কাজীদা, উই লাভ ইউ, ম্যান
ফিচার
১০ বছর আগে লিখেছিলাম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি। কারণ এই লেখা পড়েই প্রিয় কাজীদা (কাজী আনোয়ার হোসেন) চোখের জল ফেলেছিলেন এবং অচেনা অপাংক্তেয় এক তরুণের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, বিলেতযাত্রার সময় বিরক্তিকর বিমানযাত্রার ফাঁকে একটা লেখা লিখেছিলাম, এবং বিলেতে পা দিয়ে বাসে ইন্টারনেট পাওয়ামাত্রই তা সচলায়তনে পোস্ট করেছিলাম। লেখাটি ছিল কাজীদার জন্মদিন উপলক্ষে, কিন্তু আজকে, তার প্রস্থানের দিনেও লেখাটি সমান প্রাসঙ্গিক; কারণ যতদিন এই জাতিতে স্বপ্নবাজ কেউ থাকবে, বইপড়ুয়া কেউ থাকবে, ততদিন কাজী আনোয়ার হোসেন অমর হয়ে থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত প্রতিদিনই তার জন্মদিন, কারণ পাঠকের মনে তার মৃত্যু নেই। তাকে নিয়ে আমরা শোক করি না, গর্ব করি।
কাজীদা, মানে আমাদের কাজী আনোয়ার হোসেন, সেবা প্রকাশনীর জন্মদাতা, কর্ণধার, কোটি কোটি বাঙালির আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নের পৃষ্ঠপোষক, কুয়াশার লেখক, বাংলা ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অনুবাদকদের অন্যতম, এবং বাংলা বইয়ের জগতের জনপ্রিয়তম চরিত্র মাসুদ রানার জনক।'
কী! এতেই শেষ হয়ে গেল কাজীদার পরিচয়? না, কাজীদার সর্বগুণের সন্ধান দেওয়া অথবা সেই মানুষটাকে কাগজে আঁকার ক্ষমতা আমার মতো নাদানের কলমের থাকলে এতদিন বাংলা সাহিত্য আরেক দিকপাল হয়তো পেয়েই যেত। যেহেতু তা হয়নি, তাই খুব সংক্ষেপেই বলি—কাজীদার কথা শুনলেই আমার আকাশের কথা মনে হয়—অসীম মহাশূন্য, বিশাল যার ব্যপ্তি, যার কোনো শেষ নেই, সেই আমাদের কাজীদা, কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন নবাব।
কাজীদার জন্মদিন ১৯ জুলাই, কততম তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, পত্রিকায় হয়তো আসবে ৮৬তম, কিন্তু কাজীদা ৯০ হোন বা ৪৫ তাতে কি যায়-আসে! যে মানুষটি সমান কর্মস্পৃহা নিয়ে কোটি কোটি পাঠকের চাহিদা ও ভালবাসাকে মাথায় রেখে যুগের পর যুগ আমাদের অমৃত জুগিয়ে চলেছেন তার বয়সের ক্ষেত্রে একটি উপমাই মানানসই—চিরসবুজ তিনি, চিরতরুণ তিনি। গল্পের মাসুদ রানার বয়স যেমন আটকে আছে তিরিশের কোঠায়, আমাদের কাজীদার বয়সও তেমনি আটকে গেছে সেই ১৯৬৪ সালেই, পেপারব্যাকের নিউজপ্রিন্টের পাতা এবং পাঠকের ভালোবাসার সঙ্গে।
ঠিক কবে সেবার সঙ্গে পরিচয়, এই নিয়ে তিন গোয়েন্দার এক লেখাতে কিছু ঘটনা বলেছিলাম। কিন্তু কাজীদা ছিলেন অনন্য, জুলিয়াস সিজারের চেয়েও অনেক অনেক কম সময়ে অকল্পনীয় দ্রুতগতিতে এক কিশোরের মনোজগত দখল করে ফেলে আদরের সঙ্গেই হাসি মাখা মুখে বলেছিলেন—ভিনি ভিডি ভিসি! বইটির নাম যে ছিল রবিনহুড! অনেকের মতেই সেবার এবং কাজীদার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি! পদ্মাপারের রাজশাহীর ধূসর বিকেল থেকে একটানে সেই স্বপ্নালু কিশোরকে নিয়ে গেলেন তিনি নটিংহ্যামের ঘন সবুজ শেরউড অরণ্যে, ঘোড়া দাবড়িয়ে সে ঘুরে বেড়াল সাত কুড়ি মুক্ত স্বাধীনপ্রাণ অনুচরের সঙ্গে, বনে গেল কল্পনার ফানুস উড়িয়ে, শরীরে লিংকন গ্রীন চড়িয়ে তাদেরই একজন হয়ে। সেই স্বপ্নমাখা আবির মোছেনি আজও মুগ্ধ কিশোরের। সেই থেকেই শুরু হয়েছে আমৃত্যু সেবা সম্মোহনে আকৃষ্ট হয়ে পথ চলা।
