পিকাসোর ‘গের্নিকা’: ৮৪ বছর পরও যে চিত্রকর্মের প্রাসঙ্গিকতা কমেনি এতটুকু

ফিচার

19 December, 2021, 11:05 pm
Last modified: 19 December, 2021, 11:05 pm
নিষ্ঠুরতার চিত্রায়ণে গের্নিকা আপসহীনভাবে সৎ; এতে উঠে এসেছে পিকাসোর সিগনেচার স্টাইল। গের্নিকা যুদ্ধের ভয়াবহতাকে এতটাই সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছে যে এটি একরকম যুদ্ধ-বিরোধী একটি নিদর্শনে পরিণত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর্মের মধ্যে পিকাসোর ‘গের্নিকা’ একটি, ছবি: আর্টসি.নেট

মানুষের ভোগান্তি, দুঃখ-দুর্দশা শিল্পকলায় সবসময়ই একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। সহিংসতা, দুঃখ-যাতনার চিত্র শিল্পীর চিত্রকর্মে বারবারই সরব হয়ে উঠে এসেছে। ফ্রান্সিস্কো দ্য গয়া'র 'ডিজাস্টার্স অভ ওয়ার'-এ নেপোলিয়ানের একটি গেরিলা যুদ্ধে অত্যাচারিতদের চাক্ষুষ বিভীষিকার দৃশ্য দেখা যায়। জর্জ গ্রোসের 'এক্সপ্লোশন' এ উঠে এসেছে ১ম বিশ্বযুদ্ধে বার্লিনের ওপর ধ্বংসাত্মক বোমা নিক্ষেপের দৃশ্য। অত্যাচারী এবং অত্যাচারিতের এরূপ চিত্রায়ণ দর্শকমনে ক্ষোভের জন্ম দেয়, যা একসময় সামাজিক থেকে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে তাকে অনুপ্রাণিত করে।

যুদ্ধ-বিষয়ক এসব চিত্রকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে যে পাবলো পিকাসোর (১৮৮১-১৯৭৩) তৈলচিত্র 'গের্নিকা' (Guernica, Spanish: [ɡeɾˈnika]) অনেক উপরের দিকে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহই নেই। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আঁকা এ ছবিটি যুদ্ধের ভয়াবহতাকে রূপক হিসেবে ধারণ তো করছে-ই, পাশাপাশি পিকাসো তার নিষ্ক্রিয় দর্শককে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে উদ্বুদ্ধ করছেন – এটিও স্পষ্ট।

নিজের বিধ্বস্ত দেশে পরিবর্তন আনার জন্য, বহির্বিশ্বের মানুষকে সঙ্কটটি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য উনি গের্নিকা এঁকেছিলেন। তাই এই মাস্টারপিসটির গুণ বিচার করার সময় এর যুদ্ধকালীন ন্যারেটিভের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আজ থেকে প্রায় ৮৪ বছর আগে জনপ্রিয় স্প্যানিশ কিউবিস্ট চিত্রকর পাবলো রুইজ পিকাসো এই কাজটি বেছে নিয়েছিলেন, যা স্রেফ তার শিল্পী-জীবনকেই নয়; আধুনিক শিল্পকলার প্রতি বোদ্ধাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও পাল্টে দিয়েছে।

নিষ্ঠুরতার চিত্রায়ণে গের্নিকা আপসহীনভাবে সৎ; এতে উঠে এসেছে পিকাসোর সিগনেচার স্টাইল। গের্নিকা যুদ্ধের ভয়াবহতাকে এতটাই সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছে যে এটি একরকম যুদ্ধ-বিরোধী একটি নিদর্শনে পরিণত হয়েছে।

‘এক্সপ্লোশন’, ১৯১৭ ছবি: মিউজিয়াম অভ মডার্ন আর্ট

ম্যুরাল আকৃতির এ তৈলচিত্রটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ১১ ফিট এবং প্রস্থ সাড়ে ২৫ ফিট। সহিংসতা এবং নৈরাজ্য কীভাবে মানুষকে ভোগান্তির মুখোমুখি করেছে তা-ই দেখতে পাওয়া যায় এখানে। পিকাসোর একাধিক কাজকে শিল্পবোদ্ধারা 'মাস্টারপিস' বলে আখ্যা দিয়েছেন। যেমন: বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রারম্ভেই তার আঁকা 'লা দ্যমইজেল দাভিনিয়োঁ' (Les Demoiselles d'Avignon) পাশ্চাত্যের বিমূর্ত শিল্পকলায় একটি ভিন্নধর্মী গতিশীলতা এনে দিয়েছিল। এ ছবিটির ঠিক ত্রিশ বছর পর, ১৯৩৭ সালে পিকাসো এঁকেছিলেন গের্নিকা। তার চিত্রকর্মের বিশাল সমৃদ্ধ সম্ভারেও একটি আলাদা ও বিশেষ স্থান দখল করে আছে এই গের্নিকা।

