কেন হারিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুতুড়ে ঘোড়ামাছ? 

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
30 March, 2022, 01:45 pm
Last modified: 30 March, 2022, 01:56 pm
ঘোড়ামাছের এত চাহিদার পেছনে যথাযথ কারণও রয়েছে। বিভিন্ন প্রাণীর এক অসাধারণ মিশ্রণ বলা যায় একে। ঘোড়ার মতো মাথা, গিরগিটির মতো চোখ, ক্যাঙ্গারুর মতো থলি, বানরের মতো লেজ- ঘোড়ামাছকে কাল্পনিক প্রাণী মনে করলেও ভুল হবেনা কারো।

সি হর্স বা ঘোড়ামাছ। বেশিরভাগ মানুষই প্রাণীটিকে এর বিশেষ এক ক্ষমতার জন্য চেনে। প্রায় সবক্ষেত্রেই স্ত্রী-জাতের প্রাণীদের সন্তান ধারণ করতে দেখা গেলেও ঘোড়মাছের বেলায় একদমই ভিন্নচিত্র দেখা যায়।

অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশের সমুদ্র উপকূল বৈচিত্র্যময়ী এই মাছের দেখা মেলে। এ পর্যন্ত সি হর্সের ৪৬টি প্রজাতির খোঁজ পাওয়া গেছে; যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট জাতের আকার একটি বাটার বিনের সমান এবং সবচেয়ে বড় জাতের আকার মোটামোটি একটি বেসবল গ্লাভসের সমান।

তবে, এই মাছের প্রজাতির সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। এইতো গেল দশকেই ঘোড়ামাছের চারটি নতুন প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে।

পর্তুগালের অ্যালগারভস সেন্টার ফর মেরিন সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী মিগেল কোরিয়া জানান, আলগারভে অঞ্চলের রিয়া ফর্মোসা উপকূলে প্রায় দুই মিলিয়ন ঘোড়ামাছের বসতি ছিল। কিন্তু, বেশ কয়েক বছর ধরেই কমতে থাকে এদের সংখ্যা।

মিগেল ও তার সহকর্মীরা এই অঞ্চলে পাওয়া দুটি প্রজাতি: Hippocampus guttulatus এবং Hippocampus hippocampus এর উপর গবেষণা চালিয়ে এ চিত্র দেখতে পান। "আমরা ২০ বছরেরও কম সময়ে এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশ ঘোড়ামাছ হারিয়েছি," বলেন তিনি।

ছবি- সংগৃহীত

তবে, ঘোড়ামাছের সংখ্যা কমে আসা এবারই প্রথম নয়। মূলত, এই প্রাণীদের আবাসস্থলের প্রকৃতির কারণে এমনটি হতে দেখা যায়। সমুদ্রের মোহনা, ম্যানগ্রোভ, সিগ্রাস বেড এবং প্রবাল প্রাচীরসহ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্গম সামুদ্রিক অঞ্চলে এসব প্রাণীদের বাস করতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় রিয়া ফরমোসার কথাই। খড়ম চাষ থেকে শুরু করে বেআইনি ট্রলিং- এসব বিভিন্ন কারণে এ অঞ্চলের সিগ্রাস বেড নষ্ট হয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘোড়ামাছের স্বাভাবিক আবাসস্থল।

সামুদ্রিক এই প্রাণীর সংখ্যা দিনদিন কমে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাছ ধরা। বাড়িতে থাকা অ্যাকুরিয়ামের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বহুল ব্যবহৃত হয় ঘোড়ামাছ। মূলত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকুরিয়ামের বাজারে রয়েছে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এছাড়া, চীনেও ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য ঘোড়ামাছ বিক্রি হয় প্রচুর পরিমাণে।

ছবি- ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

ঘোড়ামাছের এত চাহিদার পেছনে যথাযথ কারণও রয়েছে। বিভিন্ন প্রাণীর এক অসাধারণ মিশ্রণ বলা যায় একে। ঘোড়ার মতো মাথা, গিরগিটির মতো চোখ, ক্যাঙ্গারুর মতো থলি, বানরের মতো লেজ- ঘোড়ামাছকে কাল্পনিক প্রাণী মনে করলেও ভুল হবেনা কারো।

