যে দোকানে বিনামূল্যে খেতে পারে ক্ষুধার্তরা

ফিচার

26 January, 2024, 04:20 pm
Last modified: 26 January, 2024, 11:31 pm
লজ্জায় ক্ষুধার কথা বলতে না পারা মানুষ, বাসা-বাড়ির দ্বারে দ্বারে গিয়ে খাবার না পেয়ে ফিরে আসা মানুষজনের ভরসার স্থান হয়ে উঠেছে তার এই দোকান। পছন্দের খাবার ইচ্ছেমতো খেতে গুনতে হবে না কোনো টাকা। শুধু অসহায় নয়, প্রয়োজন যার, এসে নিজ অধিকারবলে খেয়ে যাবে এই দোকান থেকে। 

ছবি: ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত

চট্টগ্রাম নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকা। সেখানকার অন্যতম পরিচিত স্থান ফিনলে স্কয়ার। মস্ত বড় এক শপিং মল। স্বাভাবিক দিনের মতই ব্যস্ততা মলের সামনে। নগরীর অন্যরকম প্রাণচঞ্চল রূপ দেখা যায় এখানটায়। চোখে পড়ার মতোই মানুষের ভিড় চারপাশে। রাস্তার দুপাশে গাড়ি-ঘোড়ার হরহামেশা যাতায়াত। ফুটপাতে সারিবদ্ধ অসংখ্য দোকান। হরেক রকমের খাবারের দেখা মেলে সেখানে। তারই মাঝে চা-নাস্তায় জমে উঠেছে মানুষের আড্ডা। সন্ধ্যা নামতেই যেন এই এলাকা প্রাণ ফিরে পায় নতুন করে। 

তবে এত শোরগোল, চটকদার জিনিসপত্র, লোভনীয় স্ট্রিট ফুডের ভিড়েও নজর কাড়ে ছোট্ট একটি দোকান। সৌম্য চেহারার মাঝবয়সী এক ব্যক্তি বসে আছেন ভেতরে। নাম নজরুল ইসলাম। বয়স চল্লিশের কোঠায়। মুখে লম্বা দাড়ি। কোমল কণ্ঠস্বরের এই ব্যক্তির আচার-ব্যবহারও বেশ নমনীয়। কিন্তু মুখের কোথাও যেন বিষণ্ণতার ছাপ। অবশ্য সে কারণ জানা গেল আরও পরে।

ভাত, মাছের তরকারি, সবজি ভাজি মুরগির ঝোল, লুচি, আলুর দম, ছোলা বাটুরা, ছোলা ভাজা, পেঁয়াজুসহ হরেক রকম খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে দোকানের সামনে। প্রতিদিনই থাকে এমন ৭-৮ ধরনের খাবারের আয়োজন। আশেপাশে অন্য সব দোকানের সামনেও আছে এমন সব খাবারের বন্দোবস্ত। তবে ছোট্ট এই দোকানের সামনে মানুষের ভিড় দেখে বিস্মিত হবেন যে-কেউ! 

অসহায় পথিকের আহার প্রাপ্তির স্থান

ভিড়ের কারণও আছে বটে। কোনো সাধারণ খাবারের দোকান নয় এটি। বলা যায়, ব্যস্ত এই নগরীর আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসহায় পথিকের আহার প্রাপ্তির অন্যতম স্থান এই দোকান।

আহামরি তেমন কিছুই নেই এখানে। ভেতরে অল্প একটু জায়গা। নেই চেয়ার-টেবিলের বন্দোবস্তও। এমনকি একজনের দাঁড়িয়ে থাকাটাই হয়ে ওঠে কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফুটপাত ঘেঁষেই এই দোকান। সেখানে একপাশে দাঁড়িয়ে রান্নার কাজ সারেন নজরুল।

শান্ত স্বভাবের এই মানুষটির মুখে সদা স্মিত হাসি। মনোযোগের সাথেই করেন সব কাজ। এমনকি কাজের সময় কারো সাথে কথা বলতেও নারাজ তিনি। সকাল থেকেই চলে রান্না-বান্নার কাজ। বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রতিদিন ৫০-৬০ জনের হিসেব করেই রান্না করেন। তবে এর বাইরেও আলাদা করে বাড়িয়ে দেওয়া হয় খাবারের পরিমাণ। তারপর একসাথেই হয় রান্না। 

বিক্রয়মূল্যও খুব একটা বেশি নয়। ৩০ টাকা থেকেই শুরু হয় খাবারের দাম। ভিন্ন ভিন্ন খাবার অনুযায়ী সে দাম সর্বোচ্চ ৬০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

এতে করে সামর্থ্য রয়েছে যাদের, তারা যেমন টাকা দিয়ে কিনে খাচ্ছে, তেমনি অসহায় যারা, তারাও বিনামূল্যে নিজ অধিকার মনে করে খেয়ে যাচ্ছে। কোনো বাধানিষেধ নেই। ইচ্ছে হলেই খেতে পারবে সবকিছু। এমনকি প্রয়োজন অনুযায়ী মিলবে খাবার।

চট্টগ্রাম শহরের যেকোনো প্রান্তের মানুষ, প্রতিদিন এক বেলা ভাতের জোগান নিয়ে ভাবতে হয় যাদের, সেসব মানুষ এখানে এসেই পেয়ে যাবেন নিজ পছন্দের খাবার। তবে এই অসাধারণ উদ্যোগের পেছনে আছে অন্যরকম এক গল্প।

কেন এই উদ্যোগ?

