প্রেম, বিপ্লব, সংগ্রাম: এক বুদ্ধিজীবীর স্ত্রীর আত্মকথা

ফিচার

15 December, 2021, 11:15 pm
Last modified: 16 December, 2021, 05:45 pm
হোসনে আরা আজও জানেন না, তাঁর স্বামী বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। ১৯৭১ সালে ৩১ জুলাই তাঁর স্বামী লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারি। এরপর আর ফিরে আসেননি তিনি।

 

শহীদ বুদ্ধিজীবী লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দার ও তার স্ত্রী হোসনে আরা

পাকিস্তানি শাসন-শোষণের নাগপাশ ছিড়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছিলো স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপন করছি আমরা। অথচ হোসনে আরা আজও জানেন না, তাঁর স্বামী বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। 

১৯৭১ সালে ৩১ জুলাই তাঁর স্বামী লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী। এরপর আর ফিরে আসেননি তিনি।

"আমরা প্রথম প্রথম শুনতাম উনাকে ঢাকা নিয়ে গেছে মিলিটারিরা, আবার পরে পরে শুনতাম করাচি নিয়ে গেছে। কেউ কেউ বলতো, ফিরে আসবে। বহু অপেক্ষা করেছি, চোখের জলে কতোবার চিবুক ভিজিয়েছি তাঁর ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি। ছোট দুই ছেলে-মেয়ে আর গর্ভের সন্তানকে নিয়ে আমি একা, নিঃস্ব আর অসহায় হয়ে গেলাম।"
মোহাম্মদপুরের বাসায় বসে সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদককে নিজের জীবনের গল্প বলছিলেন সত্তর পেরোনো হোসনে আরা। পাশে বসে তা শুনছিলেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সন্তান, দেবর আর ঢাকার একজন লেখক।

লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দারের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। ১৯৭১ সালে তিনি চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে গড়ে ওঠা 'সংগ্রাম কমিটি'র স্থানীয় সভাপতি ছিলেন। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। যুদ্ধের বিভীষিকাময় সময়ে সীমান্তের ওপারে ভারতে গিয়ে নিরাপদে থাকার সুযোগ থাকলেও, তিনি মাতৃভূমি ছাড়েননি। সাহস যুগিয়েছেন নিজের কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর আর খোঁজ মেলেনি তাঁর। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি দেয়।

একজন হোসনে আরার সংগ্রামমুখর জীবন

হোসনে আরার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। সরকারি চাকুরে পিতার একান্নবর্তী সংসারে এগারো ভাই-বোনের সঙ্গে আদর-স্নেহেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশর। ইঞ্জিনিয়ার হবার এক আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিলো তার। তবে জীবনের গতিপথ বদলে গেলো ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফলাফলের পর। বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী দেখলেন, তিনি অন্যান্য বিষয়ে দুর্দান্ত ফলাফল তো করেছেন বটেই, বাংলা পরীক্ষায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বসে আছেন।

তিনি বলেন, "ভালো রেজাল্ট মানুষের অনেক ভালো করে, আবার অনেক ক্ষতিও করে। আমার মাথাটা সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিল, আমি রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গেছি! যার ফলাফল হিসেবে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্নকে 'না' করে দিলাম। বাংলা সাহিত্যকে বললাম 'হ্যাঁ'।"

শহীদ বুদ্ধিজীবী লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দার ও তার স্ত্রী হোসনে আরা

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের নৈরাজ্য আর শোষণের প্রতিবাদে উত্তাল ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে পা রাখেন হোসনে আরা। বাংলা বিভাগের শ্রেণিকক্ষে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, রফিকুল ইসলামদের ক্লাস করতেন তিনি।

প্রথম বর্ষের শেষদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে বিভাগে ফেরার পথে মধুর ক্যান্টিনের সামনে ঘটনাচক্রে পরিচয় হয় ইংরেজি বিভাগের ছাত্র লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দারের সঙ্গে। ঝিনাইদহের কেসি কলেজে স্নাতক পর্ব শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করতে আসা লতাফত ছিলেন রাজনৈতিকভাবে ভীষণ সচেতন। কেসি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি থাকাকালীন তৎকালীন হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কারাবরণও করতে হয়েছিল তাকে।

"প্রথম দেখাতেই উনাকে ভালো লেগে গিয়েছিলো আমার। তিনি দেখতে যেমন সুদর্শন ছিলেন, তেমনি তাঁর কথাগুলো ছিলো মুগ্ধ হয়ে থাকার মতো। এরপর কেনো জানি না, তবে প্রতিদিনই আমাদের দেখা হতো। কথা হতো," বলছিলেন হোসনে আরা।

সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক এগোতে থাকে। এরপর ১৯৬৬ সালের এক বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফিরে মা'কে জানালেন লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দারকে তিনি বিয়ে করতে চান। মায়ের কাছ থেকে জানলো বাবা। প্রথমে কিছুটা দ্বিধান্বিত হলেও বেকার গ্র্যাজুয়েট লতাফতের হাতেই নিজের বড় কন্যা হোসনে আরাকে তুলে দিলেন বাবা রফিক আহমেদ।

বিয়ের পর গাজীপুরের কাপাসিয়ার একটি কলেজে ইংরেজি বিভাগে পড়ানো শুরু করলেন লতাফত। বেতন পেতেন আড়াইশো টাকা। ছ'মাসের চাকরি শেষে ঢাকায় এসে যোগ দিলেন তৎকালীন অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংকে (বর্তমান রূপালী ব্যাংক)। এরপর ট্রেনিংয়ে গেলেন লাহোরে। 

"আমার জন্মই হয়েছিলো লড়াই করে টিকে থাকার জন্য। পড়াশোনা করা অবস্থায়ই আমার বিয়ে হলো, বছরের ব্যবধানে বাচ্চাও হলো, স্বামীও দেশে নেই। তবু আমার একবারও মনে হয়নি, পড়াশোনাটা আমি ছেড়ে দেই। একাই সংসার, বাচ্চা, পড়াশোনা সব সামলে দিন যাচ্ছিলো আমার," বলছিলেন হোসনে আরা।

এরপর দেশে ফিরে ১৯৬৯ সালে লতাফত হোসেনের পোস্টিং হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। অন্যদিকে স্নাতকের পাঠ চুকিয়ে ফেলেন হোসনে আরা। 

"আমি নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। যেখানেই ইংরেজি ও বাংলা বিভাগের জন্য শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখতাম, সেখানেই দুটো আবেদনপত্র পাঠাতাম। একটা আমার জন্য, অন্যটা আমার স্বামীর জন্য। এভাবে সারা বাংলাদেশে ৩৫টা কলেজের জন্য আবেদন করেছিলাম। ২৮ জায়গা থেকে আমাদের ডেকেছিলো। আমরা বরিশালের কলসকাঠি কলেজে যোগদান করলাম। আমার স্বামী প্রিন্সিপাল হিসেবে আর আমি বাংলার প্রভাষক হিসেবে।"

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেশের দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে সর্বকালের ভয়ংকরতম যে ঘুর্ণিঝড় হয়েছিল তাতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণ গিয়েছিলো। সেসময় বরিশালের বাকেরগঞ্জের কলসকাঠি কলেজের পাশে একটি পুরনো জমিদার বাড়িতে থাকতেন লতাফত-হোসনে আরা দম্পতি।

"আমরা ছিলাম দোতলায়। জলোচ্ছ্বাসের পানি প্রায় ছুঁয়ে ফেলছিলো দোতলার ফ্লোর। দলে দলে লোকজনকে এনে বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন আমার স্বামী। উনার মনটা ছিলো বিশাল। আমাকে বললেন, ঘরের চাল-ডাল সব এক করে খিচুড়ি বসিয়ে দাও। আমার শাড়িগুলোও দিয়ে দিলাম পানির স্রোতে ভেসে-ভিজে আসা নারীদের। দুর্যোগের ওই রাতে একটা বাচ্চার জন্মও হয়েছিলো আমার বাসায়।"
 
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা কলেজে দুটি পদ ফাঁকা হলে সেখানে চাকরি নিয়ে চলে যান এই দম্পতি। ওই কলেজের প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারে উঠেন তারা। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশজুড়ে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার আহ্বান জানলে তাতে সাড়া দেন দর্শনা কলেজের প্রিন্সিপাল লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দার। 

সরকারি স্ট্যাম্পে দর্শনা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দারের ছবি।

"দর্শনায় ফিরে তিনি আবার আওয়ামী লীগের পলিটিক্স শুরু করলেন। স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হলেন। সারাদেশ তখন উত্তাল। মুক্তিযোদ্ধার তখন আসতো আমাদের বাসায়। আমি খাবার-টাবার দিতাম উনাদের। আমার স্বামীর সঙ্গে নানা বিষয়ে তারা কথা বলতো, তবে আমার সামনে কিছু বলতো না।"

যুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিলের শেষভাগে হোসনে আরার শ্বশুর দর্শনা এসে পুত্রবধূকে নিজ গৃহ ঝিনাইদহে নিয়ে যান। স্ত্রী-সন্তানকে দেখতে মাঝেমধ্যে গ্রামে যেতেন লতাফত হোসেন। বাকি সময়ে তার কাজ ছিলো দর্শনার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা। 

"হুটহাট গ্রামে মিলিটারি আসতো। আমরা তখন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভয়ে ধানক্ষেতে, পাটক্ষেতে লুকাতাম। এতো ভয়ের মধ্যে থাকতে পারছিলাম না। এ সময়ে বহু মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে যাচ্ছিলো। তাই উনি যখন বাড়িতে আসতেন, তখন উনাকে আমি বলতাম, 'চলো আমরা ভারতে চলে যাই'। এর জবাবে উনি বলতেন, 'তোমাদের নিয়ে ইন্ডিয়া আমি যেতেই পারি, কিন্তু এখানে আমাদের ছেলেদের খাবার দেওয়া, যুদ্ধের খোঁজখবর দেওয়া এগুলো কে করবে? আমার ছেলেদের ছেড়ে আমি যেতে পারবো না।' আমি তখন খুব রাগ করতাম। নিজের সন্তানদের কথা না ভেবে উনি কেবল ছাত্রদের কথাই ভাবতেন," বলছিলেন হোসনে আরা।

যুদ্ধের মধ্যে ঝিনাইদহ থেকে দর্শনা আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতেন অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দার। ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই, শনিবার স্ত্রী হোসনে আরার সঙ্গে নিজ বাড়িতে দুপুরের খাবার সারেন। এরপর যাত্রা করেন দর্শনায় তার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে নিয়ে যান নিজের স্কুলপড়ুয়া শ্যালক আলমগীর হোসেনকে।

আলমগীর হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ওইদিন বিকেলে দর্শনা কলেজের দুজন শিক্ষকের সঙ্গে তিনি অনেককিছু নিয়ে আলাপ করলেন। পরের দিন সকালে তারা দর্শনা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখনই চান্দু নামে তার কলেজের এক ছাত্র আসলো। চান্দু শান্তি কমিটির লোক (রাজাকার) ছিলো। সে বললো, 'স্যার আপনাকে মেজর সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন'। দুলাভাই তখন বললেন, 'আচ্ছা আমি খেয়ে নেই, তারপর বের হচ্ছি'। কিন্তু চান্দু জোরাজুরি করায় তিনি খেতে পারেননি, অভুক্ত মানুষটাকে নিয়েই বের হয়ে গেল।"

প্রাণ বাঁচাতে ছোট্ট আলমগীরকে নিয়ে তখন দর্শনা কলেজের ওই দুই শিক্ষক বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। বহুদূর হেঁটে, মিলিটারির চেকপোস্ট পেরিয়ে ঝিনাইদহ এসে বোন হোসনে আরাকে তিনি খবর দেন, মিলিটারিরা তাঁর দুলাভাই অর্থাৎ দর্শনা কলেজের অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দারকে ধরে নিয়ে গেছে। এরপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁর। দুঃখের দিন শুরু হয় হোসনে আরার।

যুদ্ধের পুরোটা সময় হোসনে আরা ঝিনাইদহে শ্বশুরালয়েই ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় ফেরেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তানের দীর্ঘ কারাবাস শেষে ঢাকায় ফিরেছিলেন। ২৫ জানুয়ারি তাঁর ছোট সন্তানের জন্ম হলো। 

ঢাকায় ফেরার কিছু দিন পর তার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। যুদ্ধের কারণে তাঁরাও পালিয়ে কুমিল্লার গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। এক সময়ে স্বচ্ছল জীবন যাপন করা হোসনে আরা তিন সন্তানকে নিয়ে বেশ বিপাকেই পড়লেন। স্বচ্ছল বাবা কিংবা শ্বশুরের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিতেও বাধ সাধছিলো তাঁর। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ২৩ বছর বয়সী বাংলা সাহিত্যের গ্র্যাজুয়েট হোসনে আরা নেমে পড়লেন চাকরির সন্ধানে।

"আব্বা অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে দুই টাকা করে দিয়ে যেতো। ওই দুই টাকা নিয়ে, বাচ্চা ঘরে রেখে আমি বিভিন্ন অফিসে, কলেজে ঘুরতাম। বহু ঘোরাঘুরি আর চেষ্টার পর শুক্রাবাদের নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজে আমার একটা চাকরি হলো। বেতন ধরা হল ১২৫ টাকা।"

"হঠাৎ আমার মনে হলো- আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি না কেন? উনার জন্যই তো আমার পরিবারটা তছনছ হয়ে গেল। উনি ডাক দিয়েছেন বলেই তো মানুষ যুদ্ধে গেছে, মারা গেছে, ক্ষতি হয়েছে; আমার ক্ষতিটাও তো উনার ডাকের জন্যই হয়েছে।"

