পঁচা ইলিশের ‘বুদ্ধা’: যে অঞ্চলে পঁচে গেলেও কদর কমে না ইলিশের!

ফিচার

09 December, 2021, 02:50 pm
Last modified: 09 December, 2021, 03:30 pm
শিলপাটায় মরিচ বেটে মসলা মেখে বিশেষভাবে তৈরি হয় পঁচা ‘ইলিশ বুদ্ধা’। গরম ভাতের সাথে ইলিশ বুদ্ধা খাওয়ার জুড়ি নেই। অসামান্য স্বাদ। যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় এই বুদ্ধা খেয়ে আসছে এ অঞ্চলের মানুষেরা।

১.
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের স্বাদ আর নানা রকম ব্যবহার নিয়ে বাড়তি বলার কিছু নেই। ইলিশের রান্নাবান্না ও ব্যবহারে রয়েছে শত রকমের রেসিপি।

সবগুলোই মূলত তাজা বা সংরক্ষিত ইলিশে তৈরি করা হয়। অন্যান্য মাছের বেশিরভাগই পঁচে গেলে তা আর খাওয়ার উপযোগী থাকে না। কিন্ত ইলিশ মাছ পঁচে গেলেও এর কদর কমে না। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে পঁচা ইলিশের কদর সতেজ ইলিশের মতোই। অনেক সময় বাজারে পঁচা ইলিশ কেনা নিয়ে কাড়াকাড়িও হয়।

পঁচা ইলিশের তৈরি 'ইলিশ বুদ্ধা' বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের বিশেষ একটি খাবার। 'ইলিশ বুদ্ধা' মূলত ইলিশ মাছের ভর্তার মতো একটি বিশেষ খাবার রেসিপি। ইলিশের জেলা লক্ষ্মীপুরের কয়েকজন জেলে ও অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বললে এ রকম তথ্য জানা যাবে।

যেমন লক্ষ্মীপুরের মধ্যবয়সী ফাতেমা আক্তারকে জিজ্ঞেস করে আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর পাই: শিলপাটায় মরিচ বেটে মসলা মেখে বিশেষভাবে তৈরি হয় পঁচা 'ইলিশ বুদ্ধা'। গরম ভাতের সাথে ইলিশ বুদ্ধা খাওয়ার জুড়ি নেই। অসামান্য স্বাদ, তার ভাষায়। যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় এই বুদ্ধা খেয়ে আসছে নোয়াখালীবাসী। আমার এর সঙ্গে পরিচয় ৯০-এর দশকে, এ সময়ে বাজারে প্রচুর পঁচা ইলিশ বিক্রি হতো। বর্তমানে পঁচা ইলিশ পাওয়া ভাগ্যেও ব্যাপার! যে কারণে ইলিশের বুদ্ধা খেতে এখন অনেকে তাজা ইলিশ ইচ্ছেকৃতভাবে পঁচিয়ে বুদ্ধা তৈরি করে বলেও জানালেন ফাতেমা আক্তার।

কামাল নামে এক জেলের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, আনুমানিক ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় প্রচুর পঁচা ইলিশ পাওয়া যেত। কিন্ত ৯০-এর দশকের পর এখন পঁচা ইলিশ পাওয়া যায় খুবই কম। বর্তমানে না পাওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ৯০-এর দশক পর্যন্ত উপকূলের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। সে কারণে নদীকূলে বরফমিল বেশি ছিল না। সে জন্য জেলেদের বরফ ছাড়া ইলিশ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে হতো। সে কারণে অনেক ইলিশ পঁচে যেত। পরে পঁচা ইলিশ তাজা ইলিশের তুলনায় কম দামে বিক্রি হতো।

মেঘনা নদীপারের বাসিন্দা মো. হাসান জানান, ইলিশ পঁচে গেলেও তা ফেলে দেয়া হতো না। পঁচা ইলিশ বিক্রি হয়। আগেরকার দিনে তাজা ইলিশের তুলনায় একটু কম দামে বিক্রি হতো পঁচা ইলিশ। বর্তমানে প্রায় সমান দামে বিক্রি হয়।

হাসান আরও জানান, পঁচা ইলিশ কিনে বাড়ি নিয়ে তা দিয়ে জনপ্রিয় রেসিপি ইলিশের বুদ্ধা তৈরি করা হতো। পরে তা গরম ভাতের সাথে অনেকে মজা করে খায়।

