১৫৫ দিনে বিশ্বভ্রমণ: এক কিশোরী যেভাবে বিশ্বরেকর্ড গড়লেন

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
26 January, 2022, 04:25 pm
Last modified: 26 January, 2022, 04:29 pm
পাঁচটি মহাদেশের ৩১টি দেশে উড়াল দিয়ে জারা সম্পন্ন করেছেন এক অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর যাত্রা।

জারা রাদারফোর্ড যখন ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টো থেকে সিয়াটলের উদ্দেশে বিমান নিয়ে উড়াল দিলেন, আবহাওয়া চমৎকার ছিল। ততদিনে এক মাস হয়েছে, তিনি সবচেয়ে কমবয়সি নারী হিসেবে একা একা গোটা বিশ্বজুড়ে উড়ে বেড়ানোর রেকর্ড গড়ার লক্ষ্যে অভিযাত্রা শুরু করেছেন।

কিন্তু আকাশ পরিষ্কার থাকলেও, নিচের জমিনে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে দাবানল। নিঃশেষ করে দিচ্ছে আশপাশের সবকিছু।

বিষাক্ত ধোঁয়ার পাহাড় এড়াতে ১২,০০০ ফুট পর্যন্ত উপরে উঠে গেলেন জারা। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, সামনে কিছু দেখতেও পাচ্ছিলেন না তিনি। সবকিছুই কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া, নোংরা রঙের মনে হচ্ছিল। ধোঁয়ার অপ্রীতিকর গন্ধও ঝাপটা দিচ্ছিল তার নাকে।

এক পর্যায়ে চতুর্দিক থেকে ধোঁয়া ঘিরে ধরল জারাকে। বিমান থেকে একদমই দেখতে পাচ্ছিলেন না জমিন। তখন তিনি বুঝে গেলেন, ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তার সামনে।

এটি স্রেফ একটি গল্প। এরকম আরো অনেক শ্বাসরুদ্ধকর গল্পই জমা হয়েছে জারার ঝুলিতে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, শত প্রতিবন্ধকতাও হারাতে পারেনি তাকে। দাঁতে দাঁত চেপে, অদম্য মানসিকতাকে পুঁজি করে লড়ে গেছেন তিনি। পাঁচটি মহাদেশের ৩১টি দেশে উড়াল দিয়ে তিনি সম্পন্ন করেছেন এক অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর যাত্রা। গত বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) ছিল সেই যাত্রার শেষ দিন।

১৯ বছর বয়সী জারার তাই এখন যেন আর আবেগ বাঁধ মানছে না। ব্রাসেলসে নিজের বাড়িতে বসে পরিবারের সঙ্গে উদযাপন করছেন নিজের সফলতার।

বিশ্বরেকর্ড গড়ার পর জারা। ছবি: আইসোপিক্স/রেক্স/শাটারস্টক

তবে নিজগৃহে যত আরাম-আয়েশেই কাটুক না কেন তার বর্তমান, ১৫৫ দিনের অভিযাত্রার কথা কি আর ভুলতে পারেন তিনি! মাত্র দুই আসনের একটি শার্ক মাইক্রোলাইটে বসেই তিনি দেখেছেন পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান সবচেয়ে শীতল, ধোঁয়াটে ও ভেজা কিছু স্থান। তার বিমানটি এত ছোট ও হালকা ছিল যে, কেবল একজন মানুষই সেটিকে রানওয়েতে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিতে সক্ষম।

তবে বিমানের এত বেশি হালকা হওয়া সবসময় জারার জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা বয়ে আনেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে বিড়ম্বনার কারণও। যেমন এই তো সপ্তাহখানেক আগে বুলগেরিয়ান পর্বতমালার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বিমানটি এত জোরে কাঁপছিল যে, জি-ফোর্স ওয়ার্নিং বাজতে শুরু করে। জারাও তখন যে পরিমাণ অস্বস্তি অনুভব করছিলেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।

তাছাড়া গত বৃহস্পতিবারও ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পশ্চিম বেলজিয়ামের কর্ট্রেইকে শেষ যাত্রার সময় বিমানের ছাউনির সঙ্গে মাথায় বাড়ি লাগে জারার।

জারার যাত্রা শুরু হয় বেলজিয়াম থেকে, গত আগস্টে। সেখান থেকে তিনি একে একে উড়ে যান যুক্তরাজ্য, গ্রিনল্যান্ড, আমেরিকা ও রাশিয়ায়। তারপর তিনি ধাবিত হন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে। এরপর ভারত ও মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আবারো ফিরে আসেন ইউরোপে।

জারার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন পাইলট। তাই হামাগুড়ি দেবার বয়সেই ছোট ছোট বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা লাভ করে ফেলেন তিনি। আর বিমান ওড়ানোর লাইসেন্স পান ১৭ বছর বয়সে। কিন্তু নাতিশীতোষ্ণ বেলজিয়ামে বেড়ে ওঠা জারা শারীরিকভাবে খুব একটা প্রস্তুত ছিলেন যে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় অভিযোজনের। তবু একপ্রকার অপ্রস্তুত অবস্থাতেই তিনি টিকে থাকেন লড়াই করে।

জারার কঠিনতম টাস্কগুলোর মধ্যে একটি ছিল সাইবেরিয়ার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া। সাইবেরিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হয়তো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, কিন্তু সেই ভয়ংকর সুন্দরের উপর দিয়ে উড়তে গেলে বুকে কাঁপনও ধরে। তিনি যখন সেখানে গিয়েছেন, বছরের ওই সময়টায় সমুদ্রের পানি জমে বরফ হয়ে থাকে। জারার ভাষায়ম "কোথাও কোনো গাছ নেই, মানুষ নেই। নেই রাস্তাঘাট কিংবা বৈদ্যুতিক তারও। নির্জনতা বিবেচনা এমন আর কিছু হতেই পারে না।"