এরপর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে একদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলেন হোসনে আরা। সেখানে নিরাপত্তারক্ষীরা জানালেন, বিকেলে রমনার এলাকায় একটি ভবনে বঙ্গবন্ধু বসেন, সেখানে দেখা করার জন্য। 

"বিকেলে আমি সেখানে গেলাম। সেখানে বহু মানুষ। এই প্রথম আমি শেখ মুজিবকে দেখলাম। এই লোকটাকে দেখে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুইয়ে গেল। আমি রুমে ঢোকার পর উনি বললেন, 'কী চাও?' আমি বললাম, 'আমি বাংলায় গ্র্যাজুয়েট, স্বামীকে হারিয়েছি যুদ্ধে'। উনি খুব বেশি কথা জিজ্ঞেস করলেন না। চাকরি করবো কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমি 'হ্যাঁ' বলাতে উনার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রব চৌধুরীকে ডেকে আমার অ্যাপ্লিকেশনে লিখে দিলেন, 'পুট হার সামহোয়্যার'। এরপর রব চৌধুরী আমাকে পাশের রুমে ডেকে নিলেন এবং কথাবার্তা শেষে তিনদিন পর দেখা করতে বললেন।"

হোসনে আরার সঙ্গে তার কনিষ্ঠ সন্তান ড. হাসানুর রায়হান জোয়ার্দ্দার। তিনি দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

যুদ্ধের শেষে বীরাঙ্গনাদের জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলা হয়েছিল ধানমন্ডির তিন নম্বর সড়কে। সেখানে মূলত গর্ভবতী নারীরা চিকিৎসা নিতেন। সেখানে দোভাষী হিসেবে হোসনে আরার চাকরি হল। বেতন ধরা হল ৫০০ টাকা। কিছুদিন সেখানে চাকরির পর তাকে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যানের একান্ত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

"বছরখানেক পর নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে প্রোগ্রাম অফিসার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হল। সেখানে পরীক্ষা দিলাম আমি। চাকরিও হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি সেখানেই কাজ করেছি। ২০০৪ সালে অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে আমি অবসর নেই।"

স্বাধীনতা যুদ্ধে লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দার নিখোঁজ হলেও সে স্বীকৃতি মেলেনি অনেকবছর। সংগ্রামী নারী হোসনে আরার একান্ত প্রচেষ্টায় ২০ বছর পর শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তালিকায় উঠে আসে ঝিনাইদহের খিলাফাত হোসেন জোয়ার্দ্দারের সন্তান লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দারের নাম। গেজেটে তাঁর সিরিয়াল নম্বর ১৫৭।

হোসনে আরা বলেন, "১৯৮৮ সালে আমি গেলাম পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ডে (এপিএনবি)। তাদেরকে বললাম আমি একটা জমি বা ফ্ল্যাট চাই। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বহুবার আমি ওই অফিসে গিয়েছি। সেখান থেকে একবার বলে, উনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তখন মুক্তিযোদ্ধার সনদ আনালাম ঝিনাইদহ থেকে। শেষে বলে উনি তো বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। তখন আমি ডিফেন্স সেক্রেটারির কাছে গেলাম। এরপর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশ করা হল।"

১৯৯৩ সালে সরকারের পক্ষ থেকে সন্তানদের পড়াশোনার জন্য ভাতা এবং একখণ্ড জমি পান হোসনে আরা। তবে সন্তানদের পড়াশোনার বয়স শেষ হওয়ায় সে ভাতা তিনি আর নেননি। মিরপুরে ৩ কাঠার একটি জমি সরকার তাকে দেয়। তবে সে জমিটি ছিলো স্থানীয় এক ব্যক্তির দখলে। নানা চেষ্টায়, বহু বছর পর সে জমি উদ্ধার করেন সংগ্রামী এই নারী। 

মোহাম্মদপুরের বাসায় বসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এই প্রতিবেদককে যখন নিজের জীবনের গল্প বলছিলেন, তখন বারবার স্মৃতিকাতর হয়ে যাচ্ছিলেন সত্তর পেরুনো হোসনে আরা। চোখের কোণে চিকচিক করছিল জল। জীবনের লড়াই সংগ্রামে তিনি অনেককিছুই হারিয়েছেন। সন্তান, সংসার, চাকরি, সমাজ সবকিছু একাই সামলেছেন। তবুও হাল ছেড়ে দেননি কখনো। দক্ষ নাবিকের মতো সমস্ত ঝঞ্ঝামূখর সময়ে সামনে এগিয়ে গেছেন তিনি। এখনো এগিয়ে যাচ্ছেন এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্ত্রী।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.