অবাক এবং বিরক্ত হয়ে লক্ষ্য করেছি কাজীদার কথা আসলেই সবাই দেখি কেবল মাসুদ রানা নিয়ে প্রশ্ন করে, জানতে চায় কুয়াশা নিয়ে, কিন্তু আমরা কি ভুলে গেছি সারা বিশ্ব ভান্ডার খুঁজে কী এক একখানা অসাধারণ ছোটগল্প তিনি বাঙালি পাঠকের উপযোগী করে সুস্বাদু মশলা মাখিয়ে পাতে তুলে দিতেন? এভাবেই আমরা পেয়েছিলাম 'পঞ্চ রোমাঞ্চ', 'তিনটি উপন্যাসিকা', 'ছয় রোমাঞ্চ', 'ছায়া অরণ্য', এবং 'কাজী আনোয়ার হোসেন নির্বাচিত রোমাঞ্চগল্প'ও। অনুবাদক তো দুই বাংলা মিলিয়ে কয়েক লক্ষ আছেন, সবার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি কাজীদার অনুবাদের বা রূপান্তরের পাশে কেন, পিছনে দাঁড়াবার মতো অনুবাদকের সন্ধান আজ পর্যন্ত আর মিলল কোথায়! আর সেটি কেবল রোমাঞ্চ গল্প বলে নয়, সিরিয়াস সাহিত্য নিয়েও, পড়েছেন কি কাজীদার অনুবাদের রিচার্ড কনেলের সবচেয়ে বিপদজনক শিকার? যদি পড়ে থাকেন, তাহলে বুঝে গেছেন কী বলতে চাইছি, আর যদি না পড়ে থাকেন—এখনই পড়ে ফেলুন। বুঝবেন কী রসসুধায় বঞ্চিত ছিলেন এতদিন! অথবা হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের মন্টেজুমার মেয়ে?
কাজীদার রূপান্তরিত প্রথম যে গল্পটি পড়া হয়েছিল তা রহস্যপত্রিকার কল্যাণে, নাম ছিল 'জালিয়াত'। অসাধারণ এক গল্প, বাঙালি ঢঙ্গে বলা, এমনই কারুকার্য করেছিলেন কাজীদা যে উত্তমপুরুষে বলতে যেয়ে নিজেকেই গল্পের একজন চরিত্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। সেখানে তার ঠাকুরদার ভাই মিজান কাজীর(?) সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম প্রথমবারের মত তাহিতি ভ্রমণে , পরিচয় হয়েছিল পল গগ্যাঁ এবং সমারসেট মম এই নাম দুটোর সঙ্গে। সেইসঙ্গে পেয়েছিলাম সান্দ্রো বত্তিচেল্লীর বার্থ অভ ভেনাসের অপূর্ব বর্ণনা (এর অনেক অনেক বছর পরে ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারিতে আসল বার্থ অভ ভেনাসের চোখ চোখ রেখে ফিরে গিয়েছিলাম অন্য আলোর শৈশবে, কাজীদার কাছে ঋণ বেড়েছিল একলাফে কয়েক গুণ)। অ্যাবাকাস ব্রেনের যোগসাজশে অনেকদিন ধরে ভেবেইছিলাম যে এটি আসলেই কাজী পরিবারের সত্য ঘটনা! অবশ্য আমি একা নই, একবার সেবার বইয়ের আলোচনা বিভাগে দেখিছিলাম এক সরলমনা দেশপ্রেমী তরুণ লিখেছে—'কাজীদা, যতদূর জানি আপনি বিসিআই-এর প্রধান, আমি সেখানে যোগ দিতে ইচ্ছুক, কী করতে হবে?' কাজীদা কিন্ত এমন পাগল ভক্তের অদ্ভুতুড়ে কথায় বিন্দুমাত্র উষ্মা প্রকাশ করেননি, একজন খাঁটি মানুষের মতোই বলেছিলেন—'গ্রাজুয়েশন করে দরখাস্ত করো, আর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখো!'