এমন তুষারাবৃত ভূখণ্ডের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়টা জারাকে আরো বেশি ভয় পাইয়ে দেয়। কারণ তার মাথায় তখন একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, এই জায়গায় যদি তার বিমানের ইঞ্জিন ফেইল করে, তাহলে রেসকিউ আসার অপেক্ষায় দীর্ঘসময় একা একা অপেক্ষা করতে হবে।

"মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাটানো... আমি জানি না বাস্তবিকই এটা সম্ভব কি না। আর আমার কাছে এমন কোনো সারভাইভাল গিয়ারও ছিল না যে আমি বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে পারব।"

যখন জারা উড়ে যাচ্ছিলেন সৌদি আরবের মরুভূমির উপর দিয়ে। ছবি: এপি

রাতের বেলা যেমন জারা বিমান নিয়ে উড়তে পারতেন না, তেমনই ওড়া সম্ভব ছিল না আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও। ফলে দ্রুত শেষ হয়ে আসা সময়ের বিরুদ্ধেও লড়ে যেতে হচ্ছিল তাকে। কী হতে পারে সে ভাবনা বাদ দিয়ে তিনি বাধ্য হন বিমানচালনায় মনোনিবেশ করতে। তবে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও তিনি আঁটতে পারছিলেন না। তাকে এগোতে হচ্ছিল পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট করে। কারণ আগামী দুই ঘণ্টায় বা চার ঘণ্টায় আবহাওয়া রাতারাতি বদলে যেতে পারে।

যেমন একবার তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন জাকার্তায় অবতরণের। কিন্তু বজ্রঝড়ের কারণে তা করে উঠতে পারেননি তিনি। তিনি বাধ্য হন বোর্নিও দ্বীপের কেটাপাঙে একটি ছোট্ট এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে। তবে সেই টার্মিনালে ছিল না কোনো ইমিগ্রেশন। ফলে টানা দুদিন সেখানেই কাটাতে হয় তাকে।

কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? জারা জানান, "মানুষগুলো ছিল খুবই ভালো। আমি সেখানে খুব ভালো ভালো স্থানীয় খাবার পেয়েছি।"

ককপিটে ফোকাস ধরে রাখতে মিউজিকও বেশ সাহায্য করে জারাকে। ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পপ গানের বিশাল প্লে-লিস্ট সঙ্গে ছিল তার। এসব গানের সুর তার বাড়ি থেকে বহুদূরে থাকবার 'কালচার শক' থেকে পরিত্রাণেও ভূমিকা রাখে।

"আমি যেসব জিনিসের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত, সেগুলোর সান্নিধ্য আমার জন্য ইতিবাচক ব্যাপার ছিল। বিশেষ করে সাইবেরিয়া, সৌদি আরব এবং এশিয়ার অধিকাংশ জায়গায়... সবকিছুই সেখানে আলাদা ছিল। সংস্কৃতি, জলবায়ু, মানুষ... মানুষজন অনেক উদারমনা ও দয়ালু ছিল বলেই আমার মনে হচ্ছিল। তারপরও বাড়ি থেকে এত দূরে থাকতে গান শুনতে শুনতে গানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারাটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।"

বেলজিয়ামে পা রাখার পর বাবা-মা ও ভাইয়ের সঙ্গে জারা। ছবি: রেক্স/শাটারস্টক

এই তরুণ পাইলট তার যাত্রার পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কেও বেশ ভালোভাবেই অবগত। তিনি শুরুতে চেয়েছিলেন বৈদ্যুতিক বিমানে যাত্রা করতে। কিন্তু পরে আবিষ্কার করেন, সেটি সম্ভব নয়। তবে তার দাবি, একটি বাণিজ্যিক জেটের চেয়ে তার বিমান অনেক কম জ্বালানি খরচ করেছে।

"বিশ্বব্যাপী আমার পুরো ট্রিপের জন্য যে পরিমাণ জ্বালানি ব্যয় হয়েছে, একটি বোয়িং সমপরিমাণ জ্বালানি মাত্র দশ মিনিটেই ব্যয় করে। তাই আমার এই যাত্রার কিছু নেতিবাচক প্রভাব থাকলেও, প্রথম দর্শনে যতটা মনে হয় ততটা মোটেই নয়। তাছাড়া আমি কিছু কার্বন অপসারণের কাজও চালাচ্ছিলাম।"

জারার ইচ্ছা যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনার। তিনি মনে করেন, বিমান চলাচলকে আরো বেশি সবুজ করে তোলার কাজে যুক্ত হতে পারেন তিনি। "এই মুহূর্তে বিমান চালনা কোনোভাবেই টেকসই নয়, তবে এটি সে পথেই হাঁটছে।"

তবে বিমান চালনার গতিপথকে বদলে দেওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভে তো জারার আরো অনেক সময় লাগবে। এই মুহূর্তে তার আশা, তার এই যাত্রা কিশোরী-তরুণী থেকে শুরু করে নারীদেরকে অনুপ্রাণিত করবে বিমান চালনায়, এবং বিজ্ঞান, প্রকৌশল, প্রযুক্তি ও গণিত নিয়ে পড়াশোনায়।

"এভিয়েশন (বিমান চালনা) একটি অনেক বড় ইন্ডাস্ট্রি, এবং এটি সবসময়ই থাকবে। আমরা বৈদ্যুতিক বিমান তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছি, তবে পাইলটের চাহিদা তো থাকবেই। তাই আমি আশা করছি, নতুন অনেক নারীই এ পেশায় যোগ দেবে।"

  • সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.