হারানো বিস্মৃত বিচার গানের খোঁজে…

ফিচার

21 March, 2024, 05:00 pm
Last modified: 21 March, 2024, 11:10 pm
দিনের আলো নিভে এলো, হাওয়ায় শীত শীত ঘ্রাণ, সে ঘ্রাণে ভেসে আসছে মরমী সুর। সে মরমী সুর বুকের ভেতরে অনুভব করতে বসে আছে দুনিয়াবি নিষ্ঠুরতায় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শ্রোতা...

ছবি: নওরীন সুলতানা/টিবিএস

'পথ চিনি না চালান পাতি নাই
অকূলও সাগরের ভিতর কোনবা পথে যাই
আমায় দয়া কর দয়াল গোসাঁই
ঘিরে আইল কাল সন্ধ্যায়।'

দিনের আলো নিভে এলো, হাওয়ায় শীত শীত ঘ্রাণ, সে ঘ্রাণে ভেসে আসছে মরমী সুর। সে মরমী সুর বুকের ভেতরে অনুভব করতে বসে আছে দুনিয়াবি নিষ্ঠুরতায় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শ্রোতা। গায়েনদের কণ্ঠে ভেসে আসে স্রষ্টার বন্দনা, মানবপ্রেম কিংবা একান্ত আত্মকথন, তা প্রাণ পায় বাদকের সুরের কারুকার্যে। সেই সুর-তাল-লয়ের আধ্যাত্মিকতার সফরনামায় আত্মভোলা হয় হাজারো পথ হারা পথিক হৃদয়।

এ অঞ্চলের ধর্মচর্চা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার এক নিজস্ব দিক গোষ্ঠীবদ্ধতা। নকশিকাঁথার বুননে, জারিগান, পুঁথিপাঠ, পিঠেপুলির উৎসব কিংবা একসাথে ধর্মীয় উৎসব উদযাপন- সকল কিছু মানুষের সাথে মানুষের পারস্পরিক বন্ধনকে ঘিরে। গান এদেশের মানুষের আত্মার খোরাক। সলতে বাতির টিমটিমে আলোয় আসমানে উঁকি দেওয়া আধফালি চাঁদের সাথে ভাব জমিয়ে শীতের মধ্যরাতে ঢুলে ঢুলে পুঁথিতে কমলাসুন্দরী, মহুয়াদের দুঃখ অনুভবে চোখ ভিজে যায় শ্রোতার। আবার কখনো বাউলগানে ভেতরে ভর করে উদাসীন আধ্যাত্মবোধ, মানবপ্রেম। গোষ্ঠীবদ্ধতা, আধ্যাত্মবোধ ও মানবপ্রেমকে শিকড়ে ধারণ করে বঙ্গদেশে নানান শাখা-প্রশাখায় গান বিকশিত হয়েছে। তারই একটি ধারা বিচারগান। বছরের পর বছর আসর মাতানো এই গানের গভীরে যেতে মিলবে কী আরও গভীরতা?

বিচারগান

নাম তার 'বিচারগান'। কিন্তু কিসের বিচার? কাঠগড়ায় কে? নাম শুনেই এসব নানান ধাঁচের প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়। বিচারগানকে মূলত বলা হয়ে থাকে প্রতিযোগিতামূলক গান বা পাল্লার গান। বাংলাদেশের লোকনাটকের একটি স্বতন্ত্র ধারা এ বিচারগান। এ গানে মূলত দুইজন প্রতিপক্ষ গায়েন কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে বাদক ও সহকারী দোহারদের সহযোগিতায় একধরনের তর্ক-বিতর্কের নাটকীয় উপস্থাপন করে থাকেন। দোতরা, বেহালা, জুড়ি, বাঁশি, হারমোনিয়াম, ডুগিতবলা, খোল, করতালের মত নানান বাদ্যযন্ত্র বিচারগানের আসর জমায়। 

'সপ্ততালা আসমান জমিন
এই মানুষের মধ্যে ঘেরা
চৌদ্দ ভুবন জোড়া মানুষ
চৌদ্দ ভুবন জোড়া।'

