সিলেটের চুনাপাথরে একচ্ছত্র দখল ছিল গ্রিক বণিকদের, ছিল অনুগত পাহাড়ি ও খাসিয়ারা

ফিচার

11 December, 2021, 11:30 pm
Last modified: 15 December, 2021, 03:41 pm
ব্রিটিশদের আগে সিলেটে পা পড়ে গ্রিক বণিকদের। চুনা পাহাড়গুলো তখন বিভিন্ন পাহাড়ি গোষ্ঠীপতির নিয়ন্ত্রণে। দুর্ধর্ষ পাহাড়ি ও খাসিয়াদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে গ্রিকরা। কিন্তু কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পরই পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে। পাহাড়ি ও সমতলের বিভিন্ন বাণিজ্যপথ, বনাঞ্চল এবং খনিজ সম্পদের দখলদারি নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন পক্ষের বিরোধ। গ্রিক ব্যবসায়ী, কোম্পানি, স্থানীয় জমিদার, পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে এই স্বার্থসিদ্ধির দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল?

বাংলায় ইউরোপীয়দের জাহাজ

বাংলার প্রাচুর্যে আকৃষ্ট হয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এদেশে পাড়ি জমিয়েছিল ইউরোপীয়রা। সিলেটের প্রসিদ্ধ চুনাপাথরের ব্যবসায় বিনিয়োগ করে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বহু কর্মচারী বিপুল অর্থ-বিত্তের অধিকারী হয়। তবে ব্রিটিশদের আগে সিলেটে পা পড়ে গ্রিক বণিকদের। চুনা পাহাড়গুলো তখন বিভিন্ন পাহাড়ি গোষ্ঠীপতির নিয়ন্ত্রণে। দুর্ধর্ষ পাহাড়ি ও খাসিয়াদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে গ্রিকরা। কিন্তু কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পরই পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে। পাহাড়ি ও সমতলের বিভিন্ন বাণিজ্যপথ, বনাঞ্চল এবং খনিজ সম্পদের দখলদারি নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন পক্ষের বিরোধ। গ্রিক ব্যবসায়ী, কোম্পানি, স্থানীয় জমিদার, পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে এই স্বার্থসিদ্ধির দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল?

বাংলায় গ্রিকদের আগমন

১৭৪০ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে সন্ধি অনুযায়ী অটোমান রাজ্যের অধিবাসীরা বিভিন্ন ইউরোপীয় দূতাবাসে দোভাষী ও দূত হিসেবে কাজের সুবিধা লাভ করে। ফলে অটোমানদের অধীনে থাকা গ্রিক, ইহুদী ও আর্মেনীয়রা দোভাষী হিসেবে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভারতবর্ষে পাড়ি জমাতে থাকে। ব্রিটিশদের কাছে এমনকি ভারতবর্ষেও তারা নিম্নবর্ণের ইউরোপীয় হিসেবে পরিচিত ছিল।

এদিকে সে সময় অটোমানদের অধীনে থাকা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীও বিদ্রোহ শুরু করে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বৈরী হয়ে ওঠে। তখনও গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গ্রিকদের মধ্যে ভারতে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বাড়ে।

গ্রিক ব্যবসায়ী আলেকজিওস আরজিরির হাত ধরে বাংলায় গ্রিকরা বাণিজ্য বিস্তার করে। ১৭৭০ সালে আরজিরি আরবীয় দোভাষী ও দূত হিসেবে কোম্পানির জাহাজে কাজ নেন। আরজিরির সমঝোতায় কায়রোতে কোম্পনি সফলভাবে সুয়েজ অঞ্চলে বাণিজ্য করার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন লাভ করে।

