৬০ বছর ধরে আঁকিয়ে আর স্থাপত্যবিদদের কেন প্রিয় 'মডার্ণ স্টেশনারি'

ফিচার

22 March, 2022, 05:20 pm
Last modified: 22 March, 2022, 07:30 pm
মডার্ণ স্টেশনারির যাত্রা শুরু ১৯৬৩ সালে, পাকিস্তান আমলে। তারপর কেটে গেছে ছয়টি দশক। কিন্তু এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মডার্ণের দোকান।
ছবি-শাবনুর আক্তার নীলা

কেউ চাইছেন রংতুলি, কেউবা  ক্যানভাস, এক্রিলিক কালার, আবার কারো চাওয়া মেকানিকাল পেন্সিল ও অন্যান্য সরঞ্জাম। নিউমার্কেটের এককোণের মডার্ণ  স্টেশনারির দোকানে এভাবেই সবসময় ক্রেতাদের সমাগম দেখা যায়। ২টি দোকান মিলে মোট ১২ জন কর্মী কাজ করলেও দোকানে আসা ক্রেতার সংখ্যা এতো বেশি থাকে যে, দোকানিদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় সামাল দিতে। 

মডার্ণ স্টেশনারিতে ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। দেখলাম তিনি একাই দোকানের সব ক্রেতাদের সামাল দিচ্ছেন। কে কি চাইছে, কোনটা কী পরিমাণ লাগবে, কোনটার কতো দাম ও মানে কোনটার কী পার্থক্য সব যেন একাই দুহাতে হিসাব-নিকাশ করে ফেলছেন। এই বয়সেও এতো সপ্রতিভ, এবং দ্রুত কাজ করতে পারছেন তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে।

ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, "আমার দাদা ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের মালিকের মায়ের আত্মীয়। সেই সূত্রে আমার এখানে কাজ করা শুরু। তারপর কীভাবে যে এত বছর কেটে গেছে, টের পাইনি। আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন মালিকের ছেলেরা সবে এই ব্যবসার দায়িত্ব নিতে শুরু করেছে। এতগুলো বছর ধরে থাকায়, তাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছি।"

মডার্ণ স্টেশনারির যাত্রা শুরু ১৯৬৩ সালে, পাকিস্তান আমলে। তারপর কেটে গেছে ছয় দশক। কিন্তু এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মডার্ণের দোকান। ৬০ বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মজিবুল হক শুরু করেছিলেন ব্যবসা। বর্তমানে তার দুই ছেলে, মাহাবুবল হক ও তার ছোটভাই আবদুল্লাহ আল মামুন ব্যবসার যাবতীয় দেখভাল করছে। তার মোট ৬ ছেলে ও ৫ মেয়ে থাকলেও বাকিরা নিজেদের মতো অন্য ব্যবসা করেন, আবার কেউ কেউ দেশের বাইরে থাকেন। কিন্তু এই দুইভাই এখনো বাবার ব্যবসা আঁকড়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

শুরুর দিকে মজিবুল হকের আরও একটি ব্যবসা ছিল পুরান ঢাকার চকবাজারে। সেখানে তার পাইকারি পেপারের কারখানা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী সেই কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজিবুল হকের পেপারের কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তিনি মডার্ণ স্টেশনারির ব্যবসা বড় করেন এবং নিউমার্কেটে যেখানে তার দোকান, তার পাশেই ১৯৮৫ সালে আরেকটি দোকান ভাড়া নেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মডার্ণ স্টেশনারির দুটি দোকান চলছে সমানতালে।

ছবি- শাবনুর আক্তার নীলা

এই দোকানে পা পড়েছে দেশের বরেণ্য সব আঁকিয়ে, স্থাপত্যবিদের। মডার্ণ তাদের আঁকার, স্থাপত্য ড্রয়িংয়ে সব উপাদান, সরঞ্জাম সরবরাহ করে এসেছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। নিউমার্কেটের পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শাহনেওয়াজ হল। বছরের পর বছর নতুন পুরাতন সব ছাত্র-ছাত্রী রংতুলি আঁকার যে কোনো কিছুর জন্য ছুটে আসেন এখানে।

মডার্ণে পাওয়া যায় না, ফিরে গেছেন অমুক রং না পেয়ে, কাগজ না পেয়ে এরকম ঘটনা কম।

মডার্ণের বেশিরভাগ কর্মীই ওমর ফারুকের মতো অত পুরনো না হলেও অনেক বছর ধরে এখানে কাজ করছে। দোকান মালিক মামুন জানান, "এরা আমাদের খুব বিশ্বস্ত কর্মী, তাই এতো বছরেও তাদেরকে বদল করিনি। আমাদের আশেপাশের অনেক দোকান মালিক ও ব্যবসা পরিবর্তন হয়ে গেলেও আমি আর আমার বড়ভাই আমাদের দোকানটি ভাড়া না দিয়ে এখনো নিজেরাই চালাচ্ছি।"