এমনকি এই প্রাণীগুলোর রঙও বেশ বৈচিত্র্যময়। এদের দেহে রয়েছে প্রচুর বাম্প, স্ট্রাইপ এবং স্পেকেলস বা তিল এবং কাঁটা। ঘোড়ামাছের দেহে আঁশের পরিবর্তে থাকে হাড়ের প্লেট। খাদ্য সঞ্চয়ের জন্য প্রাণীগুলোর কোনো পেট না থাকায় এদেরকে সবসময়ই কোপেপড, চিংড়ি, মাছের লার্ভা এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র খাদ্যদ্রব্য চুষে খেতে দেখা যায়।

এই শিকারী সামুদ্রিক প্রাণীরা কিন্তু এক ধরনের নর্তকীও বটে। জুটি বাঁধার সময় ঘোড়ামাছ রঙ পরিবর্তনের মাধ্যমে একে অপরকে আকৃষ্ট করে থাকে। তাদের যোগাযোগের আরও একটি মাধ্যম হলো লেজ। এক জোড়া ঘোড়ামাছ মূলত লেজের মাধ্যমে আলিঙ্গন করে। সামুদ্রিক ঘোড়াদের এই নৃত্য কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। জুটি বাঁধার পর এক জোড়া ঘোড়ামাছ পুরো মৌসুম জুড়েই একসাথে থাকতে দেখা যায়।

ছবি- ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

প্রাণীজগতে ঘোড়ামাছ একটি বিশেষ জায়গা ধারণ করে আছে এর প্রজননগত ভিন্নতার কারণে। অন্যান্য বেশিরভাগ প্রাণীর মতো নারী ঘোড়ামাছরা বাচ্চার জন্ম দেয়না, বরং পুরুষরাই বাচ্চা নিজেদের গর্ভে ধারণ করে এবং জন্ম দেয়। নারী ঘোড়ামাছ তার ট্রাঙ্কে থাকা ওভিপজিটর নামক একটি সরু পথ দিয়ে তার কুসুম সমৃদ্ধ ডিম পুরুষ ঘোড়ামাছের পেটের থলিতে জমা করে। এর বেশ কয়েক সপ্তাহ পর পুরুষটি কয়েক ডজন থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত বাচ্চার জন্ম দেয়।

সদ্য জন্ম নেওয়া বংশধরদের মধ্যে বেশ কম সংখ্যকই প্রাপ্তবয়স্ক ঘোড়ামাছে রূপান্তরিত হতে পারে। বাকিগুলো সমুদ্রের শিকারীদের খাদ্যে পরিণত হয়।

ছবি- সংগৃহীত

ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া (ইউবিসি) এর সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী আমান্ডা ভিনসেন্ট বলেন, "ঘোড়ামাছের বেশিরভাগ প্রজাতিরই শ্রেণীবিন্যাস এবং মৌলিক বর্ণনা ছাড়া আর কিছুই আমরা জানিনা।"

ঘোড়ামাছ নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণেই মূলত এ অবস্থা বলে জানিয়েছেন তিনি। দিন দিন এই বিরল প্রাণীটির সংখ্যা কমতে থাকলেও সম্প্রতি বেশ কিছু দেশ ঘোড়ামাছ বাঁচাতে উদ্যোগ নিয়েছে।

২০১৯ সালে পেরুর লিমাতে একটি এশিয়া-গামী জাহাজ থেকে ১২ মিলিয়নেরও বেশি শুকনো ঘোড়ামাছ বাজেয়াপ্ত করা হয়। এছাড়া, ২০২০ সালে পর্তুগিজ সরকার ঘোড়ামাছের অভয়ারণ্য হিসাবে কাজ করার জন্য রিয়া ফরমোসার মধ্যে দুটি ছোট সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা তৈরি করে।

ছবি- সংগৃহীত

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঘোড়ামাছকে টিকিয়ে রাখার জন্য মূলত প্রয়োজন আরও ভালো মৎস্য ব্যবস্থাপনা, কঠোর সীমাবদ্ধতা এবং এমনকি ট্রলিং নিষিদ্ধ করা।

এই প্রণোদনাগুলো কার্যকর রাখার উপর গুরুত্ব দেন গবেষকরা। তা নাহলে আমরা শীঘ্রই ঘোড়ামাছবিহীন এক পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বলে সতর্ক করেন তারা।

  • সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.