'একসময় ভারতে কাপড়ের বড় ব্যবসা ছিল আমার। সেখান থেকে কাপড় চালান হতো বাংলাদেশে। এমন এক কোটি টাকার চালান ঠিকঠাক না হলে লোকসানে পড়ে যাই। প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতছাড়া হয়ে যায় এতে। পথে নেমে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় তখন। এমনও সময় ছিল, যখন ইফতার করার টাকাটাও ছিল না হাতে। সে সময় একজন মানুষ আমাকে ইফতার খেতে দিয়েছিলেন। সেদিনই বুঝলাম যারা ঠিকঠাক খেতে পারে না, কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের কষ্ট কতখানি'—কথাগুলো বলতে বলতেই গলা জড়িয়ে আসে নজরুলের। জীবনের কঠিন যে সময়টার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটাই যেন আরও একবার ভেসে উঠল চোখের সামনে। সেই স্মৃতি জীবন্ত হয়েই ধরা দেয় বারবার। অবশ্য তিনি নিজেও ভুলতে চান না কষ্টের সে সময়টা। 

সেদিনই নজরুল নিজের কাছে করে বসেন অন্যরকম এক পণ। যদি অর্থনৈতিকভাবে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা তার তৈরি হয় কখনো, তবে খেতে না পেরে অনাহারে থাকা মানুষদের জন্য করবেন খাবারের বন্দোবস্ত। অভুক্ত থাকাটা যেন কারো ভাগ্য না হয়ে যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করবেন বড় পরিসরে। 

তবে ব্যবসায় সব হারিয়ে তখন নজরুলের পথে বসার অবস্থা। নিঃস্ব হয়ে ভারত থেকে ফিরে আসেন নিজ দেশে। বাস করতেন চট্টগ্রামের দুই নম্বর গেইট এলাকায়। ফিরে এসে ভাবতে থাকেন কী করা যায়। মাথার ওপর লাখ টাকা ঋণের বোঝা। চারপাশে অসংখ্য পাওনাদার।

চিন্তার সাগরে যেন ডুবে ছিলেন নজরুল। তবে দমে যাননি। অনেক চেষ্টার পরে কয়েক মাসের মধ্যেই অল্প পুঁজিতে ভর করে খুলে বসেন একটি খাবারের দোকান। ২০২২ সালেই শুরু হয় নতুন এই যাত্রার। দিনরাত এক করে পরিশ্রম করে গেছেন নজরুল। কীভাবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া যায় সে চেষ্টাই করেছেন বারবার। এই যাত্রায় অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেন তিনি।

সংকট কাটিয়ে উদ্যোগের বাস্তবায়ন 

একেবারে শূন্য থেকে শুরু করা এই ব্যবসার হাল মজবুত হতে সময় লাগে প্রায় বছর দেড়েক। একটু একটু করে নিজের অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করলে নজরুল নিয়ে বসেন সাহসী সেই সিদ্ধান্ত। প্রতিদিন যত অসহায় লোক দোকানে খেতে আসবে, তাদের খেতে দেওয়া হবে। গত ২-৩ মাস সময় ধরে এভাবেই চলছে দোকানের নিয়মকানুন।

দুই বছরের পরিশ্রমে নজরুলের বর্তমান ব্যবসা। খুব বড় বা লাভজনক সফল ব্যবসা নয় তার। দোকান থেকে যে আয় হয়, তা অনেক অল্প। কিন্তু ক্ষুধার্তকে এক বেলা ভাত খাওয়ানোর মধ্যে যে আনন্দ সেটার গুরুত্বই যেন বেশি তার কাছে। তাই স্বল্প আয়েও নিজের কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারাটাই যেন আপাতত প্রশান্তির বিষয়।

লোকসানের মুখ থেকে ফিরে আজকের অবস্থানে কীভাবে নিজেকে নিয়ে আসলেন, তা নিয়ে জানতে চাইলে নজরুল বলেন, '২০২২ সালে চট্টগ্রামে আসার পর আমার অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। অসহায়ের মতো পথে পথে ঘুরেছি। শুধু ভাবতাম কীভাবে কী করা যায়। সে সময়টা কