পাঞ্জাব-সিন্ধের উটচালকদের গান থেকে জন্ম নেওয়া যে গান বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
15 January, 2022, 08:15 pm
Last modified: 12 May, 2022, 08:04 am
বহু কাল আগে বাণিজ্যের জন্যে আরব বণিকরা ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে আসত। বাণিজ্যের সওদা উটের পিঠে চাপিয়ে রাতের বেলায় তারা দল বেঁধে পথ চলত। পায়ের চলার ছন্দের সঙ্গে একধরনের ‘হু হু’ শব্দ যোগ করে কম্পনযুক্ত সংগীতের মতো সুর তৈরি করত তারা। সময়ের আবর্তে এটি পাঞ্জাবের উট চালকদের আঞ্চলিক সংগীতে পরিণত হয়। এ গানের বিষয়বস্তু ছিল প্রেম, আবেগ, বিরহ, ভালোবাসা। পাঞ্জাবে এই লোকসংগীতকে বলা হতো ‘ডপা’। পরে এই ডপাই হিন্দিতে টপ্পা নাম নেয়।

টপ্পা—চটুল প্রকৃতির দ্রুতগতির গান। সংগীতের প্রধান চার ধারার একটি হলো টপ্পা। হিন্দুস্তানি ও বাংলা—এ দুই প্রকারের টপ্পা রয়েছে। বাংলায় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই গান। বাংলায় কীভাবে এই টপ্পা গানের জন্ম হলো, তা এক চমকপ্রদ কাহিনি। কারণ, এ গানের আঁতুড়ঘর বাংলা নয়। টপ্পার গতি দ্রুত ও লঘু হয়। এতে আসর জমে ওঠে।

ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, টপ্পা গানের জন্ম পাঞ্জাব-সিন্ধ অঞ্চলের উট চালকদের গান থেকে।

বহু কাল আগে বাণিজ্যের জন্যে আরব বণিকরা ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে আসত। বাণিজ্যের সওদা উটের পিঠে চাপিয়ে রাতের বেলায় তারা দল বেঁধে পথ চলত। সে সময় পায়ের চলার ছন্দের সঙ্গে একধরনের 'হু হু' শব্দ যোগ করে কম্পনযুক্ত সংগীতের মতো সুর তৈরি করত তারা। সময়ের আবর্তে এটি পাঞ্জাবের উট চালকদের আঞ্চলিক সংগীতে পরিণত হয়। এ গানের বিষয়বস্তু ছিল প্রেম, আবেগ, বিরহ, ভালোবাসা। পাঞ্জাবে এই লোকসংগীতকে বলা হতো 'ডপা'। পরে এই ডপাই হিন্দিতে টপ্পা নাম নেয়। 

টপ্পার জন্ম সম্পর্কে রাধামোহন সেন তার 'সঙ্গীততরঙ্গ' বইয়ে লিখেছেন: 'পাঞ্জাব হইতে হইল টপ্পার জনম/ দুই চরণের মধ্যে তাহার নিয়ম।' 

রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখেছেন: 'টপ্পা ছিল রাজপুতনার উষ্ট্র চালকদের গীত। শোনা যায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব বণিক উটের পিঠে চেপে বাণিজ্য করতে আসত, তারা সারারাত নিম্নস্বরে টপ্পার মতো একপ্রকার গান গাইতে গাইতে আসত। তাদের গানের দানাদার তানকেই বলা হতো "জমজমা"। আসলে জমজমা শব্দে "দলবদ্ধ উষ্ট্র" বোঝায়। সাধারণভাবে উষ্ট্রবিহারিদের গানও এই শব্দের আওতায় এসে গেছে। লাহোরে উট বদল হতো। এই লাহোর থেকেই টপ্পার চলটি ভারতীয় সংগীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে।"

উত্তর ভারতে টপ্পাকে জনপ্রিয় করেন গোলাম নবি শোরী। তিনি ছিলেন নবাব আসফউদ্দৌলাহর দরবারের শিল্পী। জনশ্রুতি আছে, নতুন ধরনের সংগীতের খোঁজে তিনি উত্তর ভারতে গিয়ে পাঞ্জাব-সিন্ধ অঞ্চলের উটচালকদের কাছ থেকে টপ্পার ধারণা পান।

