মিয়াকো: জাপানি নামের বাংলাদেশি হোম অ্যাপ্লায়েন্স ব্র্যান্ড

ফিচার

18 March, 2022, 09:40 pm
Last modified: 19 March, 2022, 12:04 pm
এখন পর্যন্ত মিয়াকোর ৪৫০ পণ্যের মধ্যে প্রায় ৪০০টিই চীন, তুরস্ক, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। বাকিগুলোর মধ্যে ৪৩টি সংযোজন করা হয়। আর ৭টি পণ্য উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য 'আহমেদ ট্রেডিং' নামে একটি জেনারেল স্টোর খোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মোহাম্মদ ইদ্রিস আহমেদ।

সময়ের পরিক্রমায় এই আমদানিকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী একসময় বৈদ্যুতিক পণ্যের ওপর নজর দেন। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে তিনি পা রাখেন ভিসিআর ও ক্যাসেট প্লেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বৈদ্যুতিক পণ্যের বাজারে।

১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে মাত্র একটি পণ্যের ২৪টি ইউনিট নিয়ে গৃহস্থালি সরঞ্জামাদির ব্যবসায় নামেন ইদ্রিস। সেই পণ্যটি ছিল 'মিয়াকো' ব্র্যান্ডের একটি ব্লেন্ডার সেট।

তার প্রায় তিন দশক পর ২০২২ সালে মিয়াকোর প্রোডাকশন লাইনে এখন ৩৬ ক্যাটাগরির ৪৫০ পণ্য রয়েছে।

১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়াকো ব্র্যান্ডের আওতায় বৈদ্যুতিক ওভেন, রাইস কুকার ও মাইক্রোওয়েভ ওভেন বাজারে এনে আহমেদ ট্রেডিংয়ের সম্প্রসারণ ঘটান। আহমেদ ট্রেডিংয়ের বর্তমান নাম মিয়াকো অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেড।

২০০৮ সাল নাগাদ ইদ্রিস মিয়াকো অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের দায়িত্ব তার বড় ছেলে ড. মোহাম্মদ নাভিদ আহমেদকে বুঝিয়ে দেন।

দ্য বিজনেসকে স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিয়াকো অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নাভিদ বলেন, 'বাবা কেন বা কীভাবে ইলেকট্রনিকস ব্যবসায় আসতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তা আমি ঠিক জানি না। কিন্তু কোনো ব্যবসার সুযোগ আছে দেখলেই তিনি সেটি লুফে নিতেন।'

ছোটবেলায়ই ড. নাভিদ তার বাবার ব্যবসার সঙ্গে পরিচিত হন।

'নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে আমি বাবার সাথে দোকানে কাজ শুরু করি। হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজারের সিংহভাগই যখন ব্লেন্ডার আর আয়রনের মতো পণ্যের দখলে ছিল, সে সময় তিনি মিয়াকোকে একটি ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ড হিসাবে গড়ে তোলার দিকে মন দেন,' বলেন তিনি।

পারিবারিক ব্যবসায় পুনঃপ্রবেশের আগে সফলভাবে একাডেমিক লেখাপড়া শেষ করেন ড. নাভিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর তিনি আইবিএর ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) প্রোগ্রামে যোগ দেন। পড়াশোনা শেষে কর্মজীবন শুরু করেন প্রভাষক হিসেবে।

তিনি বলেন, 'আমি ভাগ্যবান যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে আইবিএ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছি। ব্যবসা এবং পরিবার চালানোর সময় ডক্টরেটের পড়াশোনা করা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল।'

২০১২ সাল ছিল মিয়াকোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। ওই বছরই কোম্পানিটি 'কিনবো ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডে'র ব্যানারে বাংলাদেশে গৃহস্থালি সরঞ্জামাদি সংযোজন করা শুরু করে। এক পর্যায়ে ব্র্যান্ডটি স্থানীয়ভাবে কিছু আইটেমও উৎপাদন করতে আরম্ভ করে।

২০০৮ সালে মিয়াকো-র দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. মোহাম্মদ নাভিদ আহমেদ | ছবি: নূর-এ-আলম

এখন পর্যন্ত মিয়াকোর ৪৫০ পণ্যের মধ্যে প্রায় ৪০০টিই চীন, তুরস্ক, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। বাকিগুলোর মধ্যে ৪৩টি সংযোজন করা হয়। আর ৭টি পণ্য উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে।

ড. নাভিদ বলেন, 'স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের জন্য আমাদের প্রায় ২০-৩০ শতাংশ উপাদান আমদানি করতে হয়।'

'মেড ইন বাংলাদেশ' হওয়ার পথের বাধা

বাংলাদেশে উৎপাদন করা যায়, এমন মোটরের মাধ্যমেই মিয়াকোর বেশিরভাগ পণ্য তৈরি করা হয়।