১৭৭২ সালে বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন ওয়ারেন হেস্টিংস। আরজিরির দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকে কলকাতায় গ্রিক চার্চ নির্মাণের অনুমতি দেন। কিন্তু কলকাতায় চার্চের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৭৭৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আরজিরি কলকাতা থেকে পূর্ব বাংলায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম বিস্তার করেছিলেন। ঢাকা ও বাকেরগঞ্জে তিনি প্রচুর সহায়-সম্পত্তি গড়ে তুলেন। তার মৃত্যুর পর বড় ছেলে আলেকজান্ডার প্যানিওটি ব্যবসার দায়িত্ব নেন। ১৭৫০ সালে ফিলিপ্পোপোলিসে প্যানিওটির জন্ম। তিনি বাংলায় আসেন ১৭৭১ সালে। আরজিরির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্যবসার কাজে প্যানিওটি বাবাকে সাহায্য করতেন। বাবার যোগ্য সন্তান হিসেবে বাংলায় বাণিজ্য বিস্তার করেছিলেন প্যানিওটি। সিলেটে চুনের ব্যবসায় তিনি গ্রিক বণিকদের নেতৃত্ব দেন।

সিলেটের তৎকালীন ভৌগলিক, সামাজিক ও শাসন ব্যবস্থা

পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর বঙ্গদেশে ইংরেজদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মীর জাফরের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় দেওয়ানি লাভ করে। সিলেট তখন বাংলার অধীনে। তবে কোম্পানি কেবল রাজস্ব আদায়ের ভারই পায়, শাসন ক্ষমতা তখনো মুসলিম ফৌজদারদের হাতেই।

ইতিহাসবিদ ডেভিড লাডেনের মতে, সিলেটের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং বন্যার জন্য সেখানে উপনিবেশবাদ সেভাবে বিস্তার করা সম্ভব হয়নি। ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্রের গতি পরিবর্তনের আগ অবধি বছরের অর্ধেক সময় সেখানকার বড় একটি অঞ্চল পানির নিচে থাকত। এছাড়া খাসিয়া ও অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধের মুখে ইংরেজরা সিলেট অঞ্চলের বাইরে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়।

সিলেটের সমাজ ব্যবস্থা তখন উদারপন্থী। বাঙালি ও খাসিয়াদের মধ্যে সামাজিক ও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক। উদারপন্থী এই সমাজে গ্রিক ও অন্যান্য বহিরাগতরা সহজেই মিশে যেতে পেরেছিল। গ্রিক ও খাসিয়াদের সঙ্গে বিরোধের পর এই অঞ্চলে ইংরেজরা বাংলার সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে 'ডিভাইড এন্ড রুল' বিভাজন নীতি অনুসরণ করে। ফলে নষ্ট হয় বহু বছরের জাতিগত বৈচিত্র্য।

সিলেটে চুনাপাথরের বাণিজ্য

ভারতবর্ষে প্রসিদ্ধ ছিল সিলেটের চুনাপাথর। এত উন্নতমানের পাথর দেশের অন্য কোথাও মিলত না। নবাব মীর জাফর ও মীর কাশেমের সঙ্গে চুক্তিতেও ইংরেজরা সিলেটের চুনাপাথরের উল্লেখ করেছিল। তবে ইংরেজদের আগেই গ্রিক ও আর্মেনীয়রা এসব খনিতে বিনিয়োগ করে।

প্রতি বছর সব খনিতে কাজ চলত না। কোথায় পানি উঠছে সেই অবস্থা বুঝে যেখানে খনির পাথর নামানো সুবিধাজনক, সেখানে কাজ হতো। লোহার শাবলের আঘাতে পাথর ভেঙে পাহাড় ঘাটে মজুদ রাখা হতো। ভরা বর্ষায় নৌকায় করে পাহাড় থেকে নেওয়া হতো পাথর। শরৎকালে বনের কাঠ সংগ্রহের পর হেমন্তে চলত 'পোক্তানি'। চৈত্র থেকে বৈশাখে চুন মজুদ রাখা হতো। এরপর সিলেট থেকে ঢাকা ও কলকাতায় পাঠানো হতো চুন। খাজনা, পাথর ভাঙা, শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের বেতন দেওয়ার পরেও ব্যবসায়ীয়া চুনাপাথর রপ্তানি করে দ্বিগুণ লাভ করত। এতো লাভজনক ব্যবসা সেসময় কমই ছিল।

