নন্টে ফন্টে এবং বাঁটুল দি গ্রেটের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ যেভাবে বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকে পড়লেন

ফিচার

18 January, 2022, 08:05 pm
Last modified: 19 January, 2022, 04:20 pm
নারায়ণ দেবনাথ—ছিলেন বাঙালির অতি আপনার জন। হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে ফন্টের হাত ধরে তিনি ঢুকে পড়েছিলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। কীভাবে সম্ভব হলো এই ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করা?

মুন্সিগঞ্জে ছিল তার পৈতৃক নিবাস। জানার পর আরো আপন মনে হয়েছিল মানুষটিকে। আজ মঙ্গলবার তাকে হারিয়ে ফেলার পর স্বজন হারানোর বেদনাই বোধ করছি। তিনি নারায়ণ দেবনাথ। হাঁদা ভোঁদা (১৯৬২), বাঁটুল দ্য গ্রেট (১৯৬৫), নন্টে ফন্টে (১৯৬৯) কমিকসের স্রষ্টা।

মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি থানার আব্দুল্লাপুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। ঘোষেদের কাছ থেকে দাদা ৬৫ সালে একটি তিন মহলা বাড়ি কিনলে আমরা চর সলিমাবাদ থেকে উঠে এসেছিলাম আব্দুল্লাপুর। আরো পরে মনে হয় সত্তর সালে নানা পালদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন একটা বিরাট্ বাড়ি। তার ঘর-ভিটিই ছিল আটটি। কোনোটিকে আমরা বলতাম বেজির ঘর, কোনোটা সাপের ঘর। আমরা থাকতাম মাঝের ঘরটায়, পড়ার জন্য ছিল আলাদা আরেকটা ভিটি। উঠানের মাঝখানে একটা তুলসী মণ্ডপ এখনো আছে বাড়িতে। যে ভিটিগুলো খালি পড়েছিল সেখানে আমার বোন গোলাপ চাষ করত। কলপাড়ের খালি ভিটায় একটা কামিনী গাছ আছে আজো।

আমাদের বড় ভাই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ক্যাসেট প্লেয়ারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নয়তো মান্না দের গান বাজাতেন। আমাদের মুখোমুখি বাড়িটা ছিল দে বাড়ি। সেখানেও আট-দশটি ভিটিঘর ছিল। পুণ্যদি, মাধবীদি ছিল সে বাড়ির প্রধান আকর্ষণ। আমার বেশি সখ্য ছিল পুণ্যদির সঙ্গেই। ওদের একাংশ ততদিনে কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছে।

তবে বছরের মাঝখানে বা পুজোয় দেশে এলে সানন্দা, আনন্দবাজারের সঙ্গে নন্টে ফন্টে বা চাচা চৌধুরী (প্রাণের) নিয়ে আসত। আমাদের বাজারে ননী ঘোষের যে মিষ্টির দোকান ছিল, সেখানেও বাটুল বা হাদা ভোদার কমিকস পেতাম। সেটা অবশ্য অন্য উপায়ে। ওরা নিমকি বা বালুশাই মুড়িয়ে দিত ওইসব কমিকস পাতায়। আমি খেতে খেতে ফিরতাম, কাগজটা ফেলতাম না। পরে আমি আর পুণ্যদি মিলেঝুলে পড়তাম। পুণ্যদির বেশি ভালো লাগত নন্টে-ফন্টে আমার পছন্দ ছিল বাটুল। 

আমি রোগাপাতলা ছিলাম বলেই বুঝি বাঁটুলের মতো বক্ষবীর হতে চাইতাম। ওস্তাদদের সঙ্গে সে জিতে গেলে বুঝি জিতে যেতাম নিজেই। তবে বাটুলের হাফপ্যান্ট আমার বেশি পছন্দের ছিল না। ক্লাস সিক্সের পর যে আমি হাফপ্যান্ট  পরিইনি। লুঙ্গি পরে স্কুলে যাওয়াতেও নিষেধ ছিল না আমাদের। তবে মানছি, হাফ প্যান্ট বয়সে ফিরতে চাইলে মনে হয় বাঁটুলেই ফিরতে হয়। এখন পড়ে জানলাম, আসলেই তো বাঙালির কোনো সুপারহিরো বলে কিছু ছিল না। বাঁটুলই আমাদের সুপার হিরো। এই বাটুল বীরবক্ষাকে বিশ্লেষকরা ভাবাচ্ছেন পঁয়ষট্টির পাক-ভারত বা একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সমানতালে। খানসেনাদের প্যাটন পেটা করে বাঙালির একান্ত জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরেছিল বাঁটুল।

