এ গ্রামের টমটম চালায় সারাদেশের শিশুরা

ফিচার

21 March, 2024, 10:15 pm
Last modified: 21 March, 2024, 10:15 pm
কারিগরেরা জানান, খেলনা তৈরিতে একেক জন একেক অংশের কাজ করেন। গড়ে প্রতিদিন ১০০টি খেলনা তৈরি করেন তারা। প্রতিটি টমটম তৈরিতে খরচ পড়ে অন্তত ছয়টাকা। পাইকারি হিসেবে আট থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে মেলায় বা খুচরা হিসেবে প্রতিটি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করেন বিক্রেতারা।

মাঘের শীতকে তুড়ি মেড়ে সূর্য তার দাপুটে রোদ ছড়াচ্ছে। সে রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামটির প্রতিটি বাড়ির উঠোনে ব্যস্ততা বাড়ে বাড়ির লোকদের।

মাটির সারি সারি একতলা-দোতলা বাড়ির গলি দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল গ্রাম-বাংলার মেলায় বহুল প্রচলিত শিশুদের খেলনা রংবেরঙের টমটম গাড়ি বা টরটরি গাড়ি তৈরির দৃশ্য। এছাড়াও চলছে কাঠের গাড়ি, কাঠের চরকা, কাঠের পাখি, কাঠের ট্রাক, বেহালা, সারিন্দা, ঘিন্নিসহ হরেক খেলনা তৈরির উৎসব।

বাড়ির নারী ও কিশোরীদের কাঠিতে রং লাগানো ও কাগজে আলপনা আঁকার আয়োজন বসে প্রতিটি উঠোনে। চলে কাঠ, বাঁশ আর কাগজ দিয়ে শিশুদের এসব খেলনা বানানোর কাজ।

বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে দুপচাঁচিয়ার ধাপের হাটের উত্তরের এ গ্রামটির নাম খোলাশ। তবে লোকে 'টমটম গ্রাম' হিসেবে বেশি চেনে।

এ গ্রামের বাসিন্দাদের বানানো খেলনার মধ্যে টমটম গাড়ির আধিক্য এবং দেশব্যাপী সেগুলোর ব্যাপক প্রচলন থাকায় গ্রামটির নাম স্থানীয় লোকজন দিয়েছেন টমটম গ্রাম।

গ্রাম-বাংলার মেলার বেশ প্রচলিত খেলনা টমটম। উপজেলার সদর ইউনিয়নের খোলাশ গ্রাম শিশুদের এসব গ্রামীণ খেলনা বানানোর জন্যই কয়েক যুগ ধরেই প্রসিদ্ধ।

ছোট ঠেলাগাড়ির আদলে তৈরি এই টমটম খেলনা। গাড়ির ওপরে মাটির একটি বাটি শক্ত কাগজে মোড়া। এতে দুটো কাঠি বসানো থাকে। গাড়ির আগা সুতো দিয়ে বাঁধা। ছোট ছেলে-মেয়েরা গাড়িটি টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় কাঠি দুটি মাটির বাটিতে বাড়ি খায়। আর টমটম করে শব্দ হয়। এ জন্যই নাম টমটম গাড়ি।

বাংলাদেশে কেবল খোলাশ গ্রামেই এরকম খেলনা বানানো হয়। এসব খেলনা বানানোকে কেন্দ্র করেই প্রতিটি ঘরে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প। গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবারে সব পরিবারই খেলনা তৈরির সঙ্গে যুক্ত।

বছরজুরেই এ গ্রামের কারিগরেরা এসব খেলনা বানিয়ে দেশের বিভিন্ন মেলা ও উৎসবের সময় বিক্রয়ের কাজ করলেও ব্যস্ততা বেশি বেড়ে যায় বাংলা নববর্ষের উৎসব ঘিরে।