ড. নাভিদ বলেন, 'প্রতি বছর মিয়াকোর ১ লাখ মোটর লাগে, যা আমরা কোনো প্ল্যান্টে বিনিয়োগ করে স্থানীয়ভাবে তৈরি করতে পারি।'

কিন্তু বছরে কেবল এক লাখ মোটর উৎপাদন করে একটি উৎপাদন কারখানা খরচ তুলতে পারবে না বলে জানান ড. নাভিদ।

তার মতে, অন্য নির্মাতাদের কাছে মোটর বিক্রি করে চাহিদা-সরবরাহের ফাঁক পূরণ করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম চর্চা এখনও শুরু হয়নি।

তিনি বলেন, 'প্রতিবেশী বাজারগুলোতে বড় কোম্পানিরা প্রায়ই ভালো পণ্য তৈরির জন্য সম্পদ ভাগ করে নেয়। সেইসাথে নিজস্ব লক্ষ্যের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে বৃহত্তর বাজারের অভিজ্ঞতা লাভ করে। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো সম্পদ ভাগ করতে আগ্রহী নয়।'

ব্র্যান্ডের নামের পেছনের গল্প

মোহাম্মদ ইদ্রিস কেন জাপানের একটি শহরের নামে নিজ ব্র্যান্ডের নামকরণ করেছেন জানতে চাইলে ড. নাভিদ বলেন, '১৯৮০-৯০-এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশিদের মধ্যে জাপানি পণ্যের জনপ্রিয়তা ছিল। তাই বাবা জাপানি নামে নিজের হোম অ্যাপ্লায়েন্স ব্র্যান্ড চালু করার কথা ভাবেন।'

পরিচিত ইন্দোনেশিয়ান ড্যানিয়েল কুসমানের সঙ্গে বৈদ্যুতিক পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন মোহাম্মদ ইদ্রিস। দুই বন্ধুই মিয়াকো নামে তাদের পৃথক বাজারের জন্য একই প্রস্তুতকারকের কাছে থেকে পণ্য আমদানি করেন।

ড. নাভিদ বলেন, 'তারা একটি নতুন বাজার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন। একা একা প্রস্তুতকারকদের বেশি কার্যাদেশ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাদের। ইন্দোনেশিয়ায় এখনও কোম্পানিটি টিকে আছে এবং বর্তমানে উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছে।'

বিজ্ঞাপন বাজেট ছাড়াই ব্যবসা সম্প্রসারণ

মিয়াকো অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেড প্রতি বছর ৫০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি, সংযোজন ও উৎপাদন করে। তবে কোম্পানিটি তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয় না।

ড. নাভিদ বলেন, 'এটি আমাদের মূল রহস্যগুলোর একটি। বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট নেই আমাদের। মিয়াকো সমস্ত অর্থ ব্যয় করে গুণমান বাড়ানোর জন্য।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা একটি যন্ত্রে ২ মিলিমিটার তামার কয়েল ব্যবহার না করে ৪ মিলিমিটার তামার কয়েলের জন্য বাজেট রাখব। এজন্য আমাদের পণ্যের আয়ু বাজারের একই রকমের অন্যান্য পণ্যের চেয়ে বেশি।'

তিনি এবং তার ভাইয়েদের প্রত্যেকেরই লক্ষ্য ব্র্যান্ডের নাম ধরে রাখা। তবে বাজারের আকার নিয়ে তারা কিছুটা উদ্বেগে আছেন।

দেশজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে বিপণন

মিয়াকোর আউটলেট মাত্র ছয়টি, সবকটিই ঢাকায়। তবে সারা দেশে হোম অ্যাপ্লায়েন্স ব্র্যান্ডটির ৪০টি পার্টনার আউটলেট আছে। এই আউটলেটগুলো সরাসরি গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে। এছাড়া অংশীদাররা অন্যান্য খুচরা বিক্রেতাদের কাছেও বিপণন করে।

মিয়াকো কেন ঢাকার বাইরে আউটলেট চালায় না জানতে চাইলে ড. নাভিদ বলেন, 'একেক এলাকার চাহিদা একেক রকম। ঢাকার বাইরের একটি খুচরা দোকান বাজার সম্পর্কে আমাদের চেয়ে ভালো জানে। তাই এলাকায় আমাদের পণ্য বিক্রির ভার স্থানীয়দের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। এতে বিক্রি নিয়েও আমাদের মাথা ঘামাতে হয় না।'

৪০ অংশীদার ছাড়া মিয়াকো অন্য কাউকে পণ্য বিপণন করতে দেয় না। ড. নাভিদের মতে, এই নীতির সুবাদে মিয়াকোর অংশীদাররা তাদের নিজস্ব বাজার তৈরি, সম্প্রসারণ ও ধরে রাখার সুযোগ পায়।

মিয়াকোর মূল বাধা

প্রথমদিকে মোহাম্মদ ইদ্রিসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পণ্য বাজারজাতকরণ।