ছবি- শাবনুর আক্তার নীলা

কী পাবেন এক দোকানে

মডার্ণ স্টেশনারিতে ড্রয়িং, ফ্যাশন ডিজাইন ও স্থাপত্য প্রকৌশলীর সকল সরঞ্জাম পাওয়া যায়। দোকান দুটির আয়তন খুব বেশি না হলেও, ঠাসাঠাসি করে ও দেয়ালে তাক করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সবরকম আর্টের সরঞ্জাম। আর যেগুলো বড় সরঞ্জাম রয়েছে যেমন- ক্যানভাস, উডেন ইজেল, শীট পেপার হোল্ডারের মতো আকারে বড় ও রাখতে বেশি জায়গা লাগে- সেগুলোকে দোকানের বাইরে দাঁড় করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

সেখানে দেখতে পেলাম বিভিন্ন সাইজের ও শেপের ক্যানভাস। দোকানিদের একজন জানালো বিভিন্ন সাইজের ক্যানভাসের জন্য দামের তারতম্য কেমন হয় সে বিষয়টি। ৪ বাই ৪ ক্যানভাসের দাম পড়বে ৪০ টাকা, ৫ বাই ৫ হবে ৫০ টাকা এবং ৬ বাই ৬ ক্যানভাসের জন্য তা হবে ৭০ টাকা করে। এভাবে সাইজের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিটির জন্য ১০-২০ টাকা করে বৃদ্ধি পাবে। দোকানে ক্যানভাস কিনতে আসা একজন ক্রেতার ৪০ বাই ৪০ সাইজটি প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সাইজটি আগের থেকে দোকানে বানিয়ে রাখা ছিল না তাই তাকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিতে হয়। ৪০ বাই ৪০ ক্যানভাসটির মূল্য পড়েছিল ৭৫০ টাকা। দোকানী ওমর ফারুক জানালেন, "অনেক মাল আমরা জায়গা স্বল্পতার জন্য দোকানে রাখতে পারিনা। সামনেই কিছুটা দূরে আমাদের গোডাউন মতো স্টোর রুম রয়েছে, সেখানে আমরা বড় সাইজের মালামাল রাখি। কোন ক্রেতা চাইলে সেখান থেকে এনে দেই।"

ছবি- শাবনুর আক্তার নীলা

মডার্ণ স্টেশনারিতে আপনি খুঁজে পাবেন ড্রয়িং খাতা, ওয়াটার কালার খাতা ও বই, জলরঙ, এক্রিলিক কালার, খাতা-কলম, আর্ট টিস্যু পেপার, বিভিন্ন সাইজের রংতুলি ও ব্রাশ। স্কেচ নোটবুক পাওয়া যায় যেগুলোর ওপরে স্কেচ করা বিভিন্ন রকম ডিজাইন ও ছবি থাকে এবং উপরে প্রতিষ্ঠানটির লোগোসহ মডার্ণ স্টেশনারি নামটি বড় করে দেয়া। সবচেয়ে ছোট স্কেচ বুকের দাম পড়বে ৪০ টাকা এবং বড়গুলোর দাম ১৩০টাকা করে। মডার্ণ স্টেশনারিতে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি পণ্যটি হচ্ছে- জাপানিস ভিম কম্পাস, যার একেকটির বর্তমান মূল্য ২৫ হাজার টাকা।

এছাড়াও আর্টের জন্য হ্যান্ডমেইড পেপার কাগজ পাওয়া যায়। আগে মডার্ণ এই হ্যান্ডমেইড পেপার ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করতো। বর্তমানে দেশে তৈরি হওয়া  হ্যান্ডমেইড পেপার বিক্রি করা হয় দোকানটিতে। ময়মনসিংহের  মুক্তাগাছা ও ফেনীতে এই হ্যান্ডমেইড পেপারের কারখানা রয়েছে, যেখান থেকে পেপার এনে দেয় প্রকৃতি হ্যান্ডমেইড পেপার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই দোকানটি আসাদগেটে অবস্থিত, তারা সরাসরি কারখানা থেকে হ্যান্ডমেইড পেপার এনে মডার্ণ স্টেশনারিকে সরবরাহ করে থাকে। ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করা হ্যান্ডমেইড পেপার ও দেশে তৈরি হওয়া পেপারের মধ্যে কী পার্থক্য জানালেন দোকানটির বর্তমান মালিক আল মামুন।

মামুন বলেন, "ইন্ডিয়া থেকে আনা হ্যান্ডমেইড পেপারগুলো মোটা হতো আর সেগুলোর ফিনিশিং ভালো ছিল। আমাদের দেশে তৈরি পেপার সে তুলনায় অনেকটা পাতলা হয়। কিন্তু বর্তমানে দাম বেড়ে যাওয়ায় ঐ পেপার বিক্রি করতে গেলে ক্রেতারা অতিরিক্ত দামে কিনতে নারাজ হয়ে যায়। তাই বর্তমানে আমরা ইন্ডিয়া থেকে হ্যান্ডমেইড পেপার আমদানি করি না।"

