বিশ্বের সবচেয়ে ছোট থেকে শুরু করে দুষ্প্রাপ্য সব ম্যাচবক্স... কী নেই তার কাছে!
কয়েক বছর আগে হুট করেই সাকিল হকের কাছে একটা ইমেইল আসে সুদূর আমেরিকার এক গোয়েন্দার কাছ থেকে। একটা ম্যাচবক্সের ছবি দেখিয়ে সেই গোয়েন্দা জানতে চান ম্যাচবক্সটি কোন দেশের হতে পারে! খুন হওয়া এক অজ্ঞাত ব্যক্তির স্যুটকেস থেকে জামাকাপড়ের সাথে থাকা ম্যাচবক্সটি উদ্ধার করেছেন তারা। ম্যাচবক্সের উৎপত্তিস্থল জানা গেলে অজ্ঞাত লোকটির পরিচয় বের করা যেতে পারে। ম্যাচবক্সের ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে ফিলুমেনিস্ট সাকিল হক জানালেন এটি জার্মানির। তার দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে অগ্রসর হয়েছিল সেই মামলার তদন্ত।
ম্যাচবক্স আর ম্যাচ সম্পর্কিত যাবতীয় জিনিস সংগ্রহ করা সাকিল হকের শখ। ম্যাচবক্স সংগ্রহের এই শখকে বলা হয় ফিলুমেনি আর ম্যাচবক্স সংগ্রাহকদের বলা হয় ফিলুমেনিস্ট। বিশ্বজুড়ে শখটি খুব বিরল না হলেও এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে এটি।
কর্মজীবনে গ্রাফিক ডিজাইনার ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসেবে কাজ করা সাকিল হক নিজেকে শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। ছোটবেলা থেকেই শখের বশে ম্যাচবক্স সংগ্রহ করতেন সাকিল। শৌখিন বাবার সংগ্রহে থাকা নানা ধরনের ডাকটিকেট, মুদ্রা, ম্যাচবক্স দেখতেন। ম্যাচবক্সে থাকা নানা বিচিত্র নকশা তাকে আকর্ষণ করত সবসময়। বাচ্চা বয়সেই সেগুলো দেখে নিজের খাতায় আঁকার চেষ্টা করতেন নকশাগুলো।
স্কুল জীবনে নিজের এলাকায় আশেপাশের দোকান থেকে সংগ্রহ করতেন বিচিত্র সব ম্যাচবক্স। চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কাজের জন্য মাঝে ইংল্যান্ড যেতে হয় তাকে। সেখানে গিয়ে বিশ্বজোড়া নানা ইতিহাস সমৃদ্ধ ম্যাচবক্স দেখে তার ম্যাচবক্স সংগ্রহের নেশা আরো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দেশ-বিদেশের নানা ম্যাচবক্স তার সংগ্রহে আসে সে সময়ে। দেশে ফিরেও নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো শুরু করেন ম্যাচবক্সের সন্ধানে।
সাকিল বলেন, 'ম্যাচবক্সের ডিজাইন থেকে একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান পাওয়া যায়। দেশের মানুষের সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানা যায় এটা থেকে।'
সাকিলের সংগ্রহে আছে সারাবিশ্বের নানা ধরনের ম্যাচবক্স। সিলিন্ডার আকৃতির, তাবু আকৃতির, বই আকৃতির ম্যাচবক্সসহ নানা আকৃতির ম্যাচবক্স এর মাঝে উল্লেখযোগ্য। কাঠের, প্লাস্টিকের, টিনের আর চামড়ার ম্যাচবক্স সবচেয়ে বৈচিত্রময়। ভারতে তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট আকৃতির ম্যাচবক্সটিও আছে তার কাছে। সারাবিশ্বে এই ম্যাচবক্সটি আছে মাত্র দুইটি। বিশ্বের ১৩০টির মতো দেশের প্রায় ২০ হাজার ম্যাচবক্স বর্তমানে সাকিলের কাছে আছে।
ম্যাচবক্স নিয়ে গবেষণা করতে করতে সাকিলের পরিচয় হয় বিশ্বের বিখ্যাত সব ফিলুমেনিস্টদের সাথে। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে আদান-প্রদান করেন দুষ্প্রাপ্য সব ম্যাচবক্সের কালেকশন। এই ফিলুমেনিস্টদের মধ্যে স্লোভেনিয়ার স্যান্ডি সাকিলের ম্যাচবক্সের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা। সাকিল বলেন, 'আমার সংগ্রহের একটা বড় অংশ স্যান্ডির কাছ থেকে পাওয়া। বিশ্বের বড় বড় সব ফিলুমেনিস্টরা আমার ম্যাচবক্স সংগ্রহে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছেন।'
