সড়কের পাশে লাগিয়েছেন ২ হাজারেরও বেশি গাছ, এখন গাছ লাগানোই তার নেশা

ফিচার

11 March, 2024, 03:15 pm
Last modified: 11 March, 2024, 03:50 pm
‘জমিটা খালি পড়ে আছে, গাছ লাগালে সেটা তো খারাপ কিছু করবে না, বরং পরিবেশও ঠিক থাকবে।’

বৃক্ষের কাছে মানুষের ঋণ আজীবনের। বিভিন্ন সময়ে জ্ঞানী-গুণীরা সে অবদানের গানই গেয়েছেন বারবার। 'বৃক্ষ বন্দনা' কবিতায় নানান বিশেষণে গাছের মহত্ব তুলে ধরেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়া বড় বড় শিল্পীরা তাদের কথায়, লেখায়, শিল্পকর্মে বৃক্ষের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে গেছেন নানাভাবে। তবে কজনই বা এই গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে সে বিষয়ে বলা মুশকিল। নিজেকে নিয়ে ভেবেই যেন কুল পায় না মনুষ্যসমাজ। সেখানে বৃক্ষ নিয়ে ভাবার সময়ই বা কই?

তবে কেউ কেউ এমনও আছেন যারা সবকিছু উপেক্ষা করে প্রকৃত অর্থেই আপন করেছেন বৃক্ষকে। অনুধাবন করেছেন এটির মর্ম। এমনই এক ব্যক্তির দেখা মেলে চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। বৃক্ষপ্রেমী এই ব্যক্তিকে বেশিরভাগ সময়ে সড়কের পাশে গাছ লাগানোর কাজে দেখা যায়।

পটিয়া থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার মাঝে আছে ৭–৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পটিয়া বাইপাস সড়ক। বড় এই রাস্তার দুই পাশে কোনো গাছপালা নেই। খালি পড়ে থাকা এসব জায়গায় প্রতিদিন মোটরসাইকেল থামিয়ে, ব্যাগভর্তি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গাছ লাগানোর কাজে নেমে পড়েন তিনি। শার্ট-প্যান্ট পরিহিত এই ভদ্রলোক প্রায়ই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গাছের চারা, বীজ, কোদাল, শাবল, বেলচা, পানি, ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন তিনি। কাজ শেষে যাত্রা করেন কর্মস্থলের পথে। আবার বাড়ি ফেরার পথে একবার করে দেখে নেন সদ্য লাগানো গাছের পারিপার্শ্বিক অবস্থা। গত পাঁচবছর ধরে এটিই প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার।

পেছনের কারিগর

এই অসামান্য কাজের পেছনে যিনি, তার নাম মো. আবু তাহের। ৪৫ বছর বয়সি এ ব্যক্তির বসবাস চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার হারলা গ্রামে। কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম বন্দরের উচ্চবহি: সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে। এর আগে ১৪ বছর গণিত ও বিজ্ঞান পড়িয়েছেন বোয়ালখালী উপজেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে।

মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা তাহেরের গাছের প্রতি ভালোলাগা ছোটবেলা থেকেই। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা-মায়ের সাথে গাছের পরিচর্যায় অংশ নিতেন তিনিও। তাদের মাধ্যমেই এই কাজে হাতেখড়ি হয় তার। তাই নিজের বাড়ির আঙিনার পাশাপাশি পড়ে থাকা খালি জমি দেখলেই গাছ রোপণ করে ব্যয় করতেন নিজের অবসর সময়। আস্তে আস্তে সেই কাজ তার ভালোলাগায় রূপ নেয়। সবার মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে তোলানোর প্রবণতাও তৈরি হতে থাকে তার।