বর্তমানে পঁচা ইলিশ পাওয়া না যাওয়ার কারণে অনেকে তাজা ইলিশ মাছকে ইচ্ছেকৃত পঁচিয়েও বুদ্ধা তৈরি করার কথা বোঝাতে গিয়ে তিনি জানান, নাপতি বাংলাদেশে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিকট জনপ্রিয় খাদ্য। নাপতি তৈরি হয় মাছ ও মাংস পঁচিয়ে। ঠিক তেমনিভাবে উপকূলীয় বাসিন্দাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় পঁচা ইলিশের বুদ্ধা।

বঙ্গোপসাগরে ইলিশ মাছ ধরার জেলে রছিম মাঝি জানান, বর্তমানে চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটে মাঝেমধ্যে পঁচা ইলিশ পাওয়া যায়।

তবে সাগরের পঁচা ইলিশের তুলনায় নদীর পঁচা ইলিশের স্বাদ দ্বিগুণ।

স্বাদ আর গন্ধ যাই থাকুক, খাদ্যের গন্ধ পরির্বতন হলে যাদের পেটে সমস্যা হয়, তাদের জন্য পঁচা ইলিশের বুদ্ধা না খাওয়াই ভালো, এমন উপদেশ স্থানীয় চিকিৎসকদের। তবে পঁচা ইলিশের বুদ্ধা খাওয়া অনেকেই বলেছেন, তাদের কখনো কোনো সমস্যা হয়নি।

২.
কম স্বাদের পুরুষ ইলিশকে বলে 'হয়া'

ইলিশ মাছের স্বাদের পার্থক্য হয় নানা কারণে। প্রথমত, সাগরের ইলিশের তুলনায় নদীর ইলিশ স্বাদ বেশি। আবার নদীর মধ্যে মেঘনার ইলিশ সবচেয়ে সুস্বাদু। এমন দাবি নিয়মিত ইলিশ খাওয়া ব্যক্তিদের। নদীর ইলিশ নিয়ে জেলে, ব্যবসায়ী এবং স্থানীয়রা তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন ভিন্ন কথা। তাদের অভিজ্ঞতামতে, অন্যান্য পার্থক্যের পরে ইলিশের স্বাদের পার্থক্য দেখা দেয় পুরুষ ও স্ত্রী ইলিশের কারণেও। স্থানীয়রা পুরুষ ইলিশকে বলে 'হয়া ইলিশ'। হয়া ইলিশের চাহিদা বাজারে কম, কারণ এর স্বাদ কম। আবার হয়া ইলিশ বাজারেও পাওয়া যায় কম।

প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত ইলিশ ধরা জেলে কবির হোসেন জানান, পুরুষ ও স্ত্রী ইলিশের আসল পার্থক্য বোঝা যায় খাওয়ার সময়। পুরুষ ইলিশের স্বাদ একেবারে কম। তবে এ অভিজ্ঞতা ধরা পড়বে তাদের কাছে যারা নদীপারের বাসিন্দা কিংবা নিয়মিত ইলিশ কেনে এবং খায়। যারা মাঝেমধ্যে কিংবা শহরে বসে ইলিশ কেনে তাদের পক্ষে পুরুষ ও স্ত্রী ইলিশের স্বাদ বোঝা প্রায় অসম্ভব। স্ত্রী ইলিশের স্বাদ বেশি। স্থানীয়রা পুরুষ ইলিশকে বলে 'হয়া ইলিশ'। হয়া ইলিশের চাহিদা বাজারে কম থাকে। তবে তা চিনতে হয়।

নূরনবী নামে ঘাটের এক আড়তদার জানান, পুরুষ ইলিশের শরীর চিকন ও লম্বা এবং মাথাটা একটু ছড়ানো। সাধারণত বাজারে পুরুষ ইলিশ কম পাওয়া যায়। প্রতি ২০-৩০টির মধ্যে ৩-৪টি পুরুষ ইলিশ থাকে বলেও জানান তিনি। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, বর্ষাকালে পুরুষ ইলিশ খুবই কম পাওয়া যায়। আর পুরুষ ইলিশ চেনার আরেকটি উপায় হচ্ছে, পুরুষ ইলিশের গায়ে ইলিশের গন্ধ কম থাকে। কিন্ত স্ত্রী ইলিশের গায়ে বেশি গন্ধ থাকে।

নূরনবী আরও জানান, সব পেশাদার জেলেই পুরুষ ও স্ত্রী ইলিশ চেনে। স্ত্রী ইলিশ পুরুষ ইলিশের চেয়ে আকারে বড় এবং গোল বা পেট মোটা। স্ত্রী ইলিশের স্বাদ অনেক বেশি। পেটের নিচের অংশে কিছুটা মোটা ছিদ্র থাকে। স্ত্রী ইলিশ মাছ কুটে পানিতে ধুয়ে রাখতে গেলে হাত ইলিশের তেলে চকচকে ও পিচ্ছিল হয়ে যায়।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.