বিচারগানে তর্ক-বিতর্কের নানান বিষয়  থাকে। ঘরে বসত করা ঘরের কারিকরকে নিয়ে কখনো গায়েনরা গাইছেন দেহতত্ত্বের গান, কখনো বা আদমতত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব বা সামাজিক রীতিনীতির বিশ্লেষণ চলছে হাদিস, কোরআন, বেদ, বাইবেলের সাহায্যে। গায়েনদের গায়কির জাদু ও উপস্থিত বুদ্ধির ঝলকে গান শুনতে শুনতে সহজেই রাত পেরিয়ে যায় যেন। এসব তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে উঠে আসে ধর্ম, দর্শন ও সমাজ-বাস্তবতার নানান দিক। বিচারগানের আসরে জারিগান, কবিগান, পুথিপাঠ, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালিসহ নানা ধরনের গান গাইতে দেখা যায়। মূলত এসব গানের সমন্বয়ে প্রতিযোগিতামূলক তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে বিচারগান একটি স্বতন্ত্র রূপ পায়।

নাম-ঠিকানা নিয়ে যত তর্ক-বিতর্ক

তর্ক-বিতর্ককে ঘিরেই যে গান, সেই গানকে ঘিরে একটু তর্ক-বিতর্ক হবে না– তা আবার হয় নাকি? এক বিচারগানের রয়েছে হরেক রকম নাম; যা ফরিদপুর-মানিকগঞ্জে বিচারগান, তাই আবার যশোর-নড়াইলে 'ভাবগান', তত্ত্বগান; অন্যদিকে কুষ্টিয়ায় 'শব্দগান', চুয়াডাঙ্গায় 'কবির লড়াই' এবং টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহে এ গান 'বাউলার লড়াই' নামে পরিচিত। এছাড়া 'দোতরা গান', 'ফকিরি গান' সহ নানা নাম রয়েছে।

নামের মতই বিচারগানের উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। দেশজ বা লোকজ নাটকের ধারায় বিচারগানের বিশেষত্ব হলো, এর প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশনার ধরণ, যা বৈশ্বিকভাবেই ভিন্ন কিছু। এ প্রতিযোগিতায় গায়েনেরা যেকোনো বিষয়ে খুব শৈল্পিকভাবে দ্বিমত পোষণ করে। বিচারগান ছাড়াও এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশনা রয়েছে কবিগান ও পশ্চিমবঙ্গের তরজা গানে। বিচারগানের উৎপত্তি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে তথ্য মেলে না। বলা হয়ে থাকে, বিচারগান কবিগানের একটি অপভ্রংশ।

ভারতীয় গবেষণায় বলা হয়, কবিগান থেকে তরজা গান এবং তরজা গান থেকে বিচারগানের উৎপত্তি। কিন্তু এ দাবির পক্ষে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই, বিচারগানের সাথে তরজা গানের সম্পর্ক নেই। দুটিই স্বতন্ত্র ধারা এবং বাংলাদেশের কবিগানের মধ্য দিয়ে বিচারগান এসেছে।

আবার বলা হয়, সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদের সংকর বা বাংলাদেশের সুফিবাদী চর্চার একটি ধারণা হিসেবে বিচারগানের আগমন। 'বাংলা একাডেমি ফোকলোর সংগ্রহমালা: বিচারগান' এ বলা হয়েছে, গৌড়ীয় কীর্তনের আঙ্গিকের সাথে বাউল গানের যোগ ঘটিয়ে বিচারগানের প্রবর্তন। বাউল ধর্মমতের শুরুতে বিচারগানের অস্তিত্ব ছিল। 

লালন সাঁইয়ের জোড়গানের প্রশ্ন-উত্তরের ধরনেও বিচারগানের ধাঁচ রয়েছে। লালনের একটি গানে ইসলামি পুরাণ অনুযায়ী মানুষ সৃজনের ইতিহাস বা আদমতত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। যেমন- 'জানতে হয় আদম ছবির আদ্যকথা/না-জেনে আজাজিল সে কিরূপ আনম গড়লেন সেথা...।' এই প্রশ্নের উত্তর মেলে লালনের আরেকটি গানে- 'আপন জুরাতে আদম গঠলেন দয়াময়/নইলে কি ফেরেশতারে সেজদা দিতে কয়...।' 

বর্তমান সময়ে বিচার গানের আসরে এমন অনেক প্রশ্ন-উত্থাপন ও উত্তর-প্রদত্ত গান স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে এবং নিত্যনতুন আসরে প্রতিভাবান গায়েন-কবির দক্ষতায় প্রশ্ন ও উত্তর প্রদানের নতুন গানও রচিত হয়।

ছবি: নওরীন সুলতানা/টিবিএস

আসর জমিয়ে বিচারগান

এই এত কথা যে গানকে ঘিরে, কেমন হয় সে গানের আসর? জানতে যাওয়া মানিকগঞ্জের সিংগাইরের আজিমপুরে বাউল শিল্পী রশীদ সরকারের বাড়িতে আয়োজিত সাধুর মেলায়। শীত শীত বিকেল, আশেপাশে মাথায় সাদা কাপড় পেঁচিয়ে ঘুরছেন অনেক গায়েন। মিষ্টি-মিঠাই-নাগরদোলার মেলায় আসরে চলছে গানের লড়াই। গান গাইতে এসেছেন আলেয়া বেগম ও জালাল সরকার। শরিয়ত-মারফতের পালা। শরিয়ত নিয়ে গাইবেন আলেয়া বেগম, আর মারফত নিয়ে জালাল সরকার। 

মঞ্চে দুই গায়েন বসে, তাদের ঘিরে আছেন বাদক ও দোহার-দোহারি। জালাল সরকার বেহালা হাতে দাঁড়িয়ে মারফতের তরফে প্রশ্ন রাখলেন, এরপর গানের সুরে বিমোহিত করে তুললেন পুরো আসর।

'একটা প্রেমের মরা ধর না তোরা আজিমপুরের দরবার...'

চারিদিকে স্রষ্টার বন্দনা আর সুরে মানুষ দুহাত তুলে সেই বন্দনায় অংশ নিচ্ছে, যেন এ গানে তাদের স্রষ্টা ও সৃষ্টির যোগাযোগ চলছে সুরে সুরে। এ যেন এক মোনাজাত। আছে ছেলে, বুড়ো, নারী, পুরুষ-সবাই। এত সুর, গান, বন্দনার ভেতরে চোখ বন্ধ করে উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন আলেয়া বেগম, শান্ত-স্থির হয়ে যেন নিজের ভেতরটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি। 

এরপর আলেয়া বেগমের পালা।  

প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়ে শেষে প্রশ্ন রেখে গেলেন রুহানির ফয়েজ (আত্মার মুক্তি) নিয়ে। তারপর নবী বন্দনায় গানের মাধ্যমে আলেয়া বেগমের পর্ব শেষ। এভাবেই দফায় দফায় চলে প্রশ্নোত্তর, এক প্রশ্নের উত্তর নিয়ে যায় আরও গভীর প্রশ্নের দিকে। এভাবে শীত শীত রাতে আধ্যাত্মবোধের উষ্ণতায় রাত পার করেন বিচারগানের গায়েন-বাদক-শ্রোতারা।

গানের শুরুতেই গায়েন জালাল সরকার তার প্রতিপক্ষ গায়েন আলেয়া বেগমকে দরবারের মা হিসেবে সম্বোধন করেন। ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেন, "যারা ভক্ত তারা আমার বাজান, আমি প্রত্যেকের মধ্যে আমার গুরু রশীদ সরকারকে দেখি।" 

গান গাইছেন আলেয়া বেগম। ছবি: নওরীন সুলতানা/টিবিএস

গানে গানে প্রতিযোগিতা চললেও তাতে নেই কোনো ব্যক্তিগত রেষারেষির ছাপ। প্রতিযোগিতার বিষয়টিতে আগে জয়-পরাজয়ের বিষয়টি নির্ধারণে বিচারক রাখা হত, যেকোনো একজনকে ঘোষণা করা হত বিজয়ী। এখন তা করা হয় না, যেন কোনো গায়েন মনঃক্ষুণ্ন না হন। এখন বিচারগানকে আরও মানবিক করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে প্রতিযোগিতায় পরস্পরকে একটু কথার জালে খোঁচানো হবে না? তাও হয়, একে বলে 'চাপানি' বা খোঁচা মারা। তবে সেটিও পরিশীলিতভাবে; হেয় করে নয়।

কথা হয় গায়েন আলেয়া বেগমের সাথে। তিনি ১৯৭৪ সাল থেকে বিচারগান করে আসছেন। ৮ বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে তার গানের জগতে হাতেখড়ি। বাবা ছিলেন হারমোনিয়াম বাদক, পরিবার থেকেই পেয়েছেন গানের পরম্পরা। সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলার একটি গান ও 'গুণিন' চলচ্চিত্রে তার গান চারিদিকে সাড়া তোলে। মাটির গান গেয়ে চলা আলেয়া বেগম জানালেন একজন শিল্পী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা।

বিচারগান সম্পর্কে আলেয়া বেগম বলেন, "আমাদের এই গানটা হলো প্রাণের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। বুঝের হোক বা অবুঝের– সবার মধ্যে একটা প্রাণ আছে, সে প্রাণের ক্ষুধা আছে। সেই প্রাণের ক্ষুধা থেকে আমরা গান করি, গান শুনি। আমার উপার্জনও এই গান থেকে, তাতে আত্মার শান্তি আছে। ইবাদত হোক বা ধর্ম, ধর্মের মূলে রয়েছে সৃষ্টির সেবা। আর এই গানের মাধ্যমে আমরা সেই সৃষ্টির সেবার কথাই বলে থাকি। মানবতার বন্দনাই আমাদের বিচারগানের দর্শন।"

একজন নারী শিল্পী হিসেবে যাত্রায় থাকে নানান প্রতিবন্ধকতা, সে সম্পর্কে আলেয়া বেগম জানান, অনেকেই বিচারগানকে হাট-বাজারের গান হিসেবে দেখেন, কাজেই এরকম গানে পরিবার চায় না মেয়েরা আসুক। এলেও তারা অনেকেই এই পেশাকে এগিয়ে নিতে পারেন না। তবে পুরুষের তুলনায় কম হলেও অনেক নারী শিল্পীই রয়েছে। আলেয়া বেগমের কাছে শিষ্যত্ব নেন অনেকেই, তার দোহারি হিসেবে রয়েছেন দুজন নারী।

তিনি বলেন, "তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থেকে তারা এমন কথাবার্তা বলেন। আমরা যারা বিচারগান করি, নিজেদের ফকির মনে করে আত্মবিশ্লেষণ করি। যারা আত্মবিশ্লেষণ করে– তারা কাউকে বৈরী, প্রতিপক্ষ না ভেবে সবকিছু, সবাইকে মেনে নিতে পারে। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ আমাদের ভাষা নয়।"

ছবি: নওরীন সুলতানা/টিবিএস

গুরু-শিষ্য পরম্পরা

বিচারগানকে গুরুবাদী গান বলা হয়। বিচারগানের দর্শনে বলা হয়, তারা বেহেশত-দোযখ চায় না। বরং এর স্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে তারা উৎসাহী, এ সান্নিধ্য পেতে পরিশুদ্ধ মানুষ হয়ে ওঠার মাধ্যম হিসেবে গুরুকে মানা হয়। দেওয়ান, সরকার নানান পদবিতে এই গুরু-শিষ্য পরম্পরা বাহিত হয়। দোহাররাও শিল্পীদের কাছে গানের শিষ্যত্ব, দীক্ষা গ্রহণ করে পরবর্তীতে নিজেরাও শিল্পী হয়ে ওঠেন। আলেয়া বেগমের দোহারি মাহি আলম জানান, "তিন বছর ধরে আমি দোহার হিসেবে আছি। আমি গান শিখছি আম্মার (আলেয়া বেগম) কাছে ভবিষ্যতে নিজেও শিল্পী হয়ে উঠতে।"

এই গুরু-শিষ্য পরম্পরার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও, কোথাও না কোথাও তা ব্যক্তিবন্দনা বা মাজার-সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করছে বলে দেখা যায়। আব্দুর রশিদ সরকারের মাজারের সামনে দেখতে পাওয়া যায় টাকার স্তুপ। 

মানিকগঞ্জ ও বিচারগান

মানিকগঞ্জ জেলা যমুনা-পদ্মা বাহিত, বুক চেরা নদী ধলেশ্বরী, ইছামতি ও কালীগঙ্গার পলিবিধৌত অঞ্চল। সুর ও ছন্দ এ অঞ্চলের মানুষের সহজাত প্রকৃতি। মাঝির গান, বয়াতির গান, বিচার গান, কীর্তন, জারি, সারির এক অমূল্য খনি মানিকগঞ্জ। নদী-নালা দিয়ে জেলার ভূমিগুলো বিছিন্ন থাকায় প্রত্যেকটি এলাকায় রয়েছে এক একটি স্বতন্ত্র বিনোদনের সুরধারা। এ থেকেই এতো বিচিত্র সুরধ্বনি।

বলা হয়, একসময় এ অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে ভাববৈঠকি গান হত, সে গানে একে অপরকে গানে গানে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলে চোখ ভিজিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতেন। এভাবেই কেটে যেত সারারাত। সেখান থেকেও বিচারগানের শুরু হয়ে থাকতে পারে।

মানিকগঞ্জের ভাষা, আবহাওয়া, মানুষ সবকিছুই বিচারগানকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বিচারগানে মানিকগঞ্জের ভাষা, বাচনভঙ্গি, আঞ্চলিক শব্দচয়ন ভূমিকা রাখে। আবার এ অঞ্চলের আবহাওয়া এ অঞ্চলের বিচারগানকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। নদীর হাওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের মরমে রয়েছে উদাসী সুর। অন্যান্য ভাটি অঞ্চলে গান হয় বর্ষার অলসতায়। এখানে বর্ষায় নদী ভাঙনের দুঃখ জমে। সে দুঃখ একটু একটু করে সারিয়ে তুলতে আশ্বিন থেকে ফাল্গুনের সময়ের আলতো থেকে তীব্র শীতের রাতগুলোতে এ অঞ্চলের মানুষ গানকে আপন করে নেয়।

গানে বিমোহিত শ্রোতা। ছবি: নওরীন সুলতানা/টিবিএস

গানকে যেমন বাঁচিয়ে রাখেন একজন সাধনা করা গায়ক, তেমনি গানকে সাধনা হিসেবে হৃদয়ে ধারণকারী শ্রোতা। তেমন আকুল হয়ে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে ভালোবেসে এ গান শোনা এক শ্রোতা মো. হিম্মত আলী। তিনি বলেন, "মনের আশেক-মাশুকের খোরাক মেটায় এই গান। স্রষ্টার প্রেমে আপ্লুত হতে আমি এই গান শুনতে আসি। এই গান শুনে যে অনেকে নিজেদের হুশ হারায়, কারণ তারা তখন বুকের ভেতরে নিজের স্রষ্টার আওয়াজ শুনতে পায়।"

ভাষার মিশেল, ভাষার জাদু

'সর্ব অঙ্গ 'আলেফে'র চিন।
দুই বাজুতে 'ছন', 'সিন'
মুখেতে 'বে'র গঠনা
মানবদেহের ভেদ জাইনে করো সাধনা।'

বিচারগান যেমন নানান গানের মিশেল, তেমনি নানান ভাষার বুলি এই গানে মিশ্রিত হয়েছে। আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি আরবি, উর্দু, ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত, আদিবাসী ইত্যাদি ভাষার শব্দ, এমনকি বাক্যও এখানে অবলীলায় পরস্পরের সাথে মিশে আছে। বিচারগানে ইসলামিক নানান বিষয় আলোচিত হয় বলে রয়েছে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ ও বাক্যের আধিক্য। তেমনভাবে রয়েছে মানিকগঞ্জ অঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক শব্দের ব্যবহার। দেহতত্ত্বে  আরবি হরফের সাথে দেহের তুলনার পাশাপাশি রয়েছে দেহকে ঘর, জমির উপমা দেওয়া, জীবন যেখানে হয়ে ওঠে নীল দরিয়ায় বৈঠা বাওয়া। বিভিন্ন ভাষার মিশেল যেমন বাংলা ভাষার সৌন্দর্য, তেমনি তা যেন বিচারগানের সৌন্দর্য।

ছবি: নওরীন সুলতানা/টিবিএস

বিচারগানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

নদীর স্রোতের মত কালের স্রোতে বাংলা সংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গ কখনো সংস্কারে হারিয়েছে, কখনো বিকৃত হয়েছে, কখনো তা এক প্রকার বিলুপ্তই হয়েছে। তেমনই কী হারিয়ে যাবে বিচারগান? 

আশার কথা হলো, বিচারগানের জনপ্রিয়তা দিনে দিনে আরও বাড়ছে। এ গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন দর্শক-শ্রোতা, বিভিন্ন গায়েনদের কাছে শিখতে আসছে নবীন-তরুণ শিষ্যরা। সুরেও এসেছে আধুনিকতার স্পর্শ। মরমী দুঃখ নতুন সুরে নতুন প্রাণ পাচ্ছে, জীবন্ত হয়ে উঠছে নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্রে। অক্টাপ্যাড, ইউকুলেলের মত আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ধারণ করছে বিচারগানের সুর, নতুন ও যুগোপযোগী হয়ে উঠছে গান– যা নতুন দর্শকদের আগ্রহী করে। তবে এখনো এই গান অনেকটাই গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক ও সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে পারেনি।

বিচারগানে আধুনিক গানকেও গাওয়া হয়, আবার আধুনিক গানের সুরকেও ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া গান 'সাদা সাদা কালা কালা' কে যেমন বিচারগানের আসরে গাওয়া হয়েছে, তেমনি 'নয়নও সরসী'-র মত গানের সুরেও বাদকেরা আসর মাতিয়েছেন। 

ছবি: নওরীন সুলতানা/টিবিএস

জানা যায়, গানে সামাজিক বিষয় বা অন্যান্য বিষয়গুলোর তুলনায় ইসলাম ও ধর্মীয় বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে এখন। তবে বিচারগান ধর্মীয় বিষয়ের ওপর হলেও সর্বদা অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদের বাণীকে ধারণ করেছে। 

বিচারগানের আধুনিকায়ন এর উদ্যোগ সেভাবে নেই, ফলে এখনো এই গান অঞ্চলভিত্তিকই রয়েছে। অন্যান্য লোকসংগীতের মত বিচারগান সংরক্ষণ ও প্রচারে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ থাকলেও তা যথেষ্ঠ নয় বলেই জানা যায়। এর গবেষণা, সংরক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতার উদ্যোগ তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। এ ব্যাপারে লোকসংস্কৃতির গবেষক ও লেখক মো. মোশাররফ হোসেন জানান, "সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এখন জাতীয় পর্যায়ে বাউল সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিতে প্রত্যেক জেলার শিল্পকলা একাডেমিতে বাউলগান পরিবেশন করা হয়, যা প্রশংসনীয়। তবে অবশ্যই এরকম আরও উদ্যোগ প্রয়োজন।"

তবে কী হতে চলেছে বিচারগানের ভবিষ্যৎ? এ সম্পর্কে বিচারগান নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণারত শেখ জাহিদ আজীম জানালেন, "আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে চর্চিত ও পরিবেশিত লোকনাটকের ভেতরে বিচারগান অন্যতম শীর্ষে। বিচারগান ক্রমশ সমৃদ্ধ হচ্ছে। লোকসংস্কৃতি বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বীকার হলেও বিচারগানে অন্যান্য সব ধরনের গানের আত্মীকরণ ও সমন্বয় হয়। সময়ই অনেক কিছু বলে দেয়, তবে বিচারগানের এ দিকটি বিবেচনায় বলা যেতেই পারে যে বিচারগান সংস্কৃতিতে থেকে যাবে এবং মানবতার বাণী ছড়িয়ে যাবে।"

'মনো রে, আগো ছাড় জাতিবিদ্যা
ঘৃণা লজ্জা হিংসা নিন্দা
এসব থাকলে সাধন হবে না।'

সন্ধ্যার আসরে বিচারগানের শ্রোতারা। ছবি: নওরীন সুলতানা/টিবিএস

এভাবেই কথায়, সুরে বিচারগান ও বাংলাদেশের লোক-সংস্কৃতি ধারণ করেছে মানবধর্ম ও অসাম্প্রদায়িকতার নির্যাস।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.