বর্তমানে ৭টি কারখানাসহ খোলাশের প্রায় ২০০ ঘরেই তৈরি হচ্ছে শিশুদের খেলনা। টমটম গাড়ির মাটির খুড়ি ও চাতকি তৈরি হচ্ছে পাশের চেঙ্গাপালপাড়া গ্রামে। সব মিলিয়ে খেলনা তৈরির এ পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। বছরে এ গ্রামে এসব খেলনাকে কেন্দ্র করে প্রায় শত কোটি টাকার ব্যবসা দাঁড়িয়েছে।

দেখানো পথে খোলাশ পূর্বপাড়ার একটি গলি ধরে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল রাস্তার লাগোয়া মাটির বাড়ি। দরজা থেকেই দেখা যায় বাঁশ চিকন করে কাটা। এক পাশে স্তুপ করে রাখা মাটির ছোট বাটি। তিন নারী একত্রে বসে কাজ করছেন। অপরিচিত মানুষ দেখে ঘোমটা একটু টেনেই দিলেন তারা।

জিজ্ঞেস করলে বললেন, এ খেলনার নাম টমটম। দেশব্যাপী বিভিন্ন মেলাকে কেন্দ্র করে এগুলো তৈরি করেন তারা। সারাবছর চলে খেলনা তৈরি ও বিক্রি। এটা তাদের পারিবারিক ব্যবসা।

খোলাশ গ্রামে খেলনা তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম অনেককে। সঠিক সময়কাল কেউ ঠিক মতো বলতে পারেন না। তবে প্রবীণ কারিগর ও ব্যবসায়ী অবেদ আলী মুখে শুরুর গল্পটা কিছুটা শোনা হয়। তিনি জানান কুড়ানুর হাত ধরে এ খেলনা বানানোর শুরুর কথা।

প্রায় ৬০–৭০ বছর আগে পাকিস্তান আমলে কুড়ানু নামের এ গ্রামের একজনের হাত ধরে শুরু হয় টমটম খেলনা তৈরি। কুড়ানু ছোট বেলায় হারিয়ে যায়। তাকে খুঁজে পায় সৈয়দপুরের কয়েকজন বিহারী। তাদের কাছে থেকে টমটম খেলনা তৈরি করা শিখে বড় হয়ে গ্রামে ফিরে আসে সে। তখন পরিপূর্ণ যুবক কুড়ানু। গ্রামে এসে শুরু করে টমটম খেলনা তৈরি। তার কাছে থেকেই গ্রামের অন্যরা টমটম বানানো শেখেন।

গ্রামীণ মেলার এখনো প্রধান আকর্ষণ শিশুদের খেলনা টমটম মনে করিয়ে দেয় বাঙালির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। বিশেষ করে বাংলা নববর্ষে শহর ও গ্রামে মেলা শুরু হলে দেখা মেলে এ খেলনার।

বগুড়ার ব্যবসায়ী ও কারিগরদের দাবি, দেশের মধ্যে শুধু বগুড়া জেলার এ গ্রামেই টমটম খেলনা তৈরি করা হয়।

টমটম তৈরিতে ব্যস্ত নারীদের সঙ্গে খেলনা বানানো নিয়ে আলাপ হয়। তারা জানান, করোনার কারণে দুই বছর সব খেলনা তৈরি বন্ধ ছিল। ওই সময়টায় অন্য কাজ করে সংসার চালাতে হয়েছে তাদের। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ায় ২০২২ সাল থেকে আবার আদি পেশা শুরু করেছেন তারা।

নারী কারিগরদের কর্মব্যস্ততায় সারাবছর মুখর থাকে খোলাশ। কারিগর তাহেরা বিবি বলেন, 'হামার দুই বেটা, এক বেটি। হামি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই কাম করি। এই খেলনা বানেই বেটিক বিয়া দিসি।'

তার স্বামী অসুস্থ বলে উপার্জন করতে পারেন না। ছেলেরাও মা-বাবার খোঁজ নেন না। 'বেটারা হামার খবর লেয়না, হামিই নিজে সংসার চালায় এই খেলনা ব্যানে [বানিয়ে],' বলেন তিনি।