স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলে সেখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ বিষয়ে নানাভাবে উৎসাহ যোগাতে থাকেন। গাছপালার উপকারিতা সম্পর্কে জানানোর পাশাপাশি তাদের মধ্যে গাছ রোপণ করার বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করতে শুরু করেন। এই শিক্ষার্থীরা আবু তাহেরের উৎসাহে স্কুলের আশেপাশে পড়ে থাকা খালি জায়গা, নিজ বাড়ির আঙিনায় চারাগাছ লাগাতে শুরু করে। অনেক শিক্ষার্থী এখনো সে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মনোযোগের সাথে। শিক্ষকতার পেশার সাথে তাহের সংযুক্ততা নেই ১০ বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু এখনো শিক্ষার্থীরা নিজেদের লাগানো গাছের ছবি পাঠিয়ে চমকে দেন তাকে। এতে তাহেরের খুশি দ্বিগুণ হয়।

শুরুতে কেবল নিজের বাগানে গাছ রোপণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তার এই কাজের গন্ডি। বাড়ির চারপাশ, বারান্দা, বাগান ইত্যাদি ভর্তি করে রাখতেন গাছপালায়। আস্তেধীরে  কাজের পরিধি বাড়াতে থাকেন। এখন শুধু নিজের সীমানায় নয়,  যত খালি জায়গা পড়ে থাকতে দেখেন সেখানেই করেন গাছ রোপণ করার কাজ। মাঠ-ঘাট, খোলা জায়গা যেখানেই সম্ভব এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন একাগ্রতার সাথে। বছর পাঁচেক আগে নিজের এলাকার সাথে সংযুক্ত বড় দুই সড়কের পাশে পড়ে থাকা খালি জায়গায় গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেন তিনি।

শুরুটা যেভাবে

২০১৩ সালে আবু তাহের শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে যোগ দেন বন্দরের উচ্চবহিঃ সহকারি পদে। নতুন কর্মস্থলে যেতে অতিক্রম করতে হতো পটিয়া বাইপাস সড়ক। দুইপাশে গাছপালায় ভরপুর এই রাস্তা ছিল শীতল ও ছায়াযুক্ত। একদিন আবু তাহের খেয়াল করেন সাত-আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রাস্তার দুপাশ যেসব গাছপালায় ভরপুর ছিলো তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। রাস্তার পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে এসব গাছ কেটে ফেলা হয়।

রাস্তার ধারে নিজের লাগানো গাছের সঙ্গে আবু তাহের

একই চিত্র তিনি দেখতে পান নিজ এলাকার আনোয়ারা-পটিয়া ওয়াই জংশন সড়কেও। ফলে সড়কের দুপাশ পুরো মরুভূমিতে রূপ নেয়। গাছের ছায়ার শীতল সড়ক হয়ে যায় উত্তপ্ত উনুনের ন্যায়। প্রধান এই সড়কগুলোর সাথে  সংযুক্ত আছে অনেক ছোট ছোট রাস্তা। এগুলোর মোড়ে গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত পথিক ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতেন কাঙ্ক্ষিত গাড়ির অপেক্ষায়। তীব্র রোদেও ছায়া পাওয়া যেত সেখানে। কিন্তু সব গাছ কেটে ফেলার পর মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। এমনকি পুনরায় সেসব খালি জায়গায় গাছ লাগানোর চেষ্টাও আর করেনি কেউ।

এতগুলো গাছ নির্মূল করার বিষয়টি খুব আহত করে আবু তাহেরকে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সড়কের দুপাশের পরিবেশ আগের রূপে ফিরিয়ে আনবেন। এই লক্ষ্যে আনোয়ারা-পটিয়া ওয়াই জংশন এবং পটিয়া-চট্টগ্রাম সড়ক — এই দুটো বাইপাস সড়কে প্রতিদিন কয়েকটা করে গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নেন।

২০১৯ সাল থেকে পুরোদমে কাজে নেমে পড়েন আবু তাহের। অফিসে যাওয়ার পথে ব্যাগভর্তি বীজ, গাছ, পানি, সার এবং গাছ লাগানোর যাবতীয় সরঞ্জাম সাথে রাখতেন। তারপর রাস্তার দুপাশের খালি জায়গায় বীজ বপন করে আবার অফিসের পথে যাত্রা করতেন। এই কাজ তিনি শুরু করেন হারিয়ে যাওয়া এই শীতল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে। তাহেরের ভাষ্যমতে, 'একদিন এসব গাছপালা বড় হয়ে আবার শীতল করে তুলবে রাস্তার দুপাশ।'

