নওগাঁ শহরজুড়ে ব্রিটিশ আমলের গাঁজা সোসাইটির হাজার কোটি টাকার সম্পদ

ফিচার

07 March, 2021, 03:30 pm
Last modified: 07 March, 2023, 03:30 pm
নওগাঁ শহরের প্রায় সব উন্নয়নেই গাঁজা মহলের অবদান আছে। মসজিদ, মন্দির, সেতু কিংবা চিকিৎসায় সবসময় অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে গাঁজা সোসাইটির সম্পদ।

নওগাঁ শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তি মোড়। এর চারপাশেই পড়ে রয়েছে গাঁজা সোসাইটির (গাঁজা উৎপাদনকারী পুনর্বাসন সমবায় সমিতির) কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। শহরের প্রায় সব উন্নয়নেই গাঁজা মহলের অবদান আছে। মসজিদ, মন্দির, সেতু কিংবা চিকিৎসায় সবসময় অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে গাঁজা সোসাইটির সম্পদ। 

তবে গাঁজা উৎপাদনকারীদের সেই সোনালি সময় এখন অতীত। অবৈধ দখল ও মামলায় জর্জরিত শত বছরের প্রাচীন গাঁজা উৎপাদনকারীদের এই বৃহত্তম সমবায় সমিতি। 

প্রধান দপ্তর ভবনসহ এই সমিতির নিজস্ব সম্পত্তির মধ্যে ৪০ একর জমি রয়েছে বলে লেখক ও গবেষক মো. খোসবর আলী লিখিত 'নওগাঁ জেলার ইতিহাস' এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ শাসসুল আলমের এক প্রবন্ধে (রবীন্দ্র জার্নাল, সংখ্যা-১৫, ২০১৩) উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু সোসাইটির তথ্য বলছে, তাদের এখন ২৬ একর জমি রয়েছে। তবে কোথায় কতটুকু রয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই বলে জানিয়েছে গাঁজা সোসাইটির অফিস। 

গাঁজা সোসাইটির অফিস এখন দেখভাল করেন অফিস সহকারী আনিসুর রহমান। 

আনিসুর রহমানের তথ্যানুসারে, সমিতির সম্পত্তির মধ্যে আছে ২৮টি ভবন, একটি হিমাগার, চারটি গোডাউন, একটি সরাইখানা, একটি মিটিং গ্রাউন্ড, তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১১টি উচ্চ বিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ, একটি মন্দির, সাতটি বড় পুকুর ও একটি লেক। এসব সম্পদ নওগাঁ সদরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শত বছর ধরে নওগাঁর উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে গাঁজা সোসাইটির এসব সম্পদ। 

এছাড়া ভারতের আসাম, কলকাতায় এবং বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেও নওগাঁ গাঁজা সমবায় সমিতির সম্পত্তি ছিল। কলকাতাস্থ বেঙ্গল সমবায় ব্যাংকে সমিতির গচ্ছিত ৫ লক্ষাধিক টাকা এখনো রয়ে গেছে। 

নওগাঁর ইতিহাস গবেষক ও নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম জানান, ব্রিটিশ আমলে গাঁজা সোসাইটির জন্ম। ওই সময় নওগাঁয় বাণিজ্যিকভাবে গাঁজার চষের প্রচলন ছিল। ছিল সরকারি পৃষ্টপোষকতাও। সাত হাজারের বেশি চাষি মিলে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে গাঁজা চাষ করতেন। নওগাঁর গাঁজা চাষিদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯১৭ সালে গড়ে তোলা হয় গাঁজা উৎপাদনকারী পুনর্বাসন সমবায় সমিতি লিমিটেড।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে মাদকদ্রব্যবিরোধী চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। ১৯৮৭ সালে দেশে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই সমবায় সমিতির ৭ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের অভাবে চরম বিপাকে পড়েন। পরে তারা ধান, সরিষা, সবজি চাষাবাদ শুরু করেন।

ইতিহাসবিদরা জানান, মুক্তির মোড়ে গাঁজা সমিতির প্রধান অফিস ভবন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আদলে তৈরি। নেপাল থেকে শালকাঠ এনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তাছাড়া এক্সাইজ সুপারিনটেনডেন্টের জন্য দোতলা বাসভবন ও ডেপুটি চেয়ারম্যানের জন্য দোতলা ভবন ব্রিটিশ আমলে নওগাঁর অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাড়ায়।

গবেষক শফিকুল ইসলাম জানান, নওগাঁয় গাঁজা চাষ কখন, কীভাবে শুরু হয় তার কোনো সুষ্পষ্ট দলিল নেই। জনশ্রুতি আছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে যশোর থেকে প্রথম গাঁজার বীজ এনে নওগাঁর তৎকালিন পাঁচুপুর থানায় (বর্তমানে আত্রাই ও রানীনগর পুলিশ স্টেশন) প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয়। গাঁজাকে পাক-ভারতের প্রাচীন কৃষিজাত দ্রব্য বলে মনে করা হয়।

ইতিহাসবিদরা জানান, একসময় আসাম, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, চেন্নাই, এমনকি লন্ডনেও গাঁজা রপ্তানি করা হতো। ১৯১৮ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার মণ গাঁজা উৎপাদন করা হতো। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হতো প্রায় ৬৬ লক্ষ টাকা। 

