দেবদাসী ইন্দিরা হয়েছিলেন মহারানী 

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
29 December, 2021, 02:00 pm
Last modified: 29 December, 2021, 07:36 pm
কোরি ওয়ালিয়া মুম্বাইয়ের একজন মেকআপ আর্টিস্ট। কারিনা কাপুর, দীপিকা পাড়ুকোনের মতো অভিনেত্রীদের পছন্দের তালিকায় তিনি শীর্ষে। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান মেমোরি প্রজেক্টকে জানিয়েছেন, তার নানী মহারানী ইন্দিরা সালগাওকর ছিলেন একজন দেবদাসী।  
ছবি- ইন্ডিয়ান মেমোরি প্রজেক্ট

ছবিটি ১৯৩১ বা '৩২ সালের দিকে তোলা। দক্ষিণ বোম্বের কোনো স্টুডিওতে (কলাদেবী হতে পারে) তোলা হয়েছিল ছবিটি। মাঝখানের ছোট্ট মেয়েটিই আমার মা। মায়ের বাবা মানে আমার নানা ওই সময়ে তার পুরো পরিবার নিয়েই বোম্বে এসেছিলেন, ছবি তোলাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তিনি নিজের ছবি তোলাতে পছন্দ করতেন আর প্রায়ই আসতেন বোম্বেতে।

আমার নানা মালহার রাও নারায়ণ রাও পুয়ার মধ্যপ্রদেশের একটি ছোট্ট রাজ্যের রাজা ছিলেন। রাজ্যটি ইন্দোরের কাছে, নাম ছিল দেওয়াস।  তিনি ছিলেন রাজপুত পরিবারের সদস্য। আরো অনেক রাজপুতের মতো মারাঠার পালকও গুঁজতে চেয়েছিলেন নিজের মুকুটে। তাই শিখেছিলেন মারাঠা ভাষা ও আচার-বিচার। তিনি দাবি করতেন,  রাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর তার পূর্বপুরুষ। ছবির একদম ডানে বসে আছেন আমার নানীর মা, তার নাম ছিল কৃষ্ণা রাও সালগাওকর। গোয়ার সালিগাঁওয়ে দেবদাসী ছিলেন তিনি। তিনি এক ধনাঢ্য বণিকের সঙ্গিনী ছিলেন, নিজের সন্তানদের পিতা বলেও ওই বণিককেই দাবি করতেন। যদিও বণিক সে বৈধতা দিয়ে যাননি।

সর্ববাঁয়ের নারীটি আমার নানী ইন্দিরা যিনি শৈশবে আমাকে লালন-পালনও করেছেন। তিনি আমাকে অনেক পুরাকাহিনী শুনিয়েছেন। আমার অন্তরে শিল্পপ্রেম তিনিই জাগিয়েছেন। আমাকে রান্না করতেও শিখিয়েছেন তিনি। দেবদাসীরা তার সঙ্গী পুরুষের নাম ধারণ করতে পারতেন না, তারা গ্রাম বা ঘরানার নাম বহন করতেন।

আমার নানা অকালে তার স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন এবং তিনি কোনো সন্তানাদি রেখে যেতে পারেননি। নানা যখন নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছিলেন তখন আমার নানীকে তার সভায় পাঠিয়েছিলেন কোনো একজন। ইন্দিরা দেখতে আকর্ষণীয়া ছিলেন। প্রথম দেখাতেই নানা তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। আমার নানী নৃত্য, সংগীত ইত্যাদি কলা জানতেন। রান্নায়ও পটু ছিলেন আর বুনতে জানতেন কাপড়চোপড়। এক কথায় তিনি বহুগুণের অধিকারী ছিলেন। তার প্রেমে এতোটাই পড়ে গিয়েছিলেন মহারাজা যে তিনি আইন ভাঙতে চাইলেন এবং ভেঙেও ফেলেন। ইন্দিরাকে ১৯১৫ সালে বিয়ে করেন তিনি এবং মহারানী তকমা দেন।  যদ্দিন নানা বেঁচে ছিলেন নানীকে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারেনি। কিন্তু  ব্রিটিশরা তক্কে তক্কে ছিল। তাই নানা মারা যাওয়ার পরই তারা বলল, এটি অসম বিবাহ। ইন্দিরা খেতাব হারালেন আর তার সন্তানেরাও হারালেন উত্তরাধিকার।