রবার্ট লিন্ডসের চুনের ব্যবসা

রবার্ট লিন্ডসে ১৭৭৬ সালে ভারতবর্ষে আসেন। আড়াই বছর ঢাকায় থাকার পর তাকে কোম্পানির রেসিডেন্ট ও কালেক্টর হিসেবে সিলেটে পাঠানো হয়। দশ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

রবার্ট লিন্ডসের আত্মজীবনীতে সিলেটে চুনাপাথরের ব্যবসার বিবরণ পাওয়া যায়। লিন্ডসে সিলেটে আসার পরই স্থানীয় খাসিয়াদের বিদ্রোহের মুখে পড়েন।

লাভের আশায় লিন্ডসে চুনের ব্যবসায় নামেন। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেন, "চুনের অনুসন্ধানে নেমে জানতে পারলাম গ্রিক, আর্মেনিয়ান ও নিম্নশ্রেণির ইউরোপীয়গণ সীমিত পরিসরে চুনের ব্যবসা করে আসছে। তাদের চেয়ে আমার সুযোগ সুবিধা বেশি থাকায় এই ব্যবসায় অচিরেই একচেটিয়া কারবার করতে পারব বলে মনে হলো।"

লিন্ডসের এই ধারণা অমূলক ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি চুনের ব্যবসায় লাভের মুখ দেখলেন। নবাবী আমলে সিলেট অঞ্চলে কড়ির প্রচলন ছিল। লিন্ডসে কড়ির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে তা দিয়ে চুনাপাথর কিনে রপ্তানি করতেন। ছয় মাসের ভেতর মূল্য হিসেবে রূপার মুদ্রা আসলে, ঢাকায় তা রাজস্ব হিসেবে পাঠানো হতো।

তবে চুনের পাহাড়গুলো ইংরেজদের দখলে ছিল না। সেগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন দলপতিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। লিন্ডসের আগে এই অধিপতিরা গ্রিক, আর্মেনীয়দের পাহাড় ইজারা দিত। লিন্ডসে পাহাড়ের ইজারা নিতে চাইলে তারা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। পান্ডুয়ায় পাহাড়ি অধিপতিদের সঙ্গে লিন্ডসে আলোচনায় বসেন।

পান্ডুয়াভূমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন লিন্ডসে। কিন্তু বৈঠকে বসতেই তিনি ধাক্কা খান। আলোচনা সভা সম্পর্কে লিন্ডসে লিখেছেন, "এই সাধের ইডেন উদ্যানের অধিবাসীদের দেখে আমার চমক ভাঙে। বিপুল পার্বত্য রাজ্যের নানা অংশ থেকে অসংখ্য দলপতি তাদের সহচর নিয়ে রণবেশে উপস্থিত হয়। তাদের ভাবভঙ্গি, যুদ্ধনাদ ও অস্ত্রসঞ্চালন দেখে মনে হলো এরাও অন্যান্য অসভ্য জাতি থেকে ভিন্ন নয়।"

চুনের ব্যবসা নিয়ে কোম্পানি, গ্রিক বণিক ও স্থানীয়দের দ্বন্দ্ব

লিন্ডসে চুনের ব্যবসায় প্রবেশের সঙ্গেই সিলেটে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় বলে জানান ইতিহাসবিদ ডেভিড লাডেন।

চুনাপাথরের বাণিজ্য বাড়ার সঙ্গে পাহাড়ি ও সমতলের বিভিন্ন বাণিজ্যপথ, বনাঞ্চল এবং খনিজ সম্পদের দখলদারি ও স্বার্থসিদ্ধির দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন পক্ষ। কালেক্টর লিন্ডসের ব্যক্তিগত প্রবৃদ্ধির আকাঙ্খা, প্রতিকূল অঞ্চলে কোম্পানির প্রভাব বিস্তার, খাসিয়া দলপ্রধান ও পাহাড়িদের আধিপত্য, স্থানীয় বাঙালি অধিবাসী ও ব্যবসায়ী, গ্রিক, আর্মেনিয়ান ও অন্যান্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ী, বাঙ্গালি-খাসিয়া বংশোদ্ভূত এবং জমিদারদের মধ্যে দেখা দেয় মতবিরোধ।

