‘সুবোধ’ আবার হাজির ঢাকার দেয়ালে!

ফিচার

31 March, 2022, 10:20 pm
Last modified: 01 April, 2022, 12:52 am
সম্প্রতি হবেকির সুবোধ আবার হাজির হয়েছে মিরপুর সিরামিকসের দেয়ালে। পুরো কালো পটভূমিকায় নীল চোখের আহত এক নারী, দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

শিল্পীর নাম কি? কেউ জানে না, প্রতিটি ছবিতে লেখা থাকে; হবেকি। এটাই কি শিল্পীর নাম? যে শিল্পী ও তার ছবির কথা নিয়ে অলোচনা হচ্ছে তার চরিত্র- সুবোধ। একজন উদ্ভ্রান্ত, এলোমেলো, প্রায় ছিন্নবস্ত্রের যুবক। কিন্তু ভীষণ রকম সাহসী, বিদ্রোহী যুবার প্রতিমূর্তিও যেন। এই সুবোধ বাংলাদেশের। প্রথম যখন ঢাকার মানুষ সুবোধকে দেখল দেয়ালে- ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সুবোধ দৌড়ে যাচ্ছে, সুবোধ পেছন ফিরে দেখছে, সুবোধ খাঁচায় বন্দি। দৌড়ানো সুবোধের গ্রাফিতিতে লেখা: সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় তোর পক্ষে না। আরেক গ্রাফিতিতে লেখা: সুবোধ তুই পালিয়ে যা তোর ভাগ্যে কিছু নেই।

আরেক গ্রাফিতিতে এরকম একটা লোহার খাঁচা থেকে ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছে, লেখা:

এখানে সাপ ভরা চাপ চাপ রুচি!

কাপ ভরা পাপ পা চা!

সুবোধ… তুই পালিয়ে যাহ্‌।

কারণ মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে, মানুষের মনে পাপবোধ নিশ্চিন্তে বসবাস করছে। 

ঢাকার মিরপুর, মহাখালী, আগারগাঁওয়ের দেয়ালে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে হবেকির দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতি দেখা গেছে। কেন কারা করছে, কি বোঝাতে চাইছে?- এসব নানা প্রশ্ন মানুষের মনে উঁকি দিয়েছে। তারা যেন এসব গ্রাফিতিতে সে সময়ের প্রতিফিলন দেখেছেন। সুবোধকে দিয়ে রহস্য কোন শিল্পী মানুষকে বার্তা দিচ্ছেন! সুবোধ তাই ব্যাপক আলোচনারও জন্ম দিয়েছে।

দারুণ অঙ্কনশৈলি আর সময়োপযোগিতার কারণে শিল্পীকেও ভালোবেসেছেন মানুষ। ফেসবুকে হবেকি গ্রাফিতি ফ্যানস নামের পেইজে যেমন মির্জা শহীদুল ইসলাম লিখেছেন, 'ইউ আর দ্য রেভুলুশন অব আওয়ার আনস্পোকেন ইমোশনস (তুমি আমাদের অব্যক্ত আবেগের বিপ্লব)। আমরা তোমাকে চিরদিন মনে রাখবো, ভালবাসবো তোমার শিল্পকে, দোয়া করব তোমার মতো হাজারো লাখো সুবোধ এ দেশে জন্মাক। ভালো থেক।'  

সুবোধকে নিয়ে ইনডালো নামের গানের দল একটি গান বেঁধেছে। কথাগুলো এমন:

হবে কি না হবে কে জানে সুবোধ?
সময় হয়তো এখন পক্ষে না

রাত জেগে যারা ছিল ভোরের অপেক্ষায়
সিলিং-এ ওদের শরীরে সূর্যের দাগ

পালিয়ে কেউ কি বাঁচে?
পড়ে থাকবে সময়ের এ্যাশট্রে

ঘুরে দাঁড়াও সুবোধ তুমি
হেলে পড়া মানবিক দেয়ালে

আবারো ফিরবে তুমি
তিরোহিত সুতীব্র সূর্যের সাথে

ফেরারি দেয়ালে আমরা আছি
এখনো অপেক্ষায় কান পেতে

ব্যথা পাও, ভুলে যাও খাতা ভরা শূন্য
তবু খাতা ভরা পাতা লিখ- কার জন্য?

