যেভাবে স্মার্ট প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের বৈশ্বিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে মিউলিটিক

ফিচার

31 January, 2024, 07:25 pm
Last modified: 31 January, 2024, 07:41 pm
মিউলিটিক অত্যাধুনিক ডেটা এনার্জি প্রতিষ্ঠান রেনল্ট, হার্মিস, ডিএইচএল, মার্সিডিজ বেঞ্জসহ আরও অনেক শীর্ষ স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছে।

২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরিবহন অবকাঠামোর একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। ঢাকার বাইরে প্রথম যশোরের খয়েরতলায় একটি বৈদ্যুতিক যান (ইভি) চার্জিং স্টেশন উদ্বোধন করা হয়েছে।   

ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন প্রতিষ্ঠান লিমিটেডের সহযোগিতায় মিউলিটিক এটি চালু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 

মিউলিটিকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. রুবাইয়াত ইসলাম সাদাত বলেছেন, "এটি কেবল শুরু।" 

যশোরের স্টেশনটি আগামী বছরগুলোতে সারা দেশে হাজার হাজার চার্জিং স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্যে পাইলট ভিত্তিতে চালু করা হয়েছে।   

সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে কথা বলার সময় সাদাত জানিয়েছেন, "আমাদের শেষ ও মূল উদ্দেশ্য হল প্রযুক্তির বুদ্ধিমান প্রয়োগের মাধ্যমে শক্তি খরচের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।"

জার্মান প্রযুক্তিতে তৈরি মিউলিটিকের এআই চালিত ইভি চার্জার পরিবেশের দূষণ রোধ করার পাশাপাশি অটোমোবাইল চার্জিং খরচ ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে। 

ইভিগুলোর জন্য স্মার্ট চার্জিং সলিউশন প্রবর্তন করা মিউলিটিকের দীর্ঘ পরিকল্পনার একটি ছোট অংশ যা সাদাতের নেতৃত্বে মিউলিটিক হাতে নিয়েছে।

জার্মানির মিউনিখে অবস্থিত এই অত্যাধুনিক ডেটা এনার্জি প্রতিষ্ঠান রেনল্ট, হার্মিস, ডিএইচএল, মার্সিডিজ বেঞ্জসহ আরও অনেক শীর্ষ স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। 

মিউলিটিকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. রুবাইয়াত ইসলাম সাদাত

সাদাত বলেন, "আমরা বিশ্বের বৃহত্তম অটোমোটিভ সংস্থাগুলোকে উদ্ভাবনী বিগ ডেটা বিশ্লেষণে সমাধান প্রদান করি।" প্রতিষ্ঠানটি এখন দুটি বিভাগে কাজ করে - গবেষণাগার এবং এনার্জি৷  

বর্তমানে এটি একটি বড় মাপের বিদ্যুতায়ন প্রকল্পে জার্মান ন্যাশনাল গ্রিডের সাথেও কাজ করছে। 

প্রতিষ্ঠানটি তার ক্লায়েন্টদের ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, প্রেডিক্টিভ অ্যানালাইসিস, সাইবার নিরাপত্তা, সেন্ট্রালাইজড লগিং মেকানিজম, ক্লাউড কম্পিউটিং, ওয়েব এবং মোবাইল অ্যাপ তৈরিসহ বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান করে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপক খ্যাতি অর্জনের কারণে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করার পর থেকে মিউলিটিক একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সাদাত উল্লেখ করেন, তিনি যখন মিউলিটিক প্রতিষ্ঠা করেন প্রথমে তিনি প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। আজ প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক রাজস্ব প্রায় এক মিলিয়ন ইউরো। 

শুরুতে এটি আইটি ক্লাউডে হোস্ট করা সমস্ত অপারেশন সম্পূর্ণভাবে রিমোটলি পরিচালনা করতো। পরবর্তীতে এটি দ্রুত নিউইয়র্কে একটি কৌশলগত ব্যবসায়িক ইউনিট খোলার মাধ্যমে তার কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে। 

মিউলিটিকের নেতৃত্বে আরো কয়েকজন বাংলাদেশি রয়েছেন যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাহাত আহমেদ, আর মার্কেটিং প্রধান হলেন জাওয়াদ রামি। 

আর্থিক লাভের পাশাপাশি মিউলিটিকের ঢাকায় অফশোর ডেভেলপমেন্ট এবং অপারেশন হাব থাকায় এটি বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রেও তুলে ধরছে। সাদাত বলেন, "আমরা বাংলাদেশে আমাদের গ্রাহকদের সকল চাহিদা মেটাতে ২৪ ঘণ্টা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করি।" 

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ভিত্তিক গবেষণা উন্নয়ন এবং অপারেশন দলে প্রায় ২৫ জন তরুণ কর্মচারী রয়েছে। এই দলটি প্রাথমিকভাবে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), গণিত এবং পরিসংখ্যানের মতো বিভাগ থেকে নতুন স্নাতকদের নিয়ে গঠিত। 