শেষে ব্যবহারকারীরা পণ্যের গুণমান নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ায় মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে মিয়াকোর নাম। এভাবে মুখের কথার প্রচারণা ব্র্যান্ডটির পক্ষে কাজ করেছে। গ্রাহকদের শেল্ফই তাদের বিপণন চ্যানেলে পরিণত হয়েছে বলে জানান ড. নাভিদ।

গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের পর মিয়াকোকে পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়তে হয়েছে বাকিতে পণ্য দিয়ে।

ড. নাভিদ জানান, '২০০০-এর দশকে ডিস্ট্রিবিউটর আর খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আমাদের কাছ থেকে বাল্কে পণ্য কেনার জন্য পর্যাপ্ত পুঁজি ছিল না। তাই প্রথমে আমরা বাকিতে পণ্য দিয়েছি। সে সময় বাকিতে পণ্য দিয়ে যাওয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।'

তবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার পর খুচরা বিক্রেতা ও পরিবেশকরা ইলেকট্রনিকসে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। শোরুমে যত বেশি সম্ভব ইলেকট্রনিকস আইটেম রাখতে শুরু করে তারা।

মহামারির ধাক্কা

কোভিড মহামারি মিয়াকো অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের ওপর তিন পর্যায়ে প্রভাব ফেলেছে।

কোভিডের প্রথম পর্যায় তাদের ব্যবসার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। তখন মানুষ অর্থ সঞ্চয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। বরং ঘরবন্দি থাকায় তারা বৈদ্যুতিক পণ্য কেনায় বেশি খরচ করতে শুরু করেছিল।

ড. নাভিদ বলেন, 'কোভিডের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আকাশচুম্বী হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা বাজারে বিদ্যমান পণ্যের বিকল্প হিসেবে সস্তা বা নকল ইলেকট্রনিক আইটেম আমদানি করতে শুরু করে।

'এটা আমাদের মার্কেট শেয়ারের ওপর প্রভাব ফেলেছে। প্রতিযোগিতা ভীষণ তীব্র হয়ে যায়। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি তখন ভালোই ছিল।'

চূড়ান্ত পর্যায়ে বিক্রি কমে একেবারে কোভিডপূর্ব অবস্থায় চলে যায়। লোকে বুঝতে পারে, মহামারি শিগগিরই শেষ হচ্ছে না। এ কারণে তারা সঞ্চয় বাড়াতে এবং খরচ কমাতে আরম্ভ করে।

'এখন প্রতিযোগীর সংখ্যা আরও বেশি। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা নকল আইটেম বিক্রি করছে। ফলে আমাদের বাজার [শেয়ার] কিছুটা কমেছে, যার ফলে বিক্রিও কমে গেছে।'

ভাইদের সঙ্গে ব্যবসা করার সুবিধা

মোহাম্মদ ইদ্রিসের চার সন্তানই এখন মিয়াকোর পরিচালক। স্ব স্ব দক্ষতা ও আগ্রহের ভিত্তিতে চার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা।

ডা. নাভিদের মতে, পারিবারিক ব্যবসায় কর্মরত পরিবারের সদস্যদের সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকলে তারা একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে পারে এবং সাফল্য নিয়ে আসতে পারে।

ইদ্রিসের বড় ছেলে মমতাজ আহমেদ প্যাকেজিং ও ডিজাইনের তত্ত্বাবধান করেন। ডা. নাভিদ পণ্য সোর্সিং, পরিকল্পনা, কারখানা, বিক্রয় এবং উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তার ছোট ভাই হাসিব আহমেদ কর্পোরেট বিক্রয়ের দেখভাল করেন। আর সর্বকনিষ্ঠ জায়েদ আহমেদ রিটেইল ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন।

ড. নাভিদ জানান, 'আমার মা তাসমিনা আহমেদ এস্টেট ম্যানেজমেন্টের তত্ত্বাবধান করেন। তাছাড়া একজন মানুষ শুরু থেকেই মিয়াকো এবং আমাদের পরিবারের অংশ ছিলেন। তিনি মোহাম্মদ হারুন, আমার বাবার বন্ধু। উনি মিয়াকোর চিফ মার্কেটিং অফিসার।'

মিয়াকোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

রাইস কুকার উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে মিয়াকো অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের। এখন পর্যন্ত ব্র্যান্ডটির উৎপাদিত পণ্যের তালিকায় প্লাস্টিকের জার ব্লেন্ডার রয়েছে, তবে শিগগিরই স্টেইনলেস স্টিলের জার ব্লেন্ডারও যুক্ত হবে।

ড. নাভিদ বলেন, বর্তমান বাজার-প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের পণ্য রপ্তানি করবেন। পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানির স্বপ্ন থাকলেও এই মুহূর্তে তারা সার্ক দেশগুলোতে বাজার সম্প্রসারিত করতে চান।

তিনি বলেন, 'আমাদের ব্যবসা ভালো চলছে। আমরা রেসে নামিনি। নিজেদের মতো করে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.