তাহেরা এক হাজার খেলনা বানিয়ে ৭০ টাকা পান। প্রতিদিন তিনি প্রায় ১,০০০–১,২০০০ খেলনা বানাতে পারেন। 'আজ এই গাওত যদি এই খেলনা বানানোর কাম না থাকত, হামি কি করে খানোনি (চলতাম),' বলেন তিনি।

প্রথমে ঘোমটা টেনে দিলেও খোলাশ পূর্বপাড়ার তিন কারিগর আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের একজন বুলবুলি বেওয়া। বয়স প্রায় ৫০। এ গ্রামে তার জন্ম; বিয়েও এখানেই। তার বাবার হাতে ধরে এ কাজ শেখা। এখনও খেলনা তৈরি করছেন।

বুলিবুলি বলেন, এটি তার মামার বাড়ি। মামি, মামাতো ভাই ও তিনি মিলে টমটম খেলনা তৈরি করেন। আর মামাতো ভাই জাফর সেগুলো বিভিন্ন মেলায় নিয়ে বিক্রি করেন।

কে কি তৈরি করেন এমন প্রশ্নে বুলবুলির মামি মালেকা বেগম কথা টেনে নেন। হাসি দিয়ে বলেন, 'এল্লা কি বাপু ছেলেরা করে। হামরা মেয়েছেলেদের হাতে হয়। এই বাঁশ কাটা, বাটির মুখ বন্ধ করে বাঁশের সাথে বান্ধি। চাকা লাগাই। বাড়ির বউ বাটিত রং করে। তারপর না হয় টমটম।'

মালেকা বলেন, খেলনা বানানোর মৌসুম মেলা দিয়েই হয়। দুর্গাপূজার আগে থেকে শুরু হয়ে রথযাত্রা মেলায় গিয়ে বানানো শেষ হয়।

আসলেই গ্রামে প্রত্যেক বাড়িতে খেলনা তৈরিতে নারীদের হাতের ছোঁয়াই বেশি। ছেলেরা সাধারণত কাঁচামাল ক্রয় করা এবং বাইরে বিক্রির বিষয়টি দেখাশোনা করেন।

কারিগরেরা জানান, খেলনা তৈরিতে একেক জন একেক অংশের কাজ করেন। গড়ে প্রতিদিন ১০০টি খেলনা তৈরি করেন তারা। প্রতিটি টমটম তৈরিতে খরচ পড়ে অন্তত ছয়টাকা। পাইকারি হিসেবে আট থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে মেলায় বা খুচরা হিসেবে প্রতিটি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করেন বিক্রেতারা।

টমটম ছাড়াও কারিগরেরা আরও কয়েক ধরনের খেলনা তৈরি করেন। এগুলোর মধ্যে পাখি গাড়ি, কাঠের ট্রাক বেশি বানানো হয়। এই পাখি গাড়ি বানাতে প্রতিটিতে খরচ পড়ে যায় প্রায় ১০ টাকা। পাইকারি হারে বিক্রি হয় ১৪ টাকায়। ট্রাক বানাতে খরচ পড়ে আরও বেশি; ২০টাকার ওপরে।

আলাপের এক পর্যায়ে যোগ দেন মালেকার ছেলে ৩১ বছরের জাফর আলী। বাবা কছিম উদ্দিনের হাত ধরে এ পেশায় যুক্ত হওয়া। ১২ বছর বয়স থেকে যেতেন বিভিন্ন মেলায়। বিক্রি করে আবার ফিরে আসেন বাড়িতে। সংসারের খরচ মিটিয়ে আবার নতুন কাঁচামাল ক্রয় করে প্রস্তুত করেন নতুন খেলনা।

জাফর বলেন, এবার বৈশাখি মেলা করার জন্য খেলনা বানানো হচ্ছে। এ জন্য ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু করা হয় খেলনা তৈরির কাজ। এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার ইউনিট খেলনা বানানো হয়েছে।

