বেশি মানুষ বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে"।

"আমাদের নাম ব্যবহার করে আসছে এমন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমরা কোর্টে মামলা করেছি। কিছু মামলা কোর্টে চলমান রয়েছে। কিন্তু এতো এতো ভুয়া প্রতিষ্ঠান রয়েছে যে আমাদের পক্ষে সবার বিরুদ্ধে মামলা চালানো সম্ভব না।"

এতো সব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ভিড়ে নান্না বিরিয়ানির জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি বরং আরও বেড়েছে দিন দিন। নান্না বিরিয়ানির সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম মোরগ পোলাও এখনো আগের স্বাদ ও প্রক্রিয়া মেনে রান্না করা হয়।

আবদুল্লাহ জানান, নান্না মিয়া ভাই জুম্মুন মিয়া ও চান মিয়াকে সাথে নিয়ে বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু করেন। হাজী নান্না বিরিয়ানির আগে 'আনসার রেস্টুরেন্ট' নামের তাদের ভাইদের আরেকটি হোটেল ছিল। স্বাধীনতার পূর্বে লালবাগে এটি বেশ বিখ্যাত ছিল। একসময় নান্না মিয়া ও তার বন্ধু পেয়ার বাবুর্চি সিদ্ধান্ত নিলেন তারা বিরিয়ানি রান্না করে সেটি বিক্রি করবেন। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল আজকের জনপ্রিয় নান্না বিরিয়ানির ব্যবসা। নান্না বিরিয়ানি যখন বেচারাম দেউড়ির সরদার ভবনে সরিয়ে আনা হয়  স্থানান্তর করা হয় তখন সেখানে মোরগ পোলাও ও খাসির বিরিয়ানি বিক্রি করা হতো। সম্প্রতি তারা তাদের মেনুতে খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি সংযোজন করেছেন।

"নান্না মিয়ার বিরিয়ানির সুখ্যাতি ঢাকা ও সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে বন্ধু ও পরিবার নিয়ে খেতে আসতে শুরু করে। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি থেকে মানুষ নিয়মিত আসতো আমাদের বিরিয়ানি খেতে। এমনকি ঢাকার বাইরে থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য প্রচুর অর্ডার আসতো", বলেন আবদুল্লাহ।

নান্না মিয়ার মোরগ পোলাওয়ের নাম শুনলেই অনেকের জিভে জল চলে আসে- এটি তৈরি করা হয় বিভিন্ন রকমের মসলা মাখানো মুরগির মাংস ও বাদামি করে  ভেজে নেওয়া পেঁয়াজ বাটা দিয়ে।  কিন্তু বাংলাদেশের আরও বিরিয়ানি থাকতে কেন হাজী নান্না বিরিয়ানিই এতো বিখ্যাত! এই বিরিয়ানিতে কি এমন স্বাদ আছে একে ঢাকার হাজারো বিরিয়ানির দোকান থেকে আলাদা ও জনপ্রিয় করে তুলেছে?

আবদুল্লাহ জানান, "আমাদের খাবারের স্বাদ ও মান একটুও পরিবর্তন হয়নি, যার ফলে আমরা এতো বছর ধরে সুনামের সাথে ব্যবসা করে যেতে পেরেছি। আমাদের নান্না বিরিয়ানি থেকে প্রতি মাসের ৫ তারিখ বিশেষ আয়োজনের ব্যবস্থা থাকে, যেদিন আমরা পোলাওয়ের সাথে আস্ত একটা মুরগি দিয়ে থাকি"।

২০০৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নান্না মিয়া নিজ হাতে তার রান্না করা সুস্বাদু পোলাও মানুষকে খাইয়েছেন। বর্তমান বাবুর্চির নাম প্রকাশ না করলেও আবদুল্লাহ বলেন, "যারা এখন নান্না বিরিয়ানিতে রাঁধেন তাদের প্রত্যেকেই নান্না মিয়ার কাছ থেকে বিরিয়ানি রান্না শিখেছেন। নান্না মিয়ার সাথে যারা রান্নার কাজে সহযোগিতা করতো তারাই এখন নান্না বিরিয়ানিতে আমার তত্ত্বাবধানে রান্নার কাজটা দেখে থাকেন। নান্না বিরিয়ানির ৭টি শাখা আমাদের আত্মীয়রা মিলেই দেখাশোনা ও পরিচালনা করছে। কোনো শাখা আমার ভাই, আবার অন্যগুলো আমার চাচাতো ভাইয়েরা মিলে দেখাশোনা করছে"।

করোনার সময় যখন সরকারিভাবে সকল রেস্টুরেন্ট ও খাবার দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয় তখন হাজী নান্না বিরিয়াজকেও তার দোকানগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সে সময় তাদেরও বড় অংকের লোকসান গুনতে হয়।

প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নান্না বিরিয়ানির ভবিষ্যত পরিকল্পনা ঢাকার মধ্যে আরো অধিক শাখা খোলা এবং মানুষের বসার ব্যবস্থা উন্নত করা। মাত্র দুই মাস আগেই নান্না বিরিয়ানির প্রধান শাখা বেচারাম দেউড়ির দোকানটিকে আধুনিক ডিজাইনে একেবারে ঢেলে সাজানো হয়েছে।

আবদুল্লাহর কথায়, "নান্না মিয়া যেভাবে বিরিয়ানি রান্না করতেন, সেই একই স্বাদ বজায় রেখে এবং মানুষকে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আমরা নান্না মিয়ার শুরু করা বিরিয়ানির সুখ্যাতি ধরে রাখতে চাই"।  
 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.