গত শতাব্দীর '২০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পিকাসো সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের সঙ্গে বেশ সক্রিয়ভাবেই জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু তখনো নিজেকে জড় বস্তু যেমন: বাদ্যযন্ত্র কিংবা ফলমূলের ছবি আঁকায় সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। নিরীক্ষণের মাধ্যমে বারবার নিয়মকে ভেঙেছেন, একটি বস্তুকে কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক দেখা যায়, সেদিকেই লক্ষ ছিল তাঁর। পরবর্তী সময়ে এগুলোই কিউবিজমের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যা-ই হোক, চিত্রকর্মকে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখার কারণে এই ছোট্টো অন্দরমহল তাঁর কাছে দ্রুতই হয়ে ওঠল ক্লস্ট্রোফোবিক। এই পরিবর্তন তার মধ্যে এসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। এ-সময়টায় তিনি এবং তার সতীর্থরা নিজেদের দৃষ্টি নিপাত করেন মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিল ও অন্ধকার দিকগুলোয়। উদাহরণস্বরূপ, পিকাসো'র 'দ্য থ্রি ডান্সারস'-র কথা বলা যায়।

'গের্নিকা' তিনি এঁকে শেষ করেছিলেন খুব অল্প সময়ে। তাই বলে কিন্তু মোটেও এই বিশেষ চিত্রকর্মের সাথে তার আঁকা পূর্ববর্তী কাজগুলোর সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না। অনেক বৎসরের শিল্প সৃষ্টির সাধনা এখানে মুখ্য। পাশাপাশি পিকাসো ব্যক্তিগতভাবেও স্পেনের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। গের্নিকা তাই একইসাথে তার ব্যক্তিগত, শৈল্পিক এবং রাজনৈতিক জীবনের যোগফল। চিত্রকর্মটি বিশ্লেষণ করার সময়ও তাই এদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। গের্নিকা অনেক দিক থেকেই তার সেরা সৃষ্টি; কারণ তিনি পরবর্তী সময়ে যেসব বৈশিষ্ট্যের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিলেন, তার সবগুলোকে এখানে একটি মোড়কের ভেতর পাওয়া যায়। তাছাড়া মডার্ন আর্টের কোনোটিই গের্নিকা-সম জনপ্রিয়তার স্তরে পৌঁছুতে পারেনি।

স্পেনে যখন গৃহযুদ্ধ চলছে, এমন একটা সময়ে, স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্র পিকাসোর কাছে ১৯৩৭ এর প্যারিস আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য একটি ছবি চেয়েছিল। স্পেন প্রজাতন্ত্র সেসময় অর্থকষ্টে ভুগবার কারণে সোভিয়েত কিংবা জার্মান শিবিরের সাথে এক্ষেত্রে পাল্লা দেওয়ার সাহস করেনি। তারা চেয়েছিল স্বল্পমূল্যের কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের একটি চিত্রকর্ম। পিকাসো সাত-পাঁচ না ভেবেই জানুয়ারি '৩৭ এ সেই কমিশন গ্রহণ করে নিলেন, জানালেন নিজের প্রিয় স্পেনের জন্য একটি ম্যুরাল-আকৃতির পেইন্টিং তিনি আঁকবেন। বলে দেওয়া হয়েছিল যে চিত্রকর্মটি হওয়া চাই এমন যেখানে থাকতে হবে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা। কিন্তু পিকাসোর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন - তিনি আঁকতে চেয়েছিলেন এমন কিছু যা হবে একেবারেই অরাজনৈতিক। প্রথমে কী আঁকবেন তা ভেবে না পেয়ে, তিনি স্টুডিওতে থাকা এক শিল্পী ও তার সামনে থাকা মডেলকেই ছবিতে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তবে একটি দুঃখজনক ঘটনা তাঁর পরিকল্পনা সব পাল্টে দিয়েছিল।

নিজ স্টুডিওতে ‘গের্নিকা’ আঁকায় ব্যস্ত পিকাসো, ছবি: রেডিট

সেবছর এপ্রিলে স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময় নাৎসি বোমারু বিমান দিয়ে উত্তরাংশের যে ছোট্ট নগরীটিকে বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয়েছিল, তারই নাম গের্নিকা। স্পেনের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী জেনারেল ফ্রান্সিস্কো ফ্রাংকোর নির্দেশে নাৎসি কন্ডোর সৈন্যদল এ কাজ করেছিল। বিশেষ দিনে আকাশপথ হতে এই বোমা হামলা নিশ্চিত করার কারণে ১৬০০-র বেশি সাধারণ নাগরিক, নারী এবং শিশু হতাহতের শিকার হয়। ব্লিটজ ক্রিগ কৌশলের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে বোমারু বিমান নিয়মমাফিক আগানোর কারণে প্রাচীন এ নগরীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশকে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গৃহযুদ্ধের সময় এই নগরীতেই প্রথম নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালানো হয়। ২৭ এপ্রিলের পত্রিকা খুলেই পিকাসো গের্নিকার ধ্বংসস্তুপের চিত্র দেখতে পান।