প্রায়ই বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে ম্যাচবক্সের দুর্লভ কালেকশনের পার্সেল পাঠিয়ে সাকিলের সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেন অনেকে।
ম্যাচবক্স সংগ্রহের নেশায় থাকলে দিন-দুনিয়ার অন্য কিছু চিন্তায় থাকে না সাকিল হকের। একবার ঢাকায় চলতি পথে দূর থেকে এক ময়লার স্তূপে বারুদের মত কিছু একটা দেখতে পান তিনি। ম্যাচবক্স হতে পারে ভেবে এগিয়ে গিয়ে দুর্গন্ধ এড়িয়ে তুলে নেন সেটি। সেখান থেকে ভারতীয় ম্যাচবক্স উদ্ধার করেন সেদিন।
সাকিল হক শুধু ম্যাচবক্স সংগ্রহই করেন না, নিজেও ডিজাইন করেন ম্যাচবক্স। "নানা দেশের সংগ্রাহকদের কাছ থেকে ম্যাচবক্স সংগ্রহ করতে হলে বিনিময়ে আমাকেও কিছু দিতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তো ম্যাচবক্সের ডিজাইনে বৈচিত্র্য নেই। এখানে ম্যাচবক্সের ডিজাইন খুবই নেগলেক্টেড বিষয়। এটা যে শিল্পের অংশ হতে পারে, নান্দনিক হতে পারে তা আমাদের চিন্তাতে আসে না। শুধু বাণিজ্যিক চিন্তা মাথায় নিয়ে বানানো একই ধরণের ডিজাইন বছরের পর বছর চলতে থাকে। সংরক্ষণ করে রাখার মতো দেশীয় ম্যাচবক্সের সংখ্যা খুব কম। তাই নিজেই ম্যাচবক্স ডিজাইন করার উদ্যোগ নিয়েছি," বলেন সাকিল।
ম্যাচবক্স ডিজাইন করার জন্য শুরুতে ম্যাচ কোম্পানিগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে সাকিলকে। বিনামূল্যে ডিজাইন করে দিতে চাইলেও পাত্তা দেয়নি কোম্পানিগুলো। একসময় হতাশই হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর সোনারগাঁও হোটেলে 'ইন্দোনেশিয়ান ন্যাশনাল ডে' ফেস্টিভালে দেখা হয় ইন্দো-বাংলা ম্যাচ কোম্পানির সিইও হরতনোর সাথে। ম্যাচবক্স ডিজাইনের প্রতি সাকিলের আগ্রহ জানতে পেরে তাকে কোম্পানির জন্য ডিজাইন করার প্রস্তাব দেন হরতনো। কিন্তু এর পরপরই তিনি বদলি হয়ে যান অন্য জায়গায়। এ ঘটনার পর ২০১৫ সালে হরতনোর সূত্রেই সাকিলের ডাক পড়ে বাংলাদেশের জামিল গ্রুপ থেকে।
জামিল গ্রুপের প্রস্তাবে 'বাংলার রঙ' শিরোনামে ১২টি ম্যাচবক্স ডিজাইন করে দেন সাকিল। যার জন্য বেশ মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকও পান। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে সাকিল বলছিলেন, 'জামিল গ্রুপের সাথে কাজের পর আকিজ গ্রুপ থেকেও যোগাযোগ করা হয় আমার সাথে। তাদের জন্যও তখন ম্যাচবক্স ডিজাইন করে দিয়েছি, ভালো সম্মানীও দিয়েছে তারা। অথচ কয়েকবছর আগে আমিই তাদের সাথে দেখা করে বিনামূল্যে ম্যাচবক্স ডিজাইন করে দিতে চেয়েছিলাম। তখন তারা কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি।'
২০১৬ সাল থেকে নিজ উদ্যোগে আলাদা করে ম্যাচবক্স ডিজাইন করা শুরু করেন সাকিল। ম্যাচবক্সের ডিজাইনে দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্বও থাকে তার ডিজাইনে। থাকেন এমন ব্যক্তিরাও যাদের নাম অনেকটাই হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। ম্যাচের একপাশে থাকে ব্যক্তির প্রতিকৃতি আর অন্যপাশে থাকে তার সংক্ষিপ্ত জীবনী। এপর্যন্ত তার ডিজাইন করা ম্যাচবক্সে স্থান পেয়েছ কাজী নজরুল ইসলাম, এসএম সুলতান, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মেরিলিন মনরো, এডলফ হিটলার, উসামা বিন লাদেন প্রমুখের প্রতিকৃতি।
সাকিলের শিক্ষক চিত্রশিল্পী মর্তুজা বশীরের শিল্পকর্মও ম্যাচবক্সের ডিজাইনে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। সেই ম্যাচবক্সগুলো উপহার পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন মর্তুজা বশীর। সাকিলের কাছে সেটি ভীষণ স্মরণীয় দিন।
বর্তমানে সাকিলের নিজের ডিজাইন করা ম্যাচবক্সের সংখ্যা ৫৫০ এর উপর। ম্যাচবক্স ডিজাইন নিয়ে তিন সদস্যের একটা রিসার্চ টিমও আছে তার। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেখে ফিলুমেনি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে তার সাথে কাজ করতে এসেছেন এই রিসার্চ সঙ্গীরা।
'ম্যাচবক্স ও লেবেল কালেকশন' নামে সাকিল হক নিজস্ব ওয়েবসাইট পরিচালনা করছেন ২০০৫ সাল থেকে। সেখানে সারাবিশ্বের মানুষ তার সংগ্রহ আর নতুন ডিজাইন দেখতে পারে। ২০১৬ সালে তিনি বাংলাদেশের ফিলুমেনিস্টদের নিয়ে 'বাংলাদেশ ম্যাচবক্স কালেক্টরস ক্লাব' (বিএমসিসি) গড়ে তোলেন।
বিএমসিসি-র সদস্যরা ম্যাচবক্স সংগ্রহের পাশাপাশি ম্যাচবক্স ডিজাইনের গুরুত্ব মানুষকে বোঝানো, ম্যাচবক্সের ইতিহাস তুলে ধরা, ম্যাচবক্স আদান-প্রদান করা, নতুন কোনো ম্যাচবক্স বের হলে সকল ফিলুমেনিস্টদের জানানোর মতো নানা কাজ করে থাকে। তাদের কার্যক্রমকে "ম্যাচবক্স আন্দোলন" হিসেবে অভিহিত করেন নিজেরা। করোনাকালীন দুঃস্থ মানুষদের সহায়তাসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও অংশগ্রহণ করেছে বিএমসিসি-র সদস্যরা৷
বিএমসিসি-র পক্ষ থেকে বাংলাদেশের একমাত্র শখ বিষয়ক পত্রিকা ত্রৈমাসিক 'শখের মানুষ' প্রকাশনা হয় ২০১২ সাল থেকে। ২০২১ সাল থেকে তারা 'দেশলাই জার্নাল' নামে ফিলুমেনিস্টদের একটি ত্রৈমাসিক জার্নালও বের করছেন।
গত বছর থেকেই তারা বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক দেশলাই প্রদর্শনীর আয়োজন শুরু করে অনলাইনে। জানুয়ারি মাসের শুরুতে আয়োজিত হওয়া সেই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন ১৯টি দেশের ৫২ জন ম্যাচবক্স সংগ্রাহক। এই প্রদর্শনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরে সুইস ম্যাচবক্স মিউজিয়াম ও ইংল্যান্ডের ম্যাচবক্স সংগ্রাহকদের ক্লাবও প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বলে জানান সাকিল হক। এবছরও বিএমসিসির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক দেশলাই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে অনলাইনে।
২০১৯ সাল থেকে সাকিল হল 'ম্যাচবক্স শপ' নামে অনলাইন শপে তার ডিজাইন করা ম্যাচবক্স বিক্রি করতে শুরু করেন। ডিজাইন অনুযায়ী তার ম্যাচবক্স গুলো ২৫ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্যে পাওয়া যায়। তবে ম্যাচবক্স নিয়ে কারো তুমুল আগ্রহ দেখলে সাকিল উপহার হিসেবেই তাকে ম্যাচবক্সের পার্সেল পাঠিয়ে দেন।
সাকিলের সংগৃহীত ম্যাচবক্স গুলো আগে ঢাকায় তার নিজের বাসাতে রাখলেও বর্তমানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আলাদা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। সাকিল হকের স্বপ্ন একদিন কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানায় পরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে তুলবেন দেশের প্রথম ম্যাচবক্স জাদুঘর। তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহযোগী হতে অনেকেই আশ্বাস দিলেও কার্যকরভাবে কেউ এগিয়ে আসেনি। তাই নিজের চেষ্টাতেই যতটুকু পারা যায় স্বপ্নের দিকে এগুচ্ছেন সাকিল।
তিনি বলেন, 'ম্যাচবক্সের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক। কখনো অসুখ হলে আমি আমার ম্যাচবক্সের সংগ্রহের পাশে গিয়ে দাঁড়াই, এগুলো আমাকে সেরে উঠতে সাহায্য করে।'