এই অবস্থায় আলেকজান্ডার প্যানিওটি অন্যান্য গ্রিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলিতভাবে বিষয়টি কলকাতার গ্রিক চার্চের পুরোহিত ফাদার কনস্ট্যানটাইন পার্থেনিওসের মাধ্যমে গভর্নর জেনারেলের কাছে উত্থাপন করেন। লিন্ডসের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির বিষয়ে তারা অভিযোগ আনেন।

ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল থাকাকালে গ্রিক ব্যবসায়ীদের প্রতি উদার ছিলেন। দুর্নীতি ও বাংলার মানুষকে অত্যাচারের অভিযোগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অভিশংসনের মুখোমুখি হন হেস্টিংস। ১৭৮৬ সালে গভর্নর জেনারেলের পদে আসেন কর্নওয়ালিস। কর্নওয়ালিস আসার পরই গ্রিক ব্যবসায়ীদের প্রতি কোম্পানির মনোভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করে।

গ্রিকদের অধীনে কর্মরতদের আটক করে কোম্পানির সৈন্য

১৭৮৮ সালে লিন্ডসের পরিবর্তে জন উইলসকে কালেক্টর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। উইলসের সঙ্গেও প্যানিওটি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।

প্যানিওটি ঢাকায় থাকতেন। তিনি তার প্রতিনিধি হিসেবে গ্রিক অভিবাসী পাওলি স্ট্র্যাটিকে সিলেট পাঠান। স্থানীয় জমিদার পুরোয়া রাজ শ্রী রাম নৌমের কাছ থেকে পাওলি বার্ষিক ১৬ রুপিতে তেহলি খালের (তেলি খাল) ইজারা নেন।

তেহলি থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ করে চুন উৎপাদনের অনুমতিও পান পাওলি। তিনি সেখানে প্রায় ১০০ কর্মীকে কাজে লাগান। কিন্তু পাওলির কর্মীদের আটক করেন উইলস।

প্যানিওটি পুনরায় গ্রিক চার্চের পুরোহিতের মাধ্যমে বিষয়টি নতুন গভর্নর জেনারেলকে অবহিত করেন। তিনি অভিযোগ করেন, উইলস কেবলমাত্র হাতেগোনা কয়েকজন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীকে সিলেটে চুন ব্যবসার অনুমতি দিয়েছেন। কোম্পানির সৈন্য ব্যবহার করে তিনি অন্যান্য ব্যবসায়ীদের উৎখাত করছেন বলেও অভিযোগ আনা হয়।

অন্যদিকে উইলস দাবি করেন, মুঘল সরকার তেলি খাল কোম্পানিকে হস্তান্তর করলেও পাহাড়ি খাসিয়ারা তা জোর করে দখলে নিয়ে ইজারা দিয়েছে। তবে এই দ্বন্দ্বের সমাধান কীভাবে হয়েছিল সে সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। এর কিছুদিন পরই পাওলি স্ট্র্যাটিকে সিলেট ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে প্যানিওটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হন।

গ্রিকদের বিরুদ্ধে খাসিয়াদের অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ

খাসিয়াদের সঙ্গে গ্রিকদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো হওয়ায় কোম্পানির কালেক্টররা গ্রিক বণিকদের প্রতি বিরক্ত ছিলেন।

খাসিয়া অধিপতিরা পাহাড়ের পাদদেশে গ্রিকদের ব্যবসার অনুমতি দেন। তারা চুনাপাথরের খনিগুলো ইজারা নিয়ে ঢাকা ও কলকাতায় বাণিজ্য করতেন।

কালেক্টররা সন্দেহ করেছিল গ্রিক ও অন্যান্য নিম্নশ্রেণির ইউরোপীয়রা বাণিজ্যিক সম্পর্কের জেরে খাসিয়াদের বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহ করবে এবং কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিহত করতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের উস্কে দিবে।

এমনকি কালেক্টররা বহুবার পাহাড়ি অঞ্চলে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের অস্ত্র চালান পাকড়াও পর্যন্ত করে। তারা ভয় পেয়েছিল যে খাসিয়া আক্রমণের আঁচ ঢাকাতেও কোম্পানির শাসনে প্রভাব ফেলবে। আর তাই গ্রিক ব্যবসায়ীদের তারা কড়া নজরে রেখেছিল। এছাড়া এই ব্যবসায়ীরা কোম্পানির বাইরে খাসিয়া অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে পৃথক উপনিবেশ গড়ে তুলবে বলেও তাদের আশঙ্কা ছিল।