আজীবন একজন নিবেদিতপ্রাণ বামপন্থী পিকাসো ১ম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার কারণে সমালোচনার পাত্রও হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই গের্নিকার এ ঘটনা তাকে খুব মর্মাহত করেছিল। কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি সেটিকেই শক্তিতে রূপ দিয়ে প্যারিসের স্টুডিওতে ছবি আঁকার কাজে লেগে পড়েন। মাত্র দেড় মাসের মধ্যে তিনি ম্যুরাল এঁকে ফেললেন। জুলাইয়ের মধ্যে তার কাজ তিনি জমাও দিয়ে দেন। রিপাবলিকানদের প্যাভিলিয়নে তার গের্নিকাই হয়ে ওঠেছিল সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

বিধ্বস্ত গের্নিকা, ছবি: হিস্ট্রি টুডে

তেলরঙে আঁকা গের্নিকায় সাদা, কালো এবং ধূসর রঙের ছড়াছড়ি। মূলত দুঃখজনক সেই ঘটনার বিষণ্ণতার দিকে গুরুত্বারোপ করার জন্যই পিকাসো এই রঙের ব্যবহার করেছেন। রূপকে ঠাসা এই ম্যুরালের মূল বিষয়বস্তু হল সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। চারজন নারী, একজন পুরুষ ও একটি শিশুর পাশাপাশি ছবিতে একটি ঘোড়া এবং একটি ষাঁড়কেও দেখতে পাওয়া যায়। নিচু ছাদওয়ালা ছোট্টো জায়গায় একটি তীব্র আলোকোজ্জ্বল বাতি দেখা যায় এখানে। এই আলোকবাতিকে গের্নিকার ওপর আকাশ থেকে বোমা-বর্ষণের রূপক হিসেবে দেখা যেতে পারে।

পিকাসো কখনো তার আরোপিত সিম্বোলিজম নিয়ে সরাসরিভাবে কথা বলেননি, তবে গের্নিকা'য় থাকা বিষয়বস্তুর দিকে ভালোমতো তাকালেই এর অনেক অর্থ বুঝে নেওয়া সম্ভব। যেমন: নারীর কষ্ট কিংবা আর্তনাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছবিতে। সেটা পিকাসো তীক্ষ্ণ, সূক্ষ্ম বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল ব্যবহার কিংবা অশ্রুসিক্ত চোখ আঁকার মাধ্যমে দেখিয়েছেন। একেবারে বামদিকে থাকা একজন নারী আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছেন, তার কোলে একটি নির্জীব শিশু। আরেকজন আঘাতে জর্জরিত হয়ে হাত উঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এমন একজন নারীকেও এখানে পাওয়া যায়, যিনি খোলা জানালা থেকে একটি আলোকবর্তিকা ধরে রেখেছেন। তিনি এখানে আশার প্রতীক, বাকিদের জানান দিচ্ছেন, এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি।

মাটির দিকে একজনের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখা যায়, ধরে নেওয়া যেতে পারে, তিনি ছিলেন একজন সৈনিক, স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্রের প্রতিরূপ। তার হাতে একটি ফুল।
বাণে জর্জরিত একটি ঘোড়া যেন আর্তনাদ করছে। মূলত এটি জার্মান বোমারু এবং স্পেনের ফ্যাসিবাদী সরকারের অত্যাচারে গের্নিকার সামষ্টিক মানুষের আর্তচিৎকারের প্রতিরূপ। নারী ও পুরুষের রূপকের বিবরণটা খুব সোজাসাপ্টা হলেও, ষাঁড় দিয়ে পিকাসো আদতে কী বুঝাতে চেয়েছিলেন, সেটির ব্যাখ্যায় তাত্ত্বিকেরা এখনো অনিশ্চিত এবং দ্বিধাবিভক্ত। অনেক তাত্ত্বিকের মতে, এই ষাঁড় দিয়ে মূলত জেনারেল ফ্রাংকোর ফ্যাসিবাদের দিকেই তাক করেছেন পিকাসো। ষাঁড়টি শহরকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে। অথচ সে পুরোপুরিভাবে অনুভূতিশূণ্য, তার চোখে কোনো ভাষা নেই। চিত্রকর্মটিতে একটি ঘুঘু পাখিও ছিল; কিন্তু শান্তির এ প্রতীকটিকে যেন মুছে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধের সময় গের্নিকার মানুষের শান্তি যেমন উবে গেছে, সেটিই যেন প্রতীকী ভাষায় বোঝাতে চেয়েছেন পিকাসো।