এদিকে সুবোধের অনুপ্রেরণা দেশ ছেড়ে, অন্যদেশেও পাড়ি দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনের দেয়ালে গ্রাফিতি দেখা গেছে, তাতে সুবোধের বুক বরাবর লাল সুর্যের বিকিরণ, পাশে লেখা সুবোধ তুই তৈরি হ। মাঝখানে একটা বিরতি গেছে। যেন সুবোধ তুই পালিয়ে যা সময় তোর পক্ষে না- এ শিক্ষাকেই বাস্তবতা দিতে। সুবোধ কিন্তু আবারো ফিরেছে। গেল ফেব্রুয়ারিতে আবার আলোচনায় এসেছে সুবোধ। ওই সময় সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন চলছে। তখনই আন্দোলনে সহমত জানাতেই যেন সিলেটের দেয়ালে দেখা গেল হাস্যোজ্জ্বল, টেলিফোনে কথা বলা এক সুবোধকে। সিলেটের দেয়ালে ওই সময় সুবোধের হাজির হওয়াকে- অনেকেই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গেই যোগ করে দেখেছেন।

সম্প্রতি হবেকির সুবোধ আবার হাজির হয়েছে মিরপুর সিরামিকসের দেয়ালে। পুরো কালো পটভূমিকায় নীল চোখের আহত এক নারী, দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানাচ্ছে। নারীর খোলা চুলে একটি ফুলও শোভা পাচ্ছে। আর্ট এজেন্সি- আর্টকন জানাচ্ছে, ইউক্রেনের মাদারল্যান্ড মন্যুমেন্টের সঙ্গে এর যোগ আছে- তা স্পষ্ট। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ ভাস্কর্য ৩৩৫ ফুট উঁচু। ইউক্রেনের ইতিহাস বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত এটি।  

সুবোধ গ্রাফিতির অজ্ঞাত শিল্পীর মূলমন্ত্র হলো, 'দি বিউটিফুল পেইন্টিংস আর দোজ হুইচ স্পিক অব দ্য আগলিয়েস্ট'। গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্রের আরেকটা নাম আছে 'আউট-ল আর্ট'। এর  ইতিহাস বহু বিস্তৃত এবং প্রাচীন। মিশর, থেকে গ্রিস তথা পশ্চিমা দেশগুলোতে শিল্পের এ মাধ্যমটি খুবই জনপ্রিয়। 

আউট ল আর্টে বলা হয়, সমসাময়িক রাজনৈতিক সামাজিক সংকটের কথাই। হবেকি গ্রাফিতি ফ্যানস পেজে যেন শিল্পী নিজেই বলছেন, হবেকি হ্যান্ডেল থেকে: কিছু বিষয় জানাবার প্রয়োজন বোধ করছি। অসংখ্য মানুষ জানিয়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার নামে অজস্র প্রোফাইল রয়েছে, যার কোনটাই আমার নয়। কিন্তু আমি সবাইকেই ভালোবাসি। কিছু কথা বলতে চাই, খ্যাতি-বিখ্যাতির পরোয়া করি না। সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালের মারপ্যাঁচ খুব একটা বুঝি না। বাস্তবের দেয়ালই শ্রেয়তর। সেটাই হবেকির আসল ঠিকানা। আর ইন্টারনেটে এটাই হবেকির একমাত্র ফেইক প্রোফাইল! শুধুমাত্র প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য। অনুগ্রহ করে আমাকে বৃথা খুঁজবেন না। আমি নই, আমার শিল্প গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তার দেয়ালে আমার ছবিকে খুঁজুন। বুঝবার চেষ্টা করুন। হবেকি কখনই সামনে আসবে না। সুবোধ কে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই না। পরবর্তী ছবিগুলো উপভোগ করুন। উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট, একুশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প আন্দোলনের জন্ম দেওয়া।

তাহলে কি 'হবেকি' শিল্পীর নাম? এই নাম কি আরেকজন কিংবদন্তীতে পরিণত হওয়া শিল্পীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? ব্যাঙ্কসি যার নাম।

ব্যাঙ্কসি কথা মনে পড়ে

যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত স্ট্রিট পেইন্টার বা এই আউট ল আর্টিস্ট ব্যাঙ্কসি। তিনি স্টেনসিল (ছিদ্রময় পাত, ব্যবহৃত হয় লেখা বা আঁকার জন্য ) ব্যবহার করে আঁকেন। হবেকিও স্টেনসিল ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতিতে স্প্রে করে দ্রুত আঁকার কাজ করা যায়। যাতে কেউ শিল্পীকে দেখে না ফেলে। ব্যাংকসি প্রথম নজর কাড়েন তার নিজের শহর ব্রিস্টলে নব্বইয়ের দশকের গোঁড়ায়। 

ব্যাঙ্কসি নামটিও ছদ্মনাম। জানা যায়, তিনি একজন অ্যাক্টিভিস্ট এবং চলচ্চিত্রকারও। তবে সুনির্দিষ্টভাবে তাকেও চিহ্নিত করা যায়নি আজপর্যন্ত (যদিও রবিন গানিংহাম নামের একজনকে ব্যাঙ্কসি বলে ধরা হয়, কিন্তু নিশ্চিত হয়ে নয়)। গ্রাফিতি বা স্ট্রিট আর্টের ব্যাপারে রাষ্ট্রের আপত্তি থাকে প্রায়শ। তাই শিল্পী নাম লুকালে, তার কাজে সুবিধা হয়। হবেকির কাজের ধরন দেখে মনে হয়, তিনি ব্যাঙ্কসির কাজ গভীরভাবে দেখেছেন। ব্যাঙ্কসির ধরনে তিনিও ব্যবস্থার পরিবর্তন চান। কিন্তু কোন ব্যবস্থা? যুদ্ধ জিইয়ে রেখে, মিথ্যার সঙ্গে মিতালী করে, অত্যাচারীকে প্রশ্রয় দেয়া- দুর্নীতি পোষে যে ব্যবস্থা- সে ব্যবস্থারই বদল চান সুবোধের শিল্পী। যে দিনবদল অচেনা থাকা, আড়ালে থাকা শিল্পীর জন্য তো বটেই, পরিবর্তনকামী আর সকলের জন্যও ভালো।