বিয়ের পর ইন্দিরার নাম হয়েছিল মহারানী প্রভাবতী রাজে পুয়ার। নামটি রাখা হয়েছিল মারাঠা প্রথায় তার কোষ্ঠী গুনে। আমার মা জন্মালে দশ বছর বয়সে তার নাম রাখা হয় শশীপ্রভা রাজে পুয়ার। তিনিও প্রিন্সেস তকমা পেয়েছিলেন। ছবিতে আমার মামাকেও দেখা যাচ্ছে, তার নাম ছিল প্রিন্স মর্তন রাও মালহার রাও পুয়ার।

ছবিটি তোলার দুই বছর পরই আমার নানা মানে মহারাজা হঠাৎই মারা যান। আমার নানী আর সন্তানদের তাড়িয়ে দেওয়া হয় রাজপুরী থেকে। আমার নানার সৎ ভাই গদি দখল করেন।  মার নানী তার সন্তানদের নিয়ে বোম্বে চলে আসেন। তারা প্রথমে এসে ওঠেন ওলকেশ্বরে আর ১৯৮০ সালে কোলাবায় থিতু হন। প্রথমদিকে তার সোনা-গয়না খরচ করে জীবিকা চালিয়েছেন কিন্তু একসময় তো রাজার ভান্ডারও ফুরায়। তবে আমার মামা ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতেই ছিলেন। তিনি খুব ভদ্র মানুষ ছিলেন। 
আমার মা বড় হয়ে দারুণ আকর্ষণীয়া হয়ে উঠেছিলেন। কানওয়ালজিৎ সিংয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল এক বলড্যান্স পার্টিতে। হোটেল তাজ মহল প্যালেসে চল্লিশের দশকে। তারা একে অন্যের প্রেমে পড়েন এবং পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন ১৯৪২ সালে। তাদের দুই কন্যা ছিল। তারা এক সময় বুঝতে পারলেন, তাদের বিয়ে ভারতীয় আইনে স্বীকৃতি পাবে না তাই কানওয়াজিৎ সিং যান সুপ্রিম কোর্টে তাদের বিয়ের বৈধতা নিতে। আমার জন্মের অল্পপরেই পিতা-মাতা আলাদা হয়ে যান। আমার মা একটি স্কুলে নার্সারির শিক্ষক হিসাবে কাজ নেন। আমার মাকেও কিন্তু তার অতীত  (দেবদাসী) কলংক বয়ে বেড়াতে হচ্ছিল। তবে আমার মনে হয় আমার নানী ও তার পূর্বসুরীরা ছিলেন শক্ত ও স্বাধীনচেতা। আর সুন্দর তো বটেই।  অনেক লোকই তাদের দেবদাসী অতীত নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পায় আর বাস্তবতা এটাই। এই প্রথা অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক আচার-আচরণের শিকার হয়েছিল। এক পর্যায়ে অবশ্য মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতে দেবদাসীদের কেউ কেউ গেয়েছে বা অভিনয় করেছে। তারা ছিলেন সাহসী, তারা চেয়েছিলেন আত্মনির্ভরশীল হতে।

কিশোরকালে আমি যখন এই ছবিটি দেখতাম তখন যশ আর সম্ভ্রান্তি অনুভব করতাম আর এখন গর্ব বোধ করি। আমার নানা মহৎ মানুষ ছিলেন যিনি তার প্রেমকে হারতে দেননি। তিনি তার শাশুড়িকেও অন্তঃপুরে স্থান দিয়েছিলেন, এমনকি আজ এই দিনেও অনেকে এমন সাহস করবে না। 

ইতিহাসে দেবদাসী

দেবতার দাসী হলো দেবদাসী। তাদের বিয়ে দেওয়া হতো মন্দির দেবতার সঙ্গে আর মন্দিরেই ছিল তাদের জীবন বাধা। দেবতার স্ত্রী বলে তাদের কিছু আদর ছিল কারণ লোকে ভাবত তারা সৌভাগ্য বয়ে আনে। তাই নাম পেয়েছিল নিত্যসুমঙ্গলী। চিরকুমারী স্ত্রী তারা। দেবতা যেহেতু অমর, তার স্ত্রী তাই বৈধব্য থেকে মুক্ত। তাদের সময়ের অন্য নারীদের তুলনায় তারা ধনী, ক্ষমতাবান। তারা সংগীত ও নৃত্যকলায় পারদর্শী হতেন। মন্দিরের আচার অনুষ্ঠানে দেবদাসীরা বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। উৎসব আর রথযাত্রায়ও তাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মন্দিরের সর্বত্র ছিল তাদের প্রবেশাধিকার। অনুষ্ঠানাদিতে তাদের উপস্থিতি বিবেচিত হতো আশীর্বাদ হিসাবে। স্বর্ণের অলংকার ও মূল্যবান রত্ন উপহার দেওয়া হতো। জমি আর খেতাবও পেতেন দেবদাসীরা। অনেকেই ছিলেন প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক। দেবদাসীরাও কিন্তু গড়ে দিতেন মন্দিরের ভবন, সাজিয়ে দিতেন বাগান, রথযাত্রা বা অন্য শোভাযাত্রা। বহু স্কুল আর দাতব্য প্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়েছে দেবদাসীদের টাকায়। গাঁয়ের দরিদ্র মেয়েরাই দেবতার জন্য উৎসর্গীকৃত হতেন বেশি। যে যত নৃত্য আর সংগীতপটিয়সী তার আদর ছিল তত বেশি। তারা সমাজের উঁচু স্তরের লোকদের সঙ্গিনী হওয়ার অনুমতি পেতেন।

ইংরেজরা দেবদাসীদের বলতো 'স্যাক্রেড প্রস্টিটিউট'। মিশনারীরাও দেবদাসী প্রথা নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলছিল। প্রথা বন্ধ করতে আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল। শেষে ব্রিটিশ প্রশাসকরা দেবদাসীদের ক্ষমতা কমিয়ে দেয় আর টাকাও বাজেয়াপ্ত করে। দেবদাসীদের সন্তানদের গণ্য করা হচ্ছিল অবৈধ বলে। প্রশাসনিক পর্যায়ে ৬৫ বছরের লড়াই শেষে ১৯৪৭ সালে মাদ্রাজ দেবদাসী প্রিভেনশন অব ডেডিকেশন অ্যাক্ট তৈরি হয়, আর এটিই ছিল কফিনে শেষ পেরেক। শেষ হয় দেবদাসীদের যুগ। কিন্তু রয়ে যায় অনেক অবশেষ। দেবদাসীরা সহায়সম্বল হারিয়ে ফিরতে বাধ্য হন তাদের পূর্বপুরুষের গাঁয়ে। সমস্যা দেখা দেয় তাদের পরিচয় নিয়ে। তাদের সন্তানদের নিয়েও দেখা দেয় পরিচয় সংকট। 

বেশিরভাগ গবেষক কিন্তু একমত যে, দেবদাসী প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয়। তারা বলছেন, অর্থশাস্ত্র রচিত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে। সেখানে মন্দির কন্যা মানে দেবদাসীর কথা কিছুই বলা নেই। কামসূত্র লেখা হয়েছে ২৫০ সালে । সেখানেও নেই স্যাক্রেড প্রস্টিটিউটদের কথা। শূদ্রক মৃচ্ছকটিক লিখেছেন ৬০০ সালে, এতেও নেই দেবদাসীর কোনো উল্লেখ। তাই তারা বলছেন এ প্রথার কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তি নেই। আরো পরে কালিদাসের মেঘদূতে মন্দিরের নৃত্যশিল্পীদের খোঁজ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হচ্ছে, উজ্জয়নীর মহাকাল মন্দিরে পূজার সময় নৃত্যশিল্পীরা উপস্থিত আছে। তাই গবেষকরা নিশ্চিত, সম্ভবত ষষ্ঠ শতকের আগে এ প্রথার অস্তিত্বই ছিল না। দশম শতকে প্রথাটি স্থিতি পায়। মধ্যযুগের সংখ্যাগরিষ্ঠ মন্দিরেই তাদের উপস্থিতি ছিল বলে মনে করা হয়। পুরোহিতের ঠিক পরেপরেই ছিল তাদের অবস্থান আর সংখ্যায়ও তারা কম ছিল না। যেমন তাঞ্জোরের মন্দিরে দেবদাসী ছিল ৪০০ জন তেমন সংখ্যায় ত্রিবাঙ্কুরেও ছিল।  দেবদাসী একটি সংস্কৃত শব্দ তবে স্থানভেদে তাদের আলাদা আলাদা নাম পাওয়া যায় যেমন তামিলনাড়ুতে দেবারাদিয়ার, ত্রিবাঙ্কুর অঞ্চলে কুদিক্কারাস, অন্ধ্রে ডোগামস। কন্নর ভাষা যেসব এলাকায় প্রচলিত সেখানে তাদের নাম ডাকাত বাসবী, গোয়া আর পশ্চিম ভারতে তাদের নাম ভাবিনী।

সূত্র- ইন্ডিয়ান মেমোরি প্রজেক্ট 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.