শোরীর পর সে কাজ এগিয়ে নেন তার শিষ্য গাম্মু মিয়া। এরপর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে টপ্পা।

বাংলায় টপ্পার আগমন

টপ্পাকে বাংলায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব দেওয়া হয় রামনিধি গুপ্তকে। আবার অনেকের মতে বাংলায় এই গান আসে কালী মীর্জার হাত ধরে। ১৭৮০-৮১ সালের তিনি হুগলিতে বাংলা টপ্পা গানের চর্চা শুরু করেন বলে দাবি কারও কারও।

তবে বাংলায় টপ্পা জনপ্রিয় হয় রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবুর হাত ধরেই। রামনিধির জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চাপ্তায়, মাতুলালয়ে। কলকাতায় এক পাদরির কাছে তিনি ইংরেজি ও ফার্সি শেখেন। ইংরাজি জানার সুবাদে কেরানির চাকরি পেয়ে যান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। ১৭৭৬ সালে তিনি বিহারের ছাপরা জেলার কালেক্টর অফিসে সেকেন্ড ক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করেন।

রামনিধি ছাপরাতেই প্রথম এক ওস্তাদের কাছে রাগ সংগীতের তালিম নিতে শুরু করেন। বিহারে থাকার সময়ই তিনি উত্তর ভারতের বিভিন্ন ধারার গানের সঙ্গে পরিচিত হন। ওই সময় লক্ষ্ণৌতে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল শোরীর টপ্পা। সম্ভবত সেখানেই টপ্পার সঙ্গে পরিচয় রামনিধির। 

বাংলা টপ্পার জনক রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধু বাবু

১৭৯৪ সালে কলকাতায় ফেরেন নিধুবাবু। সেখানে ফিরেই শোভাবাজারের একটা আটচালা ঘরে গানের আসর বসানো আরম্ভ করেন। এই আসরেই টপ্পার সূচনা করেন রামনিধি। এরকম নানা আসরের মধ্য দিয়েই রামনিধি গুপ্তর গান বিখ্যাত হয়ে ওঠে নিধুবাবুর টপ্পা নামে। তার গানের ভক্ত হয়ে ওঠেন বর্ধমানের মহারাজা তেজেশচন্দ্র রায়বাহাদুরও।

হিন্দি টপ্পার অনুকরণে বাংলা টপ্পা রচনা করলেও নানা রাগের মিশ্রণ আনায় রামনিধির টপ্পাতে নিজস্ব ছাপ ছিল। নিধুবাবুর টপ্পার অনেকাংশ জুড়েই ছিল মানবীয় প্রেম। তবে মজার ব্যাপার হলো, রামনিধির টপ্পাকে নারীদের প্রতি অশালীন ইঙ্গিত করা হতো বলে মনে করত তখনকার লোকে। 

এছাড়া তার গানে দেশপ্রেমেরও প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। 'নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা' এই গানেই তা ফুটে ওঠে।

তাছাড়া নানা লেখায় পাওয়া যায়, নিধু বাবুর বহু গানই তার প্রেমাস্পদ শ্রীমতী নামের এক নারীকে উদ্দেশ্য করে রচিত। শ্রীমতী ছিলেন মুর্শিদাবাদ কালেক্টরেটের দিওয়ান মহানন্দ রায়ের উপপত্নী। রামনিধির এই একপাক্ষিক প্রেম নিয়ে 'আমার গীতি' নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়। সেখানে নিধু বাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত শুরু হয় রামনিধির। লোকশ্রুতি আছে, ব্রাহ্ম সমাজ-মন্দিরে বসে একটি ব্রহ্মসংগীত রচনা করে শোনান তিনি। ১৮৩৭ সালে 'গীতরত্ন গ্রন্থ' নামে রামনিধির রচিত গানগুলোর একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। 

১৮৩৯ সালে মারা যান রামনিধি গুপ্ত। তার পর এই গানের ধারাকে সচল রাখেন শ্রীধর কথক। তার গানে রামনিধির প্রভাব ছিল প্রবল। শ্রীধর কথকের পর টপ্পা জগতের বিখ্যাত নাম মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত তার হাত ধরে সজীব থাকে গানের এই ধারার স্রোত। টপ্পার সর্বশেষ জনপ্রিয় গায়ক ছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২১-২০০৯)।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.