সাদাত বলেন, "ডাটা অ্যানালিটিক্স হলো গণিতের বিষয়। আপনার গাণিতিক দক্ষতা যত বেশি শক্তিশালী হবে তত বেশি কার্যকরভাবে আপনি বিশ্লেষণমূলক টুল ব্যবহার করতে পারবেন।"

তিনি মন্তব্য করেন, "মিউলিটিকস উন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে একটি অভিসন্ধি তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যার প্রাথমিক লক্ষ্য বাংলাদেশ। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করা মানে বিশ্বকে সাহায্য করা।"   

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির 'ব্রাইট' নামে একটি প্রোগ্রাম চলমান যা 'বৈশ্বিক প্রযুক্তি ব্যবসার মাধ্যমে তরুণ বাংলাদেশিদের মূল্যায়ন, পথনির্দেশ এবং পরামর্শ প্রদান করে থাকে'। 

সহজ কথায়, ১৬ সপ্তাহের ইন্টার্নশিপের মতো এই প্রোগ্রামটি নতুন প্রযুক্তিবিদদের জন্য তাদের দক্ষতা অন্বেষণ করতে এবং শিল্পে অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পরে সফল ইন্টার্নদের প্রতিষ্ঠানের সাথেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার বা অন্য কোথাও নতুন কর্মজীবনের সুযোগ তৈরি করার বিকল্প দেওয়া হয়।   

মিউলিটিক বাংলাদেশে 'প্রজেক্ট এথেনা' নামে একটি বার্ষিক প্রোগ্রামও পরিচালনা করে যা বিশেষভাবে তরুণ মহিলাদের প্রযুক্তিতে সফল ক্যারিয়ারের দিকে তাদের ক্ষমতায়নের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। 

এই উদ্যোগের মাধ্যমে মিউলিটিক হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং প্রোগ্রাম তৈরি করে এবং সেইসব মহিলাদের জন্য সুযোগ তৈরি করে যারা সবেমাত্র শুরু করছে বা ভবিষ্যতে প্রযুক্তিতে তাদের ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে চাইছে। 

সাদাতের মতে, প্রজেক্ট এথেনা ইতিমধ্যে অনেক প্রতিভাবান নারী তৈরি করেছে যারা অনেক বৈচিত্র্যময় শিল্পে সফল হয়েছে। সাদাত বলেন, "প্রজ্ঞা, যুদ্ধ এবং কারুশিল্পের গ্রিক দেবীর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এটির নামকরণ করা। আমরা নারীদের প্রযুক্তি খাতে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নিয়েছিলাম।" 

সাদাত যোগ করেন, "এখন আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি যে গবেষণা উন্নয়ন এবং অপারেশন দলের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় পদে নারী রয়েছে।"

সাদাত ২০০৮ সালে বুয়েট থেকে সিএসইতে স্নাতক করেন। 

তিনি ইতালির ট্রেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োইনফরমেটিক্সে তার প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর জার্মানির আরডব্লিউটিএইচ আচেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবেডেড সিস্টেমে দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। 

তিনি জার্মানির সিজেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবেডেড সিস্টেমে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি অন্য একটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য কেমব্রিজ জজ বিজনেস স্কুলে যোগদান করেছেন এবং বর্তমানে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করছেন।

ইইউ কমিশনের পরামর্শক হিসেবে কাজ করা এবং ফোক্সভাগেনে চিফ টেকনোলজি অফিসার হিসেবে কাজ করা ছাড়াও সাদাত এ২আই-এর জন্য স্বয়ংচালিত এবং শক্তিতে জাতীয় পরামর্শক বিশেষজ্ঞ হিসাবেও অবদান রেখেছেন।

তার নেতৃত্বে মিউলিটিক ২০২১ সালের সেরা এনার্জি ফোকাসড ওয়েব এবং মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের শিরোপা জিতেছে। 

দুই সন্তানের পিতা সাদাত তার প্রতিষ্ঠানে প্রথম অংশের নামকরণ করেছিলেন তার ছেলে মুয়াজের নামে (মিউ, মুয়াজের ইংরেজি নামের 'mu' থেকে)। বাকি অংশটি (লিটিক) এসেছে 'বিশ্লেষণমূলক' শব্দ থেকে। তিনি সম্পূর্ণরূপে তার পরিবারের প্রতি নিবেদিত একজন ব্যক্তি।

সাদাত তার জীবনের সাফল্যের কৃতিত্ব তার স্ত্রী মৌরিকে দেন এবং বলেন, "আমি যা করি তা আমার পরিবারের জন্য।"

তবে মনে মনে তিনি "বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করা এবং জাতিকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখেন।"  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.