ইন্দো-বাংলা সীমান্তে চিনিই এখন নতুন গরু!

ফিচার

15 March, 2024, 02:00 pm
Last modified: 15 March, 2024, 01:59 pm
চিনি চোরাচালান এ এলাকায় এতটাই স্বাভাবিক যে, উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের অন্য একটি বাজারে যখন আমরা এ নিয়ে প্রশ্ন করি, তখন স্থানীয় দোকানদার মোজাম্মেল ভেবেছিলেন আমরা চোরাচালান করা চিনি কিনতে আগ্রহী কি না।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নেত্রকোনা, কুমিল্লা ও সিলেটসহ সীমান্তবর্তী অনেক জেলা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চোরাচালান করা চিনি জব্দ করেছে। ব্যবসায়ীরা এ চোরাকারবারে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় সিলেট সীমান্তে।

এক কেজি চিনি আপনি কত টাকা দিয়ে কেনেন? ১৭০ টাকা? ১৪৫ টাকা? যদি কেউ বলেন যে, তিনি প্রায় অর্ধেক দামে চিনি কিনছেন; এটা শুনে কি আপনি অবাক হবেন না? প্রতি কেজি চিনি ৮০ টাকা থেকে ৮৫ টাকা দরে?

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের রনিখাই ইউনিয়নের চোরার বাজারে আমরা এমনই পেয়েছি।

গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম রেকর্ড পরিমাণ কমলেও, দেশে চিনির দাম চড়া। এ অবস্থায় সীমান্তবর্তী জেলার অবৈধ ব্যবসায়ীরা কম দামে চিনি বিক্রি করছেন।

ভারতে চিনি বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৪৬ রুপিতে (৫৩ থেকে ৬০ টাকা)। একটি ৫০ কেজির চিনির বস্তার দাম প্রায় তিন হাজার টাকা বা তার কম। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে এক বস্তা চিনি বিক্রি হয় চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়।

যদিও এ দাম দূরত্বের সমানুপাতিক হারে বাড়ে। কোম্পানীগঞ্জে চিনির দাম দাম পাঁচ হাজার টাকা এবং অন্যদিকে সিলেট শহরে তা বিক্রি হচ্ছে ছয় হাজার টাকায়।

এ ব্যবসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসকারী গ্রামবাসীদের বিপুলসংখ্যক এর সঙ্গে জড়িত।

২০১৬ সালে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ৫টি কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে। অতঃপর হাইকোর্ট সিলেটের সব কোয়ারিতে পাথর ক্রাশার ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে এলাকার পাথর কোয়ারিগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই ব্যবসা হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন।

অন্য জায়গায় পাথরের কাজে যুক্ত থাকা শ্রমিকরা বহু বছর আগে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু গ্রামবাসীদের যাওয়ার অন্য কোনো জায়গা ছিল না। এমনকি তাদের করার মতো কোনো কাজও ছিল না।

এমনকি এসব জায়গার মাটিও কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ এ মাটির পাতলা স্তরের ঠিক নীচেই থাকে পাথর।

ভারতে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকাকালীন দেশে চিনির দাম বাড়তে থাকে। তাই এসব গ্রামবাসীদের জন্য এটি একটি বিশাল এবং অস্থায়ী সুযোগ হিসেবে কাজ করে।

স্থানীয় চিনি 'ব্যবসায়ীদের' মতে, যারা বস্তা বয়ে নিয়ে সীমান্ত পার হন, তাদের প্রতি বস্তার জন্য ৩০০ টাকা করে দেওয়া হয়। বাইক চালকেরা চার বস্তা চিনি বহন করেন এবং প্রতি বস্তার জন্য ২০০ টাকা পান । বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এবং বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স)-এর গতিবিধির ওপর নজর রাখা 'লাইনম্যান'কে দেওয়া হয় ৫০ টাকা। দূরত্বের সঙ্গে বাড়ে বহনের খরচও।

এক চিনি ব্যবসায়ী জানান, ভারতীয় অংশে রাতে এবং বাংলাদেশের অংশে দিনে চিনি বহনের এ কাজ চলে।

কয়েক দশক ধরে মাদক ও অন্যান্য পণ্য ছাড়াও গবাদিপশু ছিল সীমান্তে চোরাচালানের প্রধান বস্তু।

কোম্পানিগঞ্জে সীমান্তবর্তী এলাকায় মোটরবাইকে চিনি পরিবহন করছেন দুজন। ছবি: টিবিএস

ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক মালিনী সুর তার বই 'জঙ্গল পাসপোর্টস: ফেন্সেস, মবিলিটি এবং সিটিজেনশিপ অ্যাট দ্য নর্থইস্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ বর্ডার'-এ বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন কীভাবে সীমান্তের উভয়দিকে গবাদিপশু পাচার একটি আনুষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।

২০১৭ সালে ভারতে গবাদিপশুর মুসলিম বিক্রেতাদের গণপিটুনি এবং হিংসাত্মক জনতার আক্রমণের ঘটনা ঘটলে এ ধরনের পাচার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে, ভারতীয় গবাদিপশু কেবল মনোনীত পশু করিডোর দিয়েই দেশে প্রবেশ করতে পারবে।

কিন্তু চিনির ক্ষেত্রে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় নেই। ফলে এটি পাচার আরও বিপজ্জনক। তবু কেন মানুষ এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত?

চোরার বাজারের স্থানীয় রেস্টুরেন্টের মালিক স্বদেশ এর বিপরীতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, 'তারা আর কী করবে?'

স্বদেশ গ্যাসের চুলায় একটি বড় লোহার প্যানে জিলাপি ভাজতে ভাজতে বলেন, 'এ এলাকার প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবারের সদস্য এ কাজের সঙ্গে জড়িত । এটি একটি অস্থায়ী কাজ, স্থায়ী নয়।'

রেস্তোরাঁয় গ্রাহক ছিল বিধায় আমরা অনুচ্চ গলায় প্রশ্ন করি। কিন্তু মনে হচ্ছিল স্বদেশ অত পাত্তা দিচ্ছেন না। এর কারণ একটু পরেই টের পেলাম।

চিনি চোরাচালান এ এলাকায় এতটাই স্বাভাবিক যে, উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের অন্য একটি বাজারে যখন আমরা এ নিয়ে প্রশ্ন করি, তখন স্থানীয় দোকানদার মোজাম্মেল ভেবেছিলেন আমরা চোরাচালান করা চিনি কিনতে আগ্রহী কি না।

জানা গেল তিনিও এ ব্যবসায়ীদের একজন ছিলেন। সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কী পরিমাণ চিনি আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা চাহিদার ওপর নির্ভর করে। 'আমরা চাইলে চিনি ম্যানেজ করতে পারি,' বলেন তিনি।

এলাকাটিতে ঘোরার সময় আমরা দিনের বেলা চিনি বহনকারী এক-দুটি মোটরবাইক দেখতে পাই। সন্ধ্যার পর সীমান্তের কাছে একটি মোড়ে কিছু বিজিবি সদস্যকে পাহারা দিতে দেখা যায়।

আবির নামের একজন কিশোর থ্রি-হুইলার চালক জানায়, চোরাকারবারিদের ধরার জন্য বিজিবির লোকজন সেখানে অবস্থান করছিল। মাটির রাস্তাগুলো এতই সরু যে, আমাদের গাড়ি বাজারে রেখে থ্রি-হুইলার সার্ভিস নিতে হয়েছিল। বিজিবি সদস্যরাও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পায়ে হাঁটছিলেন।

উত্তমা ছড়ার কাছে নো ম্যানস ল্যান্ডে ভারত-বাংলা সীমান্ত অতিক্রম করে বিশাল পাথরের একটি সুন্দর খাড়িতে আমরা একদল স্থানীয় লোককে সীমান্তের দিকে আসতে দেখি।

আমাদের সঙ্গে খাড়িতে যাওয়া আরিফ নামক একজন স্থানীয় যুবক বলেন, তারা মেঘালয়ের একটি বাজার থেকে চিনি আনতে যাচ্ছিলেন। আরিফ জানান, তার গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

আবির ও আরিফ দুজনেই জানান, তাদের পরিবার পাথরের ব্যবসা করে এবং বেশ কিছু কোয়ারির মালিক। তারা বলেন, এলাকায় পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে সচ্ছল পরিবারগুলোর নিয়তি বদলে গিয়েছে।

বাইকে করে চিনি পরিবহন। ছবি: টিবিএস

টাকার অভাবে আরিফ স্কুল ছেড়ে থ্রি-হুইলার চালানো শুরু করেন। আবিরের ভাই পরিবার চালাতে বিদেশে চলে যাওয়ায় তার পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