সাধারণত জুন-জুলাই মাসে গাঁজা চাষের জন্য চারা তৈরি করে প্রায় ৯ থেকে ১০ ইঞ্চি দূরে দূরে সারিবদ্ধভাবে রোপন করা হতো। ফেব্রয়ারি মাসে গাঁজা পরিপক্ব হয়। এরপর গাঁজা জটাগুলো সশস্ত্র পুলিশ পাহাড়ায় নওগাঁয় গাঁজা-গোলায় পাঠানো হতো।

 

বর্তমানে নওগাঁয় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের মধ্যে গাঁজার চারটি গুদাম রয়েছে। এ কারণে এই এলাকা এখনও গাঁজাগোলা মোড় নামে পরিচিত। চারটি গুদামে এখনো ২২৬ মণ গাঁজা সংরক্ষণ করা আছে। গুদামগুলো এখন সিলগালা করা। জমির মালিকানা এখন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। 

এই সংস্থার পরিদর্শক সবুজ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, 'আমাদের অফিস হওয়ার অনেক আগে থেকেই এখানে গাঁজা সংরক্ষিত রয়েছে। তবে এই সম্পত্তি এখন আমাদের সংস্থার নিজস্ব। খুব শিগগিরই এখানে বহুতল ভবন নির্মাণ হবে।'   

অন্তর্কোন্দলে গতিহারা সমিতি

জেলা সমবায় দপ্তর বলছে, এখন সমিতির সদস্য প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। সমিতির নির্বাচন নিয়ে ২০০৬ সালে জটিলতা দেখা দেয়। তখন এর শেয়ারহোল্ডারদের তালিকা হালনাগাদ ও ডেলিগেট-ব্যবস্থা (৫০ জন সদস্যের একজন প্রতিনিধি) বাতিল করে সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন চেয়ে মোফাখখারুল ইসলাম নামের এক সদস্য হাইকোর্টে রিট করেন। তখন হাইকোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। আদেশে সমিতির পরিচালনার জন্য সমবায় মন্ত্রণালয় অ্যাডহক (অস্থায়ী) কমিটি গঠন করে। 

কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সমিতির অংশীদারদের তালিকা হালনাগাদ করে নির্বাচন করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে সমিতির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিতে বলা হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত এখনও আলোর মুখ দেখেনি। 

গাঁজা সোসাইটি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর নওগাঁ সদরের তৎকালীন সমবায় কর্মকর্তা কে এম সরওয়ার্দ্দীকে অতিরিক্ত জেলা অডিটর (রাজস্ব কর্মকর্তা) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন তার বিরুদ্ধে সমিতির সম্পদ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পরে সমবায় মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের তদন্ত কমিটিও গঠন করে। তবে এই তদন্তের প্রতিবেদন সম্পর্কে কারও কাছে কোনো তথ্য নেই বলে দাবি করা হয়েছে। 

গাঁজা উৎপাদনের জন্য ১৯১৬ সালে সমবায় বিভাগের বিভাগীয় দপ্তর রাজশাহীর পরিবর্তে নওগাঁয় স্থাপিত হয়। এখন অবশ্য গাঁজা সোসাইটির জমি দেখাশোনার দায়িত্বে এই সমিতি রয়েছে। 

জানতে চাইলে জেলা সমবায় কর্মকর্তার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, 'আগে গাঁজা সোসাইটির সম্পদ বেদখল হয়েছে। তবে এখন আর হয় না। অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ শেষ হলে মন্ত্রণালয় আবার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়।'

জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন বলেন, 'তদন্ত কমিটির কথা আমি জানি না। আর গত ৪-৫ বছরে অনিয়মের কোনো ঘটনা নেই।' 

গাঁজা সোসাইটির নির্বাচিত কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান (২০০৫-২০০৬) নাজমুল হক জুয়েল বলেন, 'গাঁজা সোসাইটির সম্পত্তি নওগাঁর অনেক সাংসদ, সাংসদের অনুসারী কিংবা জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নামে-বেনামে দখল করে রাখা হয়েছে। নামমাত্র টাকায় কোয়ার্টারগুলো ভাড়া দেওয়া আছে। এগুলোর প্রতিবাদ করায় আমাদের সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছিল।' 

গবেষক শরিফুল ইসলাম জানান, একসময় সমিতির সদস্যরা প্রতি বছর দু-তিন হাজার টাকা করে ভাতা পেতেন। শিক্ষা বৃত্তি, চিকিৎসা সুবিধা ও পশু চিকিৎসাকেন্দ্রও ছিল সমিতির। শহরের ছোট যমুনা নদীর ওপরের লিটন ব্রিজও সমিতির টাকায় নির্মিত। কিন্তু এখন সবই ইতিহাস।

শফিকুল আরও বলেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে গাঁজা সোসাইটির সম্পদ ক্রমাগত বেহাত হচ্ছে। যারা যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারাই সম্পদ দখল করেছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সমিতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কমিটি দরকার। 

গাঁজা সোসাইটির অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মিল্টন চন্দ্র রায় বলেন, 'আমাদের সময়ে গাঁজা সোসাইটির সম্পদ বেদখল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং আগে বেদখল হওয়ার সম্পদ উদ্ধারে আমরা কাজ করছি। আর সমিতির সম্পত্তি নিয়ে কারও বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল কি না এ সম্পর্কে কিছু জানি না।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.