অনেক আগে আলোচনা বিভাগে প্রকাশিত এক পাঠকের লেখা চিঠিতে সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছিল মাসুদ রানার সঙ্গে প্রকাশিত একগুচ্ছ অভিজ্ঞতা—সাগরের ভাটার টানে পড়ে মারা যেতে বসেছিলেন তিনি, শরীর ছেড়ে দিয়েছে, এমন সময় মনে হয়েছে তার: রানা এই অবস্থায় থাকলে কী করত? নিশ্চয় মাথা ঠান্ডা রাখত, স্রোতের বিরুদ্ধে যুঝে অযথা শক্তিক্ষয় করত না, বরং সুবিধাজনক সময়ের অপেক্ষায় থাকত—সেই যাত্রায় প্রাণ রক্ষা পায় তার! আরেকবার পকেটে টিউশনির বেতন নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন তিনি, পাশের গলিতে দেখলেন ছিনতাইকারী চাকু ধরেছে কারো উদ্দেশ্যে। প্রথমেই ভাবলেন—বেতনের টাকা পকেটে, ঝামেলার দরকার নেই, উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরেছেন, হঠাৎ মনে হল রানা এই অবস্থায় কী করত? নিশ্চয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করত! ব্যস, ঘুরে হুংকার দিয়ে এগোলেন ছিনতাইকারীর দিকে, তারা তখন ভোঁ দৌড়!
আহ, সেবার আলোচনা বিভাগ! কী দারুণ এক বাড়তি আকর্ষণ, কত আবদার পাঠকদের, কত আকুলিবিকুলি করা তথ্য! এমন যুগান্তকারী লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলা কি এর আগে কেউ শুনেছে না দেখেছে! কি প্রাণবন্ত সব চিঠি, আর দুর্দান্ত মায়ামাখা তাদের উত্তর। এই-ই হচ্ছে সেবার জাদু, শুরু করলাম ছোট গল্প দিয়ে হাজির হয়েছি অবলীলায় আলোচনা বিভাগে! কিন্তু কাজীদার সৃষ্টি যে এমনই, জীবনের প্রতি অলিগলিতে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, একটা ফেলে আরেকটা নিয়ে বলা সম্ভব না।
এই আলোচনা বিভাগেই এক কিশোরের চিঠিতে জানলাম সে তার বাবার বালিশের নিচে কাজীদার অসাধারণ কীর্তি 'যৌন বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান' খুঁজে পেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এক নিমিষে পড়ে ফেলে এবং অজস্র ধন্যবাদ দেয় লেখককে তার কৈশোরের অনেক ভয়াবহ ভুল ভেঙে দেবার জন্য! যৌন বিষয়ে সাধার ণজ্ঞান! কী অদ্ভুত ধরনের নিষিদ্ধ নাম, এই নামে আবার বইও প্রকাশিত হতে পারে, তা ছিল কল্পনারও অতীত! যদিও বিদ্যুৎ মিত্রের নামে বইটি ছাপা হয়েছিল, কিন্তু ততদিনে সবাই জেনে গেছে এটি কাজীদারই একাধিক ছদ্মনামের একটি। ইঁচড়েপাকা এক বন্ধু অশেষ উপকার করল বইটি ধার দিয়ে। যে বইটি কাজীদা লিখেছেন তার জ্যেষ্ঠ সন্তানের উদ্দেশ্যে, যেখানে বলেছেন আমাদের রক্ষণশীল সমাজে অতি গুরুত্বপূর্ণ যৌন শিক্ষাকে এমন ভয়ের এবং গোপনীয়তার চোখে দেখা হয় যা শেষ পর্যন্ত তা নিয়ে ভুল শিক্ষা পেতে হয় ইঁচড়েপাকা বন্ধু নতুবা বাড়ির কাজের মানুষদের কাছে, এবং এই ভুল তথ্যগুলো অনেকাংশেই দুর্বিষহ করে তোলে কোমলমতিদের কৈশোর! তার নিজেরও তা-ই হয়েছিল, কিন্তু এমনটা যেন তার সন্তানের অথবা আমাদের না হয়, তাই কলম দিয়ে ভাঙতে চেয়েছিলেন সেই ফালতু সংস্কারের দেয়াল, জ্ঞানের আলোকে।
কাজীদা হচ্ছেন আমাদের সত্যিকারের সব্যসাচী। এককালে পেশাদার গায়ক ছিলেন, পরবর্তীতে সুপার হিট গানের গীতিকার, এমনকি পুরস্কার পাওয়া সংলাপ নির্মাতা, দুর্দান্ত মাছশিকারি, গিটার বাদক, আলোকচিত্রগ্রাহক, সেইসঙ্গে একজন দক্ষ ব্যবসায়ী তো বটেই। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বইবিমুখ একটি জাতিকে আস্তে আস্তে নানাভাবে বই পড়ার দিকে আকৃষ্ট করা এবং জ্ঞানভাণ্ডের সন্ধান দেওয়া।
ভাবতে পারেন, কোথায় থাকতাম আমরা, যদি কেবল সেবার ক্ল্যাসিক আর অনুবাদগুলো না থাকত! বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হতো কি করে! মার্ক টোয়েনের টম আর হাক আমাদের প্রাণের বন্ধু হয়ে উঠত কি? কিংবা প্রেইরির ছোট্ট মেয়ে লরা এবং কিষাণবালক আলমানযো? জুল ভার্নের অমর লেখনীর স্বাদ পেতাম কী করে মাতৃভাষায়! আজব সিরিজের বইগুলোর মাধ্যমে কত রহস্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে আমাদের পিপাসু মন, শিকার কাহিনিগুলো নিয়ে গেছে সুন্দরবন থেকে আফ্রিকার অবারিত সাভান্নায়। বুকে হাত রেখে বলুন, সেবা ছাড়া জীবন ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যেত কি না?
অসম্ভব প্রচারবিমুখ একজন মানুষ কাজীদা। আমাদের আত্মপ্রচারের সমাজ এবং সংস্কৃতিতে কাজী আনোয়ার হোসেন এক হিমালয়ের নাম, যিনি চারপাশের মানুষের কাছ থেকে শেখেন না নিজের ঢোল নিজে পেটানোর ফালতু বাকোয়াজ, গিরিরাজের মতই আপন গরিমা নিয়ে নিয়ন্ত্রিত করেন নিজের আলয়। আমাদের মন্ত্রীরাও যেখানে ফালতু আলোচনাসভায় টেলিভিশনের ক্যামেরা ভাষণের পরে পৌঁছালে, স্রেফ ক্যামেরায় চেহারা দেখাবার জন্য ভাষণের জায়গায় জনশূন্য হলে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবার অভিনয় করেন, তথাকথিত সুশীল সমাজ নাকি সমাজের বোঝারা সুযোগ পেলেই টক শো (নাকি তিতা শো?) করে বেড়ায়, সেখানে কাজীদার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া ছিল তিব্বতের মালভূমি পায়ে হেঁটে অতিক্রমের মতই দুরূহ! আর টেলিভিশনে তার চেহারা! কে কবে দেখেছে? এই প্রসঙ্গে চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগরের এক লেখায় পড়লাম, বছর কয়েক আগের ১৯ জুলাই চ্যানেল আইয়ের পক্ষে থেকে সকাল বেলাতেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গেলে কাজীদা আগত আগন্তুকদের সঙ্গে কথা বলেন, ফরিদুর রেজা সাগরের সঙ্গেও ফোনে বাক্যালাপ হয়, কিন্তু টিভি ক্যামেরা তার বাড়িতে ঢুকতে দেননি!
আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি স্বাধীন বাংলাদেশের যতখানি অগ্রগতি হয়েছে গত কয়েক দশকে, তার পিছনে যে গুটিকয়েক ব্যক্তির অবদান সবচেয়ে বেশি তাদের মাঝে অন্যতম কাজী আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশ গড়ার পিছনে নোবেল দেবার নিয়ম থাকলে উনিই হতেন তার যথার্থ দাবিদার। জ্ঞানী মানুষ তো আছেনই আমাদের সমাজের সর্বস্তরে ( জ্ঞানপাপীরও অভাব নেই), কিন্তু নিজের জ্ঞানপিপাসাকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া, নিজের আত্মবিশ্বাস, জীবনদর্শনকে আমজনতার জীবনে ঢুকিয়ে দেওয়া এবং সর্বোপরি স্বার্থপরের মতো জীবন ও সাহিত্য সম্ভোগে নিয়ত না থেকে সেই অনাবিল আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া—এমন লোক সারা বিশ্বেই বিরল। এমনটিই করেছেন তিনি, বিশ্বসাহিত্যে তোলপাড় করে কুড়িয়ে এনেছেন সেরা রত্নরাজি, তাতেই ক্ষান্ত হননি, পাঠকের উপযোগী করে সামনে তুলে ধরেছেন, যখন সময়ের অভাবে এই কাজগুলো ব্যাহত হচ্ছিল, ঠিকই খাঁটি জহুরির মতো পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন শেখ আবদুল হাকিম, রকিব হাসান, রওশন জামিল, নিয়াজ মোর্শেদ, মাসুদ মাহমুদ, জাহিদ হাসান, খসরু চৌধুরীর মতো লেখক-অনুবাদকদের। যারা বিমোহিত করেছেন পাঠক চিত্ত আবির্ভাবের সন্ধিক্ষণ থেকেই।
রহস্যপত্রিকা। আর কিছু নয় কেবল রহস্যপত্রিকাই যথেষ্ট ছিল সেবাকে অমর করে রাখার জন্য। কী জানতে পারিনি রহস্যপত্রিকা থেকে এককালে? গ্যালোপাগোসের জীববৈচিত্র্য, নাজকার রহস্যময় আঁকিবুঁকি, লক নেসের দানব, মাচু পিচুর নির্জনতা, ফারাওয়ের কাহিনি, সাহারার হাতছানি, আমাজনের দুর্গমতা, সুমেরু-কুমেরুর অভিযান, আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার, এনগোরংগোরোর জ্বালামুখ, বাহামার গুপ্তধন, গ্রিনল্যান্ডের মেরুজ্যোতি, প্রিয় লেখক-অভিনেতা-গায়ক-গোয়েন্দা-অভিযাত্রীদের জীবন—সব। জীবনে যা নিয়ে মেতে রয়েছি, যা নিয়ে জানতে চেয়েছি, তার প্রায় সবকিছুরই শুরু সেবার রহস্যপত্রিকা থেকে। কাজীদা না থাকলে কোথায় পেতাম এমন সুলভ জ্ঞানভান্ডার, যা উসকে দিত কল্পলোকের ঘোড়াগুলোকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে! জানি রহস্য পত্রিকার সেই রমরমে দিন আর নেই অনেক অনেক বছর, কিন্তু পুরনোগুলো তো এখনো সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মত, সেগুলোই তো খুঁজে ফিরি ফুটপাতের পুরনো বইয়ের দোকানে খ্যাপার মত। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম কিশোরপত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। এমন মানসম্পন্ন বৈচিত্রময় পত্রিকা কিশোরদের কথা ভেবে আর কেউ করতে পেরেছে কি?
অনেক আগে আলোচনা বিভাগে প্রকাশিত এক পাঠকের লেখা চিঠিতে সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছিল মাসুদ রানার সঙ্গে প্রকাশিত একগুচ্ছ অভিজ্ঞতা—সাগরের ভাটার টানে পড়ে মারা যেতে বসেছিলেন তিনি, শরীর ছেড়ে দিয়েছে, এমন সময় মনে হয়েছে তার: রানা এই অবস্থায় থাকলে কী করত? নিশ্চয় মাথা ঠান্ডা রাখত, স্রোতের বিরুদ্ধে যুঝে অযথা শক্তিক্ষয় করত না, বরং সুবিধাজনক সময়ের অপেক্ষায় থাকত—সেই যাত্রায় প্রাণ রক্ষা পায় তার! আরেকবার পকেটে টিউশনির বেতন নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন তিনি, পাশের গলিতে দেখলেন ছিনতাইকারী চাকু ধরেছে কারো উদ্দেশ্যে। প্রথমেই ভাবলেন—বেতনের টাকা পকেটে, ঝামেলার দরকার নেই, উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরেছেন, হঠাৎ মনে হল রানা এই অবস্থায় কী করত? নিশ্চয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করত! ব্যস, ঘুরে হুংকার দিয়ে এগোলেন ছিনতাইকারীর দিকে, তারা তখন ভোঁ দৌড়!