যুদ্ধবিরোধী নতুন গ্রাফিতিটি নিয়ে

ফেসবুকের গ্রাফিতি ফ্যানস পেইজে আবার হাজির হয়েছেন। হবেকি'র দাওয়াত পাওয়া যাচ্ছে এখানে, তিনি বলছেন-

প্রিয় বন্ধুরা,

আমার ভালো লাগছে তোমাদের জানাতে যে, মিরপুর বারোর দিকে যেতে সিরামিকসের (নির্মাতা উপকরণ প্রতিষ্ঠানের) একটি দেয়াল আমি নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছি, যেখানে একটা নতুন শিল্প তৈরি করেছি। এখনো সেটা শোভা পাচ্ছে, আর এটা ভণ্ডুলকারীদের খপ্পরে পড়ার আগেই তোমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি সাদা-কালো চিত্রটি দেখে আসার।

ভালোবাসাসহ

হবেকি

আরেক পোস্টে হবেকির তরফে বলা হয়: মিরপুরের ছবিটা মূলত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হলেও, সেটা আমি মূলত ধর্ষণের জন্যে এঁকেছিলাম। পরে চোখে ব্লাক কালার সেঁটেছি। কিছু চেঞ্জ করেছি আরকি। এটা যেকোনো ভায়োলেন্সকে বোঝাতে পারে। আনমিউট করছে। শব্দ করতে চাইছে। প্রতিবাদ এবং ফুল আছে। ব্লাক খারাপ সময়কে বোঝাচ্ছে, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জনপদকে বোঝাচ্ছে, অস্থির সময়কে বোঝাচ্ছে। বোমারু বিমানগুলো আর ড্রোন রাতে এটাক করে। সারা বিশ্বের যুদ্ধাবস্থার বিরুদ্ধে আঁকা বলা যেতে পারে। ইউক্রেনের কিয়েভের একটা ভাস্কর্য আছে, সেটাও বলতে পারেন, আবার গডেস অব আনমিউটও বলতে পারেন। এটার মাল্টিপল ইন্টারপ্রেটেশন আছে। আমি সিংগেল অর্থ দিয়ে ক্লিয়ার করি না। এটাই আমার ধারণা, আমার ব্যাখ্যা।  

২০১৭ সালের দিকে সুবোধের গ্রাফিতি উদয় হয় ঢাকার দেয়ালে। সুবোধ বর্তমান সময়কে ধারণ করে। সে আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে চায়। সময়ের বদল চায়।

বিভিন্ন সুবোধ গ্রাফিতিতে যেসব কথা বলা হয়েছে:

১. সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই ( খাঁচাবন্দী সূর্য নিয়ে কপালে হাত রেখে বসে পড়েছে সুবোধ)

২. সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না (হলুদ সূর্য খাঁচায় বন্দি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে সুবোধ)

৩. সুবোধ তুই পালিয়ে যা, ভুলেও ফিরে আসিস না! (খাঁচাবন্দী সূর্যটাকে তুলে ওঠানোর ভঙ্গিতে সুবোধ)

৪. সুবোধ, কবে হবে ভোর? (একটা বাচ্চা মেয়ে জিজ্ঞেস করছে সুবোধকে)

৫. সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে (জেলের গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে সুবোধ)

৬. সুবোধ তুই ঘুরে দাঁড়া (খাঁচায় লাল সূর্য নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সুবোধ)

৭. সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না, মানুষ ভালবাসতে ভুলে গেছে! (খাঁচাবন্দী সূর্য নিয়ে কোথাও চলেছে সুবোধ, ক্ষণিকের তরে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছে)

উল্লেখ্য গ্রাফিতিগুলো ২০১৭ সালেই ব্যাপকভাবে নজর কাড়ে। ঢাকার আগারগাঁও, মহাখালী ও পুরাতন বিমানবন্দরের দেয়ালেই সুবোধ গ্রাফিতি দেখা গিয়েছে বেশি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনলাইন ডেস্ক ২০১৭ সালের অক্টোবরে জানিয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থার চৌকস টিম সুবোধের রূপকারদের খুঁজতে মাঠে কাজ করছে। তারা মনে করছে, সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ চক্র এমন গ্রাফিতির জন্ম দিয়েছে। 

একই প্রতিবেদনে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, শিক্ষা, রাজনীতি, মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের অগণতান্ত্রিকতা এবং গণবিরোধিতার প্রতি ইঙ্গিত করেই এগুলো প্রচার করা হচ্ছে বলে আমার ধারণা।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.