বিদ্রোহ দমন ও বাংলার সীমানা নির্ধারণ

১৭৮৮ সালে কোম্পানির আশঙ্কাই সত্যি হয়। বাঙালি-খাসিয়া জমিদার গঙ্গা সিংয়ের সঙ্গে মিলিতভাবে খাসিয়া অধিপতি ও অন্যান্য বাঙালি ও খাসিয়া জমিদাররা পান্ডুয়ায় কোম্পানির একটি কুঠিতে হামলা করে।

লিন্ডসের আত্মজীবনী অনুসারে গঙ্গা সিং ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রিয়পাত্র। হেস্টিংস তাকে সিলেটসহ বাংলার বেশ কিছু অঞ্চলে ইজারা দিয়েছিলেন।

গঙ্গা সিংয়ের বিদ্রোহ দমনে নতুন গভর্নর জেনারেল শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করে। ১৭৮৯ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডেভিড লাডেনের মতে, এর ফলে ওই অঞ্চলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ১৭৯০ সালে কোম্পানি উত্তরাঞ্চলে বাংলার সীমানা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমান সীমান্তের কাছেই পাহাড়ি অঞ্চলের সঙ্গে সমতল ভূমির সীমারেখা তৈরি হয়।

নতুন সীমানা অনুযায়ী, পার্বত্য ভূমি খাসিয়াদের এবং সমতল ভূমি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আসে। এরই মধ্য দিয়ে বাঙালিদের সঙ্গেও খাসিয়াদের সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। উদারপন্থী বাঙালি-খাসিয়া সমাজ পৃথকীকরণের মাধ্যমে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ওই অঞ্চলের জাতিগত বৈচিত্র্য নষ্ট হয়।

চুনের ব্যবসায় কোম্পানি ও ব্রিটিশদের আধিপত্য

নতুন নির্ধারিত এই সীমা ব্যবসায়ীদের কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলে। সিলেটে সব ধরনের ব্যবসা কোম্পানির অধীনে পরিচালনার মনস্থির করেন উইলস। ১৭৯০ সালের পর খাসিয়াদের অঞ্চলে সকল বেসরকারি বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে সিলেটের সমতল ভূমিতে ব্যবসার জন্য কালেক্টরের অধীনে রেজিস্ট্রেশনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

চুনের ব্যবসার জন্য এরপর থেকে কালেক্টরের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। কোম্পানির অধীনস্ত সুনামগঞ্জ ও কোম্পানিগঞ্জ- কেবলমাত্র এ দুটি জায়গায় চুনাপাথর সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়, পাহাড়ি অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে কোম্পানিগঞ্জ।

তবে সমতলের ব্যবসায়ীরা তখনও খাসিয়া অঞ্চলে খনির ইজারা নেওয়া অব্যাহত রাখে। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের মধ্যে চুনাপাথরের ব্যবসার জন্য যাদের লাইসেন্স প্রদান করা হয় তারাও অবৈধভাবে সেসব অঞ্চল থেকে চুনাপাথর আহরণ করতে থাকে। কোম্পানির মৌন সমর্থন লাভ করে এসব ব্যবসায়ীরা।

১৭৯৯ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে চুনের ব্যবসা গ্রিকসহ সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। কিন্তু ততোদিনে গ্রিকরাও পরিস্থিতি বুঝতে পেরে অন্যান্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছে। আলেকজান্ডার প্যানিওটি চুনের ব্যবসা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে লবণ ব্যবসায় মনোযোগ দেন। পাহাড়ি অঞ্চলের চুনার খনিগুলোতে ব্রিটিশ বণিকদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সময়ের সঙ্গে সিলেট থেকেও মুছে যায় গ্রিকদের অস্তিত্ব।


সূত্র:

  • From Thrace to Bengal: Greek Merchants in Early Colonial Bengal, Kanda Sayako
  • শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত, অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.