কেন ভোজের আচারি খিচুড়ি অন্যদের চেয়ে আলাদা?
ফিচার
বছরকয়েক আগের কথা। রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করার সময় আনিসুর রহমান নামের এক ভদ্রলোকের কাছে দুজন জাপানি ব্যক্তি খোঁজ জানতে চান ভোজ রেস্টুরেন্টের। বিদেশি নাগরিকদের এমন অনুসন্ধান সম্পর্কে জেনে বেশ বিস্মিত হন আনিসুর। কারণ তিনিই যে ভোজের সহপ্রতিষ্ঠাতা!
জাপানিদের কাছে জিজ্ঞেস করে আনিসুর জানতে পারেন, জাপানের ট্যুরিজম গাইডে এই রেস্টুরেন্টের নাম পড়ে এখানে খেতে এসেছেন তারা। অবশ্য ততদিনে রেস্টুরেন্টে খেতে আসা অতিথিদের কাছ থেকে বারবার ভোজের খিচুড়ির প্রশংসা শুনে নিজেদের খাবার সম্পর্কে বেশ আত্মবিশ্বাসীই হয়ে উঠেছিলেন আনিসুর রহমান আর তার বন্ধু শাহেদ রহিম।
এই দুই বন্ধু মিলে ২০০৭ সালে সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাসার গ্যারেজের সাথে এক ছোট্ট রুমে শুরু করেছিলেন 'ভোজ-বাংলার স্বাদ' নামের বাঙালি খাবারের এই রেস্টুরেন্ট। শুরুতে ঢাকার চাকরিজীবী মানুষদের কথা মাথায় রেখে শুধু পার্সেল সার্ভিস হিসেবে এগোনোর কথা ভাবলেও ছোট্ট পরিসরে ডাইন-ইন সার্ভিস নিয়েই শুরু করেছিলেন দুই বন্ধু।
প্রথম থেকেই তাদের উদ্দেশ্য ছিল হোটেলেই বাসার খাবারের স্বাদ দেওয়া। এজন্য বাবুর্চিকে বলেছিলেন, "আমরা এমন একটা জিনিস বানাতে চাই যেটা আমরা বাসায় খাই। হোটেল না ভেবে এখানে এমনভাবে রান্না করবেন যেভাবে বাসায় আমাদের মা-খালারা রান্না করেন।" সত্তরোর্ধ্ব মহসীন বাবুর্চি শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত এই কথা মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছেন।
ভোজে সবধরনের বাংলা খাবার পাওয়া গেলেও এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত আইটেম আচারি খিচুড়ি। চিকেন, বিফ, মাটন, ইলিশ, চিংড়ি আর শীতকালে হাঁসের মাংসের সাথে পাওয়া যায় এই আচারি খিচুড়ি। এই খিচুড়ির টানে শহরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভোজন রসিকেরা।
সেই টানে আমরাও শীতের দুপুরে হাজির হয়েছিলাম ঢাকার সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির পাশে ভোজের ঠিকানায়। কাঠের টেবিল আর টুল দিয়ে ছিমছামভাবে সাজানো রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই এর পরিবেশ বেশ স্বস্তি দিয়েছিল। ঘরোয়া আরামদায়ক পরিবেশে এমন কোনো চাকচিক্য নেই যা খাওয়ার মনোযোগ নষ্ট করবে। ভরদুপুরবেলায় রেস্টুরেন্টটিতে সেগুনবাগিচার বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োজিত চাকরিজীবীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
খাবার অর্ডার করার মিনিট কয়েক পরই দুটি বড় সাইজের কাচের বাটিতে গরম গরম আচারি বিফ-খিচুড়ি আর হাঁস-খিচুড়ি হাজির হয়ে গিয়েছিল। সাথে ছোট ছোট চারটা বাটিতে ছিল সিরকায় ভেজানো গোল করে কাটা পেঁয়াজ, পুদিনা আর ধনেপাতার চাটনি, কাঁচামরিচ আর ছোট করে কাটা লেবু।
অন্যান্য রেস্টুরেন্টে খাওয়া খিচুড়ির মত অতিরিক্ত তৈলাক্ত চেহারার খিচুড়ি না দেখে খুশি হলেও আবার বেশী শুকনো লাগার ভয় পাচ্ছিলাম। খাওয়া শুরু করতেই আমাদের ভুল ভাঙল। পর্যাপ্ত তেলে রান্না করা বেশ তুলতুলে আর টাটকা খিচুড়ি খেয়ে সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল। সাথে ঝাল ঝাল করে রান্না করা গরুর মাংসের যুগলবন্দী যে কারো মন জয় করে নেবে। লেবুর রস আর চাটনি দিয়ে মেখে কাঁচামরিচ আর সিরকায় ভেজানো পেঁয়াজ সাথে নিয়ে এই আচারি খিচুড়ি খাওয়ার সময় মনের অজান্তেই মুগ্ধতা প্রকাশ করে যাচ্ছিলাম। রান্নায় অতিরিক্ত তেল-মশলা না থাকায় বাসার খাবারের মতোই তৃপ্তি করে অনেকটা খিচুড়ি খেয়ে নেয়া যায়।
হাঁসের মাংসের স্বাদ বেশ ভালো হলেও শক্ত হাঁস ছিড়ে খেতে একটু বেগ পেতে হচ্ছিল। আচারি খিচুড়ির সাথে আমরা বোরহানি আর দইও নিয়েছিলাম। বোরহানির স্বাদ ছিল মোটামুটি। তবে শেষ পাতে মিষ্টি দইয়ের স্বাদ আমাদের উদরপূর্তিকে আরোও সুখকর করে তুলেছিল।
সবশেষে ছোট ছোট প্যাকেটে করে দেয়া পান মশলা এই ভারি খাবারের পর একটা সুন্দর সমাপ্তি টেনে দিয়েছিল।
ভোজের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার এই আচারি খিচুড়ির জন্য আনিসুর রহমান পুরো কৃতিত্ব দেন তার বন্ধু শাহেদ রহিমকে। তার পরিকল্পনা অনুযায়ীই এই খিচুড়ি যোগ করা হয়েছিল ভোজের মেন্যুতে। আনিসুর রহমানের মতে তারাই সর্বপ্রথম ঢাকায় এই আচারি খিচুড়ির প্রচলন শুরু করেন।
আনিস বলেন, "আমাদের খিচুড়ির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো এটা একদম সিম্পলভাবে বানানো হয়। স্বাদ বাড়ানোর জন্য এতে ক্ষতিকর কোনো রঙ বা গন্ধ এড করা হয়না। খিচুড়িতে ব্যবহৃত আচারটা স্পেশাল আচার। বিশেষভাবে বানানো এই আচারটা আমরা সংগ্রহ করে রাখি শুধু খিচুড়ির জন্য।"
জনপ্রিয় আচারি চিকেন খিচুড়ির দাম ২২৫ টাকা, বিফ খিচুড়ি ২৮৫ টাকা, মাটন খিচুড়ি ৩৩৫ টাকা, হাঁস খিচুড়ি ৩২৫ টাকা। এই দামের সাথে যোগ হয় ৫% সার্ভিস চার্জ।
ভোজের খিচুড়ি ছাড়া অন্যান্য বাঙালি খাবারও ঢাকাবাসীর কাছে বেশ আকর্ষণীয়। "আমাদের এখানে একটা ডাল পাওয়া যায়, নাম পঞ্চডাল। পাঁচধরনের ডাল মিশিয়ে এটা বানানো হয়। মিরপুর থেকে এক ভদ্রলোক প্রতি সপ্তাহে দুইদিন তার ড্রাইভারকে পাঠান এই ডাল নিয়ে যাওয়ার জন্য," বলেন আনিস।
"মানুষের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো তার সৃষ্টির স্বীকৃতি পাওয়া। আমাদের সৃষ্টির এমন স্বীকৃতি পাওয়ায় খুব ভালো লাগে আমাদের।"
এছাড়াও ভোজের জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে বোম্বে বিরিয়ানি, মুরগি, গরু বা চিংড়ি দিয়ে বানানো চিজ মোগলাই, চিজ নান, নানা ধরনের কাবাব উল্লেখযোগ্য।