সেই থেকেই শুরু। এরপর থেকে রাস্তার দুই পাশের পড়ে থাকা খালি জমি দেখলেই গাছ রোপণ করতে থাকেন আবু তাহের। তিনি বলেন, 'এই কাজ কাইন্ড অফ প্যাশনে পরিণত হয়েছে আমার। এখন মনে হয় যেখানেই জায়গা পাই সেখানেই এই কাজ করতে থাকি।'

এই কাজের জন্য যে পরিমাণ বীজের দরকার পড়তো, তার যোগান দিতেন নিজস্ব সংগ্রহ থেকে। তার সংগ্রহ করা বীজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আম, জাম, কাঁঠাল, গাব, তাল, লিচু, কাঠ বাদাম, ডেউয়াসহ অন্যান্য। বাজারে গেলে প্রায় ফলমূল কিনে থাকেন তিনি। এসব ক্রয় করার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো বীজ সংগ্রহ করা।

গাছ রোপণের উদ্দেশ্যে এভাবেই বীজ সংগ্রহ করে রাখেন আবু তাহের

ভালো বীজ বাছাই, গাছের সঠিক পরিচর্যা, গাছ লাগানোর পদ্ধতি, সার প্রয়োগের নিয়ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে পড়াশোনাও করেন তিনি। গাছের নানা বিষয়ে জানার চেষ্টা করেন। অনেক সময় অন্যদেরও এই বিষয়ে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন।

'ক্ষেত-খামারের যারা কাজ করেন, তারাও দেখভাল করেন'

চারপাশের নানা মানুষ তাকে এই কাজের জন্য যেমন প্রশংসায় ভাসিয়েছেন তেমনি অনেকেই তাকে দেখে উদ্যোগও নিয়েছেন। এই বিষয়টি আরও প্রবলভাবে উৎসাহ দেয় তাকে। এমনই এক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তাহের বলেন:

"শেষ বিকেলের কথা। সড়কের পাশে খালি জমিতে গাছ রোপণ করছিলাম। তার অল্প দুরত্বেই আমার মোটরবাইক এবং সেখানে রাখা যাবতীয় সরঞ্জাম। ঠিক সে সময়ে আমি যে জমিতে গাছ রোপণ করছিলাম তার মালিক এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে ডাক দিলেন। হঠাৎ এভাবে ডাকতে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ভয়ও কাজ করছিল। জিজ্ঞেস করলেন, 'কী করো আমার জমিতে?'"

আমি উত্তর দিলাম।

তারপর তিনি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন, 'আমার জমিতে কেন? অন্য কোথাও জায়গা নেই?'

বললাম, 'জমিটা খালি পড়ে আছে, গাছ লাগালে সেটা তো খারাপ কিছু করবে না, বরং পরিবেশও ঠিক থাকবে।'

সবকিছু শুনলেন। শোনার পরে হাসলেনও। গাড়ি থেকে নেমে অনেক কথা হলো দুজনের। অনেক সম্মান দেখালেন এবং প্রশংসা করলেন। যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরে দোয়াও করে দিলেন। সেদিন খুবই খুশি হয়েছিলাম, সাথে সাহসও পেয়েছিলাম অনেক।'

অফিস যাওয়ার পথে এভাবে গাছ লাগান আবু তাহের

তবে প্রথম দিকে অবস্থা এমন ছিল না। 'পাছে লোকে কিছু বলে'র ভয় ভর করে বসেছিলো তার ঘাড়ে। তাই অধিকাংশ  সময় লজ্জা কাজ করতো। অনেকেই তার কাজকর্ম নিয়ে পেছনে হাসে বলে শঙ্কিত থাকতেন। তাই আড়ালে আবডালে, নির্জনে গাছ রোপণ করতে থাকলেন। কিন্তু একটা সময় এই কাজে এতই ভালোলাগা জন্মেছিলো যে, কে কী বলবে সে চিন্তা কমতে থাকলো ধীরে ধীরে।