দ্বিতীয় স্ত্রী জ্যাকেলিন রোকের পাশে পিকাসো, ছবি: গেটি ইমেজেস

প্যারিসের প্রদর্শনী শেষে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন স্থানে গের্নিকার প্রদর্শনী চলেছে। গৃহযুদ্ধের অবসানের পর জেনারেল ফ্রাংকোর হাতে স্পেনের ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়। কিন্তু তখনো গের্নিকা বিভিন্ন প্রদর্শনী থেকে আদায়কৃত তহবিল দিয়ে স্পেন প্রজাতন্ত্রের শরণার্থীদের সাহায্য করেছে। ১৯৩৯ এর পর পিকাসো নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অভ মডার্ন আর্টের কাছে ম্যুরালটির দায়িত্ব অর্পণ করেন।

১৯৩৯-৫২ এর সময়কালে গের্নিকা ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিম ইউরোপের পুরোটা সফর করেছে। পাবলোর ইচ্ছা ছিল ফ্রাংকোর জীবদ্দশায় যেন এই ম্যুরাল স্পেনের মাটিতে না পৌঁছায়। ফ্রাংকো বেশ কয়েকবার ছবিটি স্পেনে নেওয়ার যেন অনুরোধ করলেও, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ম্যুরালটি সেখানে না পাঠানোর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন পিকাসো। অবশেষে ফ্রাংকোর মৃত্যুর ছয় বছর পর, ১৯৮১ সালে এটি স্পেনে পৌঁছায়। বর্তমানে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের রেইনা সোফিয়া জাদুঘরে তৈলচিত্রটি সংরক্ষিত আছে। দৈনিক হাজার-হাজার লোক ম্যুরালটি দেখতে ভিড় জমান সেখানে।

শিশু দর্শনার্থী মনোযোগ দিয়ে দেখছে ‘গের্নিকা’-কে, ছবি: আর্টস পেপার

যদিও এটি পিকাসোর ব্যক্তিগত বোঝাপড়া, কিন্তু একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তও বটে। গের্নিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই সেসময় এটা জরুরি ছিল। কারণ ফ্যাসিবাদী ফ্রাংকোর শাসনামলে স্পেনে পৌঁছালে এটি নষ্ট করে দেওয়ারও একটি প্রয়াস চলত তাতে দ্বিধা নেই।

২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানি যখন প্যারিস দখল করে নিল, তখন নাৎসি অফিসাররা পিকাসোর স্টুডিওতে গিয়ে তার সাথে প্রতিনিয়তই সাক্ষাৎ করত। কথিত আছে, একবার এক গেস্টাপো অফিসার গের্নিকা'র একটি পোস্টকার্ড উঁচিয়ে পিকাসোকে জিজ্ঞেস করেছিল, 'এটা কি আসলেই তোমার করা কাজ?'। পিকাসো রাগান্বিত স্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, 'নাহ, এটা তোমাদের কাণ্ড!' পিকাসো ম্যুরালটি এঁকে স্রেফ নাৎসিদের সেই ভয়াবহতার জানান দিয়েছেন।

মিছিলে-আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষা যখন ‘গের্নিকা’, ছবি: ওয়াইড ওয়ালস

নিউইয়র্কে থাকার সময় থেকেই সারাবিশ্বে গের্নিকার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এখন এটি স্রেফ একটি চিত্রকর্মে সীমাবদ্ধ নয়; বরং নিরস্ত্র মানুষের উপর যখন যেখানেই হামলা চলেছে, সেখানেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এটি। যুদ্ধ মানুষকে যেভাবে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়, সেই বীভৎসতাকে, মানবতার আর্তচিৎকারকে - গের্নিকা চমৎকার সততার সাথে তুলে ধরেছে। পাবলো পিকাসো নিজেও নিশ্চয়ই গের্নিকা কখনো এরকম জনপ্রিয়তা পাবে তা অনুমান করতে পারেননি। যুদ্ধ-বিরোধী মানুষের কাছে গের্নিকা এখন হয়ে ওঠেছে শান্তির প্রতীক। দিনশেষে গের্নিকা এতটাই বিস্তৃত বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত যে এর একটি নির্দিষ্ট অর্থ খুঁজে বের করা সম্ভব না। সম্ভবত এই 'অস্পষ্টতা' কিংবা 'দ্ব্যর্থতা'-ই গের্নিকাকে সার্বজনীন করে তুলেছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের শান্তিপ্রিয় মানুষের মননে গিয়ে এর বিষয়বস্তু সজোরে আঘাত করতে সক্ষম। আর দীর্ঘ ৮৪ বছর পেরিয়েও যার প্রাসঙ্গিকতা এতটুকু কমেনি, তার প্রতি মানুষের আবেদন কমবেই-বা কী করে?
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.