ছবি- শাবনুর আক্তার নীলা

ক্রেতাদের আস্থায় মডার্ণ স্টেশনারি

সোমা সুরভি পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার 'ড্রয়িং এ্যান্ড পেইন্টিং' বিভাগে। অন্যান্য ক্রেতাদের মতো তিনিও মডার্ণে এসেছেন আর্টের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। আশেপাশে আরও কিছু স্টেশনারির দোকান থাকলেও এখানে কেন এসেছেন জানতে চাইলে সুরভি বলেন, "আমি আগে আজিজ মার্কেটে যেতাম, কিন্তু সেখানে সবকিছু পাওয়া যায় না। আবার আশেপাশে দোকানগুলো রেখে এখান থেকে কিনতে আসার কারণ হচ্ছে, এখানে একসাথে আমি সবকিছু পাচ্ছি আর তাদের পণ্যের মান খুব ভালো। মানের দিক বিবেচনা করেই আমার এখানে আসা হয় সবসময়। আবার কোন কিছু নিয়ে সমস্যা হলে এখানে আসলে তারা সেটা পরিবর্তন করে দেয় যা অন্য কোথাও দিতে চায় না।"

সুরভির মতো মডার্ণের বেশিরভাগ ক্রেতাই পুরনো। আরেকজন ক্রেতা জানালেন তিনি বেশ কয়েকবছর ধরে এখান থেকে পণ্য কেনেন। মডার্ণে আসা ক্রেতাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। বুয়েট, ব্র‍্যাক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখান থেকেই তাদের ড্রয়িং ও ইঞ্জিনিয়ারিং আর্টের সরঞ্জাম কিনতে আসে। দোকানদার ফারুক জানান, "আমাদের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় সবসময় থাকলেও বেশি বিক্রি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হলে। নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা তখন কিনতে আসে, আর যখন তারা দেখে এক দোকানে সব পাচ্ছেন-তখন থেকে নিয়মিত আমাদের কাছেই আসতে থাকেন।"

ছবি-ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

ব্যবসায় মন্দা

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মডার্ণ স্টেশনারিকে গুনতে হয়েছিল বিপুল লোকসান যা তাদের এখনো টানতে হচ্ছে। লকডাউনে বিশ্ববিদ্যালয়, দোকান বন্ধ রাখা হলেও তাদেরকে দোকান ভাড়া ও ট্যাক্স নিয়মিত প্রদান করতে হয়েছিল। আবার করোনার প্রভাবে অন্য দেশগুলোতে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত কন্টেইনার ভাড়া দিতে হয়েছে। ফলে কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তা কিনতে অনেক ক্রেতাই আগ্রহী ছিল না।

ব্যবসায়ী মামুন জানান, "আগে যেখানে কন্টেইনার ভাড়া ৪ হাজার ডলার ছিল, করোনার সময় সেটি হয়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ডলার। বর্তমানে আমাদের বেশিরভাগ পণ্য চীন থেকে আমদানি করা হয়। চীনের পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে। আর মানের দিক থেকে সেগুলোর ফিনিশিংও অনেক ভালো হয়"। 

মডার্ণ স্টেশনারির অনলাইনে একটি পেজ থাকলেও বর্তমানে সেটি সচল নেই। কারণ অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে তারা নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হয়। যার মধ্যে ছিল, অর্ডার দিয়ে পরে সেটা ক্যান্সেল করে দেওয়া, ঠিকানা ভুল দেওয়া, বড় বড় সরঞ্জাম ডেলিভারি করতে বেশি খরচ পড়লেও ক্রেতাদের সেটি দিতে না চাওয়া ইত্যাদি। ব্যবসায়ী মামুন ক্ষোভের সাথে বলেন, "এভাবে নানারকম সমস্যার পর আমরা আর অনলাইনে অর্ডার নেই না। কেননা আপনি ছোট একটি জিনিস কিনে ৬০-৮০ টাকা ডেলিভারি চার্জ দিতে পারছেন, কিন্তু আমরা এতো বড় বড় ক্যানভাস, উডেন ইজেল ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে অতি সতর্কতার সাথে পৌঁছে দিচ্ছি তাও সেখানে ক্রেতারা খরচ হওয়া বাড়তি টাকা দিতে চান না।"

"এছাড়াও আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে অনেকেই অনলাইনে বিভিন্ন পেজ খুলেছেন, যেগুলো আমাদের না। আমাদের কোন শাখা নেই। আর এসকল ভুয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য আমাদের ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে, ক্রেতার সংখ্যা কমে যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের নাম খারাপ হচ্ছে"।

ব্যবসায়ী মামুনের শঙ্কা তিনি আর তার ভাই না থাকলে তাদের এই ৬০ বছর ধরে চলে আসা ব্যবসাটি আর থাকবে না। কেননা তার নিজের সন্তানেরা এখনো অনেক ছোট, আর ভাইয়ের সন্তানেরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর এই ব্যবসা করতে চান না। তারা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তাই তার শঙ্কা, ভবিষ্যতে তাদের এই ব্যবসার হাল ধরার জন্য কেউ নেই। এভাবেই হয়তো একদিন তাদের বাবার হাতে গড়া ব্যবসাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।     

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.