লোকে কী বলবে এই ভয় ঢুকেছিলো মানুষের বিরূপ মন্তব্য থেকেই। অনেকেই তার কাজ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছেন, নানাভাবে কুৎসা রটিয়েছেন, প্রতিবন্ধকতা এসেছে। কেউ বলেছে কাজ না করে অকাজ করে বেড়াচ্ছেন, কেউ বলেছে লোক দেখানো ছাড়া কিছুই নয়, কেউ বলেছে মাথা নষ্ট মানুষ। এমনকি কাছের মানুষরাও বিদ্রুপ করে বলেছেন নানান কথা। এমন এক ঘটনা শুনতে পেলাম তার মুখে।

শুরুর দিককার কথা। রাস্তার আশেপাশে গাছ লাগাতে দেখে তার এক বন্ধু বলে বসলো গাছ লাগিয়ে তাহের ক্ষতি করছে মানুষের। এতে উপকারের চেয়ে অপকারই বরং বেশি হবে। বিষয়টি শুনে একটূ ঘাবড়ে যান তাহের। তিনি জিজ্ঞেস করে বসেন কী এমন ক্ষতি হতে পারে গাছে!  

বন্ধু বলেন, এ গাছ যদি বড় হয়ে ঝড়ে উপড়ে যায়, গিয়ে কোনো মানুষ বা গাড়ির ওপর পড়ে, তাতে মানুষ মারা যাবে। রাস্তাঘাট বন্ধ হবে। বিষয়টি তাহেরকে বেশ ভাবাতে থাকে। চিন্তা করতে থাকেন, তবে কীভাবে কী করা যায়। পরে ভাবলেন, যদি এমন ঘটনা ঘটেও থাকে তা সুনিশ্চিত নয়। কিন্তু এই গাছ ফল, ফুল, ছায়া, অক্সিজেন দিয়ে যে উপকার করবে তা নিশ্চিত। এবং উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অতি নগন্য।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাছ রোপণ, বীজ বপনের ভিডিও আপলোড করতেন অন্যদের উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে। এখানেও বাধে বিপত্তি। নানাজন নেতিবাচক মন্তব্য নিয়ে হাজির। অনেকেই বলে বসলেন, কয়েকটি লাইক আর ভিউ বাড়ানোর ধান্ধা সব! এমন অপবাদ শঙ্কিত করে তাহেরকেও। বন্ধ করেন ভিডিও/ছবি আপলোডের কাজ। দীর্ঘদিন দূরে থেকেছেন। পরে কাছের এক বন্ধুর পরামর্শে আবার গাছ নিয়ে আবার সরব হন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সবকিছুকে ছাপিয়ে আবু তাহের নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছেন সর্বদা। কোনোকিছুতেই পিছু হটেননি।

এমন উদ্যমের কারণে শিক্ষক হিসেবে যেমন তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাছপালা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছেন তেমনি উৎসাহী মানুষদের নানাভাবে এই কাজে সাহসও জুগিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, 'যদি একজনও আমার কাজ দেখে গাছ লাগানোর ব্যাপারে সর্তক হয়, তাহলে এখানেই আমার কাজের সার্থকতা নিহিত।'

দু'হাজারেরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন তিনি

ভালোবেসে এই কাজ করেন বলেই যত্নের ক্ষেত্রেও কোনো কমতি রাখেন না তিনি। শুধু বীজ বপনই নয়, নিজের শক্তি, সামর্থ্যের মধ্যে এইসব গাছের পরিচর্যাও করেন আবু তাহের। নিয়ম করে পানি দেওয়া, পরিমাণমতো সার দেওয়া, গাছের দেখভালের কাজও করছেন দায়িত্বশীলতার সাথে। অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরার পথে এই কাজ করতে তার ক্লান্তি আসেনি কখনো। বরং বাড়াতে চান কাজের পরিধি। সেই চেষ্টাও করে চলেছেন ইতোমধ্যে।