রেস্টুরেন্টের শুরু থেকেই আনিস ও শাহেদ দুই বন্ধু চেষ্টা করে এসেছেন সবচেয়ে ভালো মানের খাবার পরিবেশন করতে। এজন্য রান্নার বাজারের তদারকি সবসময় নিজেরা করেছেন। বাজার করতে গিয়ে সবচেয়ে ভালো মানের জিনিসগুলো এনেছেন সবসময়। রান্নায় সবসময় প্যাকেটজাত তেল যেন ব্যবহার হয় সে খেয়াল রেখেছেন তারা। পোড়া তেল রেস্টুরেন্টের আশেপাশেও রাখতে দেন না কখনো। গরুর মাংস কেনার সময় হাড়ছাড়া মাংসটা বাছাই করে আনেন।
ভোজের খাবারের দাম কিছুটা বেশি বলে প্রায়ই নানাজনে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে আনিস বলেন, "ভালো জিনিস দিতে চাইলে দাম একটু বেশিই হয়ে যায়। দাম কমাতে চাইলে আবার খাবারের মান ঠিক থাকবে না। যেমন- খোলা তেলের দাম বাজারের প্যাকেটজাত তেলের চেয়ে কম। তবে খোলা তেল ব্যবহার করলে কিন্তু খাবার স্বাস্থ্যসম্মত হবে না। রান্নায় ব্যবহৃত সব উপকরণের গুণগত মান নিশ্চিত করতে গিয়ে খাবারের দামটা একটু বেড়ে যায়। দাম বেশি বলে আমরা যে অনেক বেশী প্রফিট করছি তা কিন্তু না। শুরু থেকেই একদম অল্প প্রফিটে সেরা খাবার দেয়ার চেষ্টা করেছি আমরা।"
জাপান টোবাকো ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা ইকরামুল হাসান বছর তিনেক যাবত প্রায়ই ভোজে খেতে আসেন বলে জানান। খাবারের দাম একটু বেশি মনে হলেও তা স্বাদ অনুযায়ী উপযুক্ত বলে ভোজের খাবারকে তিনি 'ফাইভ স্টার' মার্কিং করেন। ইকরাম বলেন, "এখানের আচাড়ি খিচুড়ির সাথে হাঁসের কম্বিনেশনটা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না সাধারণত। খিচুড়িটা বেশী তৈলাক্ত না আবার সব মশলারও পারফেক্ট কম্বিনেশন থাকে, যে কারণে আমার ভালো লাগে।"
মানুষের সামনে হালাল খাবার পরিবেশন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভোজ। তাই খাবার রান্নায় কোনো লুকোচুরি করেন না। যে কেউ চাইলেই তাদের রান্নাঘর আর স্টোররুম দেখে পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর থেকে তাদের খাবারের পরিবেশ 'এ' গ্রেড সার্টিফিকেটও পেয়েছে।
শিল্পকলা একাডেমির পাশেই অবস্থান হওয়ায় খাবারের সুনাম শুনে অনেক শিল্পব্যক্তিত্ব প্রায়ই খেতে আসেন ভোজে। খাবার নিয়ে বেশীরভাগ সময় প্রশংসা পেলেও কখনো কখনো দুই-একজন অভিযোগও করেন বলে অকপটে স্বীকার করেন আনিস। কাস্টমারদের সব পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করে নিজেদের সবসময় শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
ভোজ এখনো পর্যন্ত অনলাইনে পার্সেল সার্ভিস দিচ্ছে না। তবে জনবল বাড়িয়ে উঠতে পারলে ভবিষ্যতে বড় পরিসরে পার্সেল সার্ভিস দেয়ার চিন্তা আছে তাদের। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে ঢাকার নানা এলাকায় তাদের নতুন ব্রাঞ্চ খোলার পরিকল্পনা আপাতত বন্ধ আছে। তবে সময়ের সাথে সব স্বাভাবিক হয়ে উঠলে ভবিষ্যতে আরো কয়েকটি ব্রাঞ্চ খুলবেন বলে জানান আনিসুর রহমান।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.