'নিজে মেলায় নিয়ে গেলে আয় একটু বেশি হয়। দেশের যেখানে মেলা থাকে সেখানে আমরা খেলনা নিয়ে যাই। এভাবে বছরে গড়ে ৫০ হাজার পিস খেলনা বিক্রি হয়,' বলেন জাফর।

এ গ্রামের বেশ কয়েকজন আছেন যারা তৈরি খেলনা পাইকারি কিনে দেশের বিভিন্ন জেলা ও মেলায় বিক্রয় করেন। তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী ইনছান বেশ নাম করা।

ইনছানের হিসেব মতে, প্রতিবছর গড়ে প্রতি ঘর খেলনার কারিগরেরা বছরে অন্তত ৫০ হাজার পিস টমটমসহ অন্যান্য খেলনা তৈরি করেন।

এ পাইকার জানান, উত্তরবঙ্গের দিকে কম যান গ্রামের পাইকারেরা। চাহিদা ভালো থাকায় তারা সাধারণত খেলনা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এ ছাড়া বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চলেও খেলনা নিয়ে যান পাইকারেরা।

গ্রামের প্রায় ১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খোলাশ গ্রামে পাইকার ব্যবসায়ী আছেন ১০ জন। এ ছাড়া দুপঁচাচিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পাঁচজনের এবং ধাপের হাটে একজনের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে বাইরের জেলার অনেক ব্যবসায়ী আসেন খেলনা ক্রয় করতে।

কারিগর নূর ইসলাম বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এক যুগ আগেও একটি টমটম বিক্রি হতো ৫–৭ টাকায়। আর এখন খরচ বেড়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সারাবছর দেশের কোথাও না কোথাও মেলা চলে। আর এ খেলনার চাহিদা থাকায় একটি টমটম বিক্রি হয় গড়ে ২০ টাকা পর্যন্ত। একজন কারিগর সপ্তাহে ৪শ' টমটম বানাতে পারেন। বৈশাখ মাসে বছরের সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। আর বর্ষার সময় কয়েক মাস বসে থাকতে হয় তাদের।

গ্রামের ২০০ কুটিরশিল্প মালিক নিয়ে গঠিত হয়েছে খোলাশ গ্রাম ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সমিতি। সমিতির বর্তমান সভাপতি আয়াতুর নূর ইসলাম।

তিনি জানালেন, এ গ্রামে মাত্র কয়েক ধরনের খেলনা তৈরি হয়। এ কারিগরদের কোনো সমস্যা দেখার মতো কেউ নেই। 'সরকার চাইলে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের কারিগরদের আরও ভালো মানের খেলনা বানানোর উদ্যোগ নিতে পারে।'

তিন বলেন, 'এখন এ গ্রামের প্রায় সবাই স্বাবলম্বী। কিন্তু কেউ কোনো অর্থকষ্টে পড়লে সমাধান করার কেউ নেই। নিজেদেরই করতে হয়। কোনো ব্যাংক থেকে এসব কুটির শিল্পের নামে কোনো ঋণ পাওয়া যায় না। ফলে অনেকেই বেশি পরিমাণ খেলনা বানানোর পরিকল্পনা করলেও, তা সম্ভব নয়।'

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বগুড়ার উপ-মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) এ. কে. এম. মাহফুজুর রহমান জানেন না খোলাশ গ্রামে এমন হস্তশিল্প রয়েছে বলে। 'তবে তাদের আগ্রহ থাকলে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ বিসিকের সুবিধা নিতে চাইলে তা দেওয়া হবে,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই আর্থিকভাবে সচল না হওয়ায় তাদের ঋণের বিষয় সম্পর্কে আগে জানাতে হবে। কর্মদক্ষতা ও ব্যবসা বাড়াতে বিসিকের পক্ষ থেকে পরিদর্শন করে তাদের সুবিধার বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে।'


ছবি: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড/রাজীব ধর

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.