করোনাকালীন সময়টি আবু তাহেরের কাছে বিশেষ কারণে প্রিয় সময়। কারণ অন্যান্য কাজ না থাকায় এই সময়ে সবচেয়ে বেশি গাছ রোপণ ও বীজ বপন করেছিলেন তিনি। তাছাড়া দীর্ঘ সময় নিয়ে গাছের পরিচর্যাও করতে পেরেছিলেন যত্নের সাথে। কিন্তু আগের মতো ব্যাপকভাবে পরিচর্যা করতে পারেন না বলে কিছুটা আক্ষেপও আছে তার। জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে হয় এমন অভিযোগ।

এই পর্যন্ত কত গাছ রোপণ করেছেন সে বিষয়ে পরিষ্কার হিসেব নেই তার। তবে আনুমানিক হিসেবে দুই হাজারেরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন তিনি। প্রতিটা বীজ বা গাছ তিনি লাগিয়েছেন খোলা জায়গায়। নেই কোনো সুরক্ষা বেষ্টনী। ফলে অনেক সময় মানুষ উপড়ে ফেলে বা পশুপাখি খেয়ে ফেলে। আবার অনেক সময় ক্ষেত করার উদ্দেশ্যে অনেকে কেটেও ফেলে। বড় হওয়ার পরও এমন অনেক গাছ উপড়ে ফেলা বা কেটে ফেলা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এসব স্থানে আবার গাছ লাগান নতুন করে।

আবু তাহের বলেন, 'আমি এই পর্যন্ত যত গাছ লাগিয়েছি তার মধ্যে হয়তো ১০–২০ শতাংশ গাছ ঠিকঠাক বড় হতে পারছে বা অক্ষত আছে। এত কষ্ট করে যখন এই কাজ করি, আর কেউ এসে সহজেই গাছটিকে উপড়ে ফেলে তখন খুব কষ্ট লাগে।'

তবে এত কিছুর পরেও হার মানার পাত্র নন তিনি। যদি ১০ শতাংশ গাছ ঠিকঠাক বেড়ে উঠে তবে সেটার জন্যই কাজ করে যাবেন আজীবন। এমনটাই পণ তার। খোলা জায়গায় গাছ লাগালে এমনটা হতে পারে বলে মেনে নিয়েছেন তিক্ত সত্যতা।

তিনি বলেন, 'একসময় ১০ শতাংশ গাছ বড় হতে হতে সেটা ১০০ শতাংশতে দাঁড়াবে। আমি জানি, গাছ উপড়ে ফেলা হবে, নষ্ট হবে বা কাটা হবে। তবুও চাই অন্তত কিছু গাছ বড় হোক, গাছপালা বাড়ুক। দরকার হলে আমি আজীবন এই ১০ শতাংশের জন্য কাজ করে যাব।'

'আমি বেঁচে না থাকলেও আমার গাছগুলো থাকবে'

অন্যরাও যাতে গাছপালা রোপণে এগিয়ে আসে এই উদ্দেশ্যে কাজে নেমেছিলেন তিনি। সবাইকে জানাতে চান গাছের উপকারিতা এবং গুরুত্ব। এখন ধীরে ধীরে সেটি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলেই তাহেরের মুখজুড়ে প্রশান্তির ছায়া। এভাবে গাছ লাগিয়ে পার করতে চান বাকিটা সময়।

তবে এখন স্বপ্ন দেখেন একটি সংগঠন করার। তরুণ যে ছেলেমেয়েরা গাছ লাগানোর ব্যাপারে আগ্রহী এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেতন তাদেরই যুক্ত করতে চান সেখানে। তিনি বলেন, 'যারা গাছ ভালোবাসে, এটির সাথে সম্পৃক্ততা আছে, কাজ করতে চায়, তাদের নিয়ে সংগঠন করতে পারলে আরও ভালোভাবে করা যাবে এই কাজ।'

তার ভাষ্যমতে, মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত অন্যের কল্যাণে নিজের আনন্দ খুঁজে নেওয়া। তাই মানুষের ছায়াহীন জীবনে আবার ছায়া ফিরিয়ে আনাই আপাতত মূল লক্ষ্য তার।

'কেউ সারাজীবন বেঁচে থাকে না, আমিও না। তবে আমি বেঁচে না থাকলেও আমার গাছগুলো থাকবে,' বলেন আবু তাহের।


ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.