এমনভাবেই কল্পলোকের এক চরিত্র ঠাঁই করে নিয়েছে আমাদের প্রতিদিনের নিত্যকার একঘেয়ে জীবনে। সবচেয়ে গর্বের কথা মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক বীর সেনানী জানিয়েছেন, তারা দেশমাতৃকার জন্য জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা পেয়েছেন মাসুদ রানা এবং কুয়াশা থেকে।
মাঝে মাঝেই মনে হয় এতসব অসামান্য কাজ একজন মানুষের পক্ষে এতদিন ধরে করে আসা সম্ভব না আমাদের ঘুণে ধরা সমাজে, হয়তো বেশ কজন আনোয়ার হোসেন আছেন, যারা একই নামের আড়ালে কাজ করেন! যেমন জেনেছিলাম, জুল ভার্নের অসাধারণ অনুবাদক শামসুদ্দিন নওয়াব বলে আসলে কেউ নেই, কাজীদার পুরো নামের মাঝখান থেকে শামসুদ্দিন আর ডাকনাম নবাব থেকে নওয়াব নিয়ে সেই লেখকের নামের আড়ালে লিখে চলেছেন একাধিক লেখক। কিন্তু কাজীদার ভাষার গন্ধই আলাদা, এক মাসুদ রানা বিশেষজ্ঞ বন্ধু বলেছিল স্কুল জীবনে রানার অনেক বই-ই নানা ছায়া লেখকদের লেখা, কাজীদা পরবর্তীতে ঘষে-মেজে দেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই উনি নিজে পুরো বইটির কাজ করেন, আর সেই বিশেষ বিশেষ বইগুলোর শুরু থেকেই পরতে পরতে থাকে কাজীদার ট্রেডমার্ক—ঝরনাধারার মতো সাবলীল ভাষা, রোমাঞ্চের ঠাস বুনট, তীক্ষ্ণ সংলাপ আর রসবোধের সমন্বয়। যে কারণে 'অগ্নিপুরুষ', 'আই লাভ ইউ, ম্যান', 'সেই উ সেন' পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে দেওয়া যায় এই অ্যাডাপ্টেশনের কাজ স্বয়ং মাসুদ রানার, থুড়ি তার জন্মদাতার।
কাজীদা জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন না যে তারই এক ক্ষুদে পাঠক ছয় মাস আলো—ছয় মাস আঁধারের রাজ্য উত্তর মেরুতে পা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছে তার অমর লেখনীকে, মনে করেছে ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসকে। মেক্সিকো উপসাগরের অতলে ডুব দেবার সময় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো যার মনে পড়েছে সেই ঝকঝকে সম্মোহনী বাক্যগুলো, যা উৎসাহ জুগিয়েছে অথৈ সাগরের তলদেশে হাঙরের ভয় ভুলে মাছেদের ঝাঁকের মাঝে নিজেদের আবিষ্কার করতে। রাঙামাটির পাহাড়-হ্রদে যার পাগলপারা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়েছে এই স্থান চিরচেনা হয়ে আছে মনের পর্দায় ধ্বংসপাহাড়ের কবির চৌধুরীর আস্তানার কল্যাণে। যেমনটি হয়েছিল গুয়াতেমালার সীমান্তে জাগুয়ার-অধ্যুষিত চিরসবুজ গহীন অরণ্যে মায়ান শহরে, ইউরোপ-এশিয়ার সংযোগ রক্ষাকারী ইস্তাম্বুলের সেতু পেরোতে, ভেনিসের গন্ডোলায়, প্যারিসের জাদুঘরে, প্রাগের নির্জন রাস্তায়, মধ্যপ্রাচ্যের ধু-ধু বালিয়াড়ির মাঝে, দানিয়ুবের তীরে, নয়াদিল্লীর বাজারে, লন্ডনের বৃষ্টিতে, আল্পসের বরফে, লেলিনগ্রাদের খালে, আফ্রিকার বুনো প্রান্তরে, মিলানের ভিড়ে, কিম্বার্লির হীরক খনির শহরে, ক্যারিবীয় দ্বীপের ঝড়ে, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে—কোথায় না! কৃতজ্ঞতায় বিমূঢ় বালক বুঝেই উঠতে পারে না সেবা ছাড়া, কাজীদা ছাড়া সে এগোত কী করে জীবনের বন্ধুর সুন্দর পথে?
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.