আবির বলেন, 'আমাদের উপার্জন করা টাকা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পাথর উত্তোলনের জায়গা নিয়ে আমার মামার সঙ্গে ঝগড়ার কারণে আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। আমরা প্রচুর টাকা খরচ করেছি। অবশেষে তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।'

পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি পাথর কোয়ারিগুলো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বও কুখ্যাত। এছাড়া অনিরাপদভাবে কার্যক্রম পরিচালনার কারণে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক হতাহতও হতেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সিলেটে পাথর উত্তোলনে ৭৬ জন পাথর শ্রমিক নিহত এবং ২১ জন আহত হয়েছেন।

এখন পুরো এলাকায় সর্বত্র পাথর খনির বড় বড় গর্ত রয়েছে। গর্তগুলো ভবিষ্যতে যেকোনো স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে জমিগুলোকে অনুপযুক্ত করে তুলেছে।

পাথর কোয়ারি ইজারাদারেরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে সিলেটের মতো শহরে চলে গেছেন। অন্যরা আশপাশের কৃষিজমি কিনে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন। আবিরের পরিবার এদের মধ্যে একজন।

অনেকেই অর্থ পুনঃবিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে পকেট শূন্য করে ফেলেছেন। এখন জীবিকার উপায় না পেয়ে তারা চোরাচালানসহ অন্যান্য কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।

আবির বলেন, 'আমাদের এক প্রতিবেশী আছেন যার কোটি কোটি টাকা ছিল। তিনি এখন চিনি পাচার করেন। এখনো চিনিই আনতে গেছেন। তার বিরুদ্ধে ২০টি হত্যা মামলা রয়েছে।'

এলাকায় ব্যাপক বেকারত্বের কথা বলতে গিয়ে স্থানীয় এনজিও কর্মী নুরুন্নবী সোহাগ এর পর্যটন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন।

ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর সিলেটের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এর নিকটবর্তী উত্তমা ছড়া দুঃসাহসিক ভ্রমণকারীদের আবেদন সত্ত্বেও যথাযথ সড়ক যোগাযোগের অভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারেনি।

সোহাগ বলেন, 'ভালো রাস্তা হলে এ এলাকায় পর্যটকরা আসতে পারবেন। মেঘালয়ের সুন্দর হিমালয়ের পাদদেশ এবং উত্তমা ছড়ার পাথরের মধ্য দিয়ে চকচকে পানির প্রবাহ বিছনাকান্দির চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়। পর্যটকেরা এলে স্থানীয় গ্রামবাসীদের আয়ের সুযোগও তৈরি হবে।'

স্থানীয় চিনি ব্যবসায়ীরা জানান, জেলার গোয়াইনঘাট ও জৈন্তিয়াপুর উপজেলার সীমান্ত দিয়েও চিনি আসে।

শুধু সিলেটেই নয়, সারাদেশে চিনি চোরাচালান এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নেত্রকোনা, কুমিল্লা, সিলেটসহ সীমান্তবর্তী অনেক জেলা থেকে চোরাচালান করা চিনি জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সিলেট সীমান্তে চোরাকারবারিরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় বলে মনে হচ্ছে।

টিবিএসের চট্টগ্রাম ব্যুরো বলছে, কাছাকাছি ভারতীয় বাজারের সঙ্গে অবৈধ ব্যবসার কারণে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে প্রতি কেজি চিনি ৮০ টাকায় বিক্রি হয়।

টিবিএস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী গত আগস্টে চোরাচালান করা ভারতীয় চিনি চট্টগ্রামের স্থানীয় বাজারের দাম কমিয়ে দিয়েছে। একই সময়ে স্থানীয় পরিশোধনকারীরা ভারত থেকে চিনি চোরাচালান বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে অবিলম্বে পদক্ষেপ চেয়েছে।

অবশ্য বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য স্থানীয় সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়।

এ প্রতিবেদনটি লেখার সময় টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ এবং ৬ মার্চ মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্তে দক্ষিণ গারো পাহাড়ি জেলায় যৌথ অভিযানে বিএসএফ এবং মেঘালয় রাজ্য পুলিশ ৩৩ হাজার কেজিরও বেশি চিনি বাজেয়াপ্ত করেছিল।


আমাদের সঙ্গে যারা কথা বলেছেন, তাদের পরিচয়ের গোপনীয়তা রক্ষার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.