পথিকৃৎ তিনি

নারায়ণ দেবনাথকে বাংলা কমিকস সাহিত্যের পথিকৃৎ বলতে অনেকেই পিছপা হন না। তারা বলছেন, বাঙালির ছোটবেলা কেটেছেই সকাল-বিকেল-দুপুর হাঁদা-ভোঁদা কিংবা বাঁটুল দ্য গ্রেটের কাণ্ডকারখানায় চোখ ডুবিয়ে। ১৯২৫ সালে হাওড়ায় তাঁর জন্ম। ভর্তি হয়েছিলেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের চিত্রকলা বিভাগে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা। তাই পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি তবে ততদিনেই আপন উৎসাহে রপ্ত করে ফেলেছেন আঁকাআঁকির সব কলাকৌশল আর দর্শন। 

ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন প্রসাধনসামগ্রীর লোগো, মাস্টহেড আর সিনেমা কোম্পানীর লিফলেট এঁকে। কাজের মান ভালো ছিল, নাম ছড়িয়ে পড়তে দেরী হয়নি। তবে আরো নতুন কিছু করতে চাইছিলেন। শুকতারা পত্রিকা হাতে এসে যায় তখনই। শুরু করলেন হাঁদা-ভোঁদা। দুজনেই দুজনকে জব্দ করতে ব্যস্ত। একেবারে বাঙালির ঘরের দুষ্টুমি। রাগী পিসেমশাইও পেল পাঠক। ব্যস আর যায় কোথা, হাঁদা ভোঁদা ঘুরে ঢুকে পড়ল ঘরে। 

সেই ১৯৬২ সাল থেকে ৫০ বছর হাঁদা-ভোঁদা এঁকে গেছেন নারায়ণবাবু। বিশ্ব ঢুঁড়লেও বুঝি এমনটা বেশি পাওয়া যাবে না। পরে দেব সাহিত্য কুটির থেকে এগুলো খণ্ডে খণ্ডে বেরুতে থাকে। নারায়ণবাবুর প্রথম রঙিন কমিক স্ট্রিপ ওই বাঁটুল দ্য গ্রেট। 

তিনি নিজেই বলেছেন, কলকাতার কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের কল্পনা করেন ও সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেন। বাঁটুলকে তিনি পরালেন স্যান্ডো গেঞ্জি আর কালো হাফপ্যান্ট। বছর যতই বাড়ল, বাটুলের কিন্তু নড়চড় নেই। বয়স আর পোশাক একই জায়গায় থেমে থাকল। প্রচণ্ড শক্তিশালী সে। মাথায় বিরাট হাতুড়ি মারলে তার মনে হয় এক ফোঁটা জল পড়ল। তার পা সবসময় খালি। তার দুই স্যাঙাত গজা ও ভজা। তার প্রতিবেশী বটব্যাল বাবু। কুকুর-বিড়াল নয় বাটুল পোষে উটপাখি। দিনে দিনে বাঁটুল হয়ে উঠল বাঙালির কল্পনার বীরবাহাদুর যা সে হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে শেষ বয়স পর্যন্ত।

প্রথমদিকে যা হয়েছিল

 সেই শুরুর দিকে লালমাটি প্রকাশনার নিমাই গড়াইকে গিয়ে নারায়ণবাবু বলেছিলেন, জেঠু কমিকস বই করবেন? জেঠু হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি! বললেন, কমিকস নিয়ে আবার বই হয় নাকি!

তাই বলে কিন্তু নিমাইবাবুর সঙ্গে কখনোই সম্পর্ক হয়নি নারায়ণবাবুর। শেষবার যখন দেখেছিলেন জেঠুকে তখন তাঁর কাজ করার ক্ষমতা একেবারেই কমে গিয়েছিল। বাজার করতে ভালোবাসতেন জেঠু। খেতে ভালোবাসতেন। কালোজাম প্রিয় ছিল। যেসব গল্পগুলো এঁকেছিলেন নিমাই গড়াই সেগুলোতেও তাঁর পছন্দের খাবারগুলো বারবার ফিরে এসেছে।

কেন তিনি ঘরে ঘরে ঢুকে পড়তে পারলেন?

নারায়ণ দেবনাথ হিউমার সৃষ্টি করতেন একেবারে বাঙালি কেতায়। তিনি ভুইফোড়, লোক ঠকানো, ফ্যাশন সর্বস্ব পোশাকের দোকানের নাম রেখেছিলেন অঙ্গবাহার আবার সাদাসিধে পোশাক বিপণির নাম দিয়েছিলেন অঙ্গঢাকা। বাঙালির পছন্দ হবে না কেন?

সাম্প্রতিককালের জনপ্রিয় তিনজন কার্টুন আঁকিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস বাংলাকে আরো খুলে বলেছেন কেন নারায়ণবাবু অতোটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন এবং কেন তাঁকে লোকে মনে রাখবে। একজন যেমন দেবাশীষ দেব। শীরষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটদের, কিশোর উপন্যাস এঁকে বিখ্যাত হয়েছেন তিনি। বলছিলেন, ওর আকার মধ্যে যে সহজ সরল বিষয়টি আছে তার আকরষণই আলাদা। খুবই অ্যাট্টাক্টিভ। তিনি লাইন ড্রয়িংয়ে ছিলেন ভীষণ পারদর্শী। আর এত ডিটেইলিং। ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোও কখনও বাদ পড়ত না তাঁর তুলি, কলম থেকে।

ছবি: সংগৃহীত

আরেকজন যেমন উদয় দেব। বলছিলেন, নারায়ণবাবুর হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। দেখুন দুনিয়াতে যত নামি কার্টুন চরিত্র নিয়ে কাজ হয়েছে বছরের পর বছর, তা কিন্তু টিম ওয়ার্ক। মানে কেউ এর গল্প লেখেন তো কেউ আকেন। এই গোটা কাজ নারায়ণবাবু একলাই সামলেছেন। একে ম্যাজিক ছাড়া কি বলব? তাঁর নন্টে ফন্টে দেখুন, ওদের ভাষা আমাদের সাধারণ মানুষের ভাষা। সহজ, মজার এবং কোথাও ছুকোছাপা নেই। ওরা কেউ বুট পরে, কোনো বড় বাড়ির ছেলে নয়। ছাপোষা মধ্যবিত্তরাই ফুটে উঠেছিল তাঁর রং তুলিতে।

শেষজন সুযোগ বন্দোপাধ্যায়। বাপ্পা রাও নামের জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের নির্মাতা। বলছিলেন, তিনি চরিত্র তৈরির পাশাপাশি সেটা মানুষের মাথায়ও ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। তার হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন্ই নেই। আমি অবাক কীভাবে তিনি তিন-তিনটি কমিক চরিত্র জনপ্রিয় করলেন! বলা শক্ত। আসলে যিনি পারেন, তিনি পারেন। এই ক্ষমতা নিয়ে কেউ কেউ জন্মান। নারায়ণ দেবনাথ ছিলেন তেমন ক্ষমতাধর একজন মানুষ।

শেষ কথা

পুণ্যদি অনেকদিন হয় দেশ ছেড়ে গেছেন। আমরাও অনেকদিন গ্রাম ছাড়া। লোকে আমাদের বাড়িটাকে জঙ্গলবাড়ি বলতে বাকি রাখে আরকি! নারায়ণবাবুও চলে গেলেন। যদি আবার কোনোদিন দিদির সঙ্গে দেখা হয় আব্দুল্লাপুরে কামিনীগাছের নিচে, হয়তো নন্টে ফন্টের গল্পও করব, বা দেখাব বাঁটুলের মতো বুক ফুলিয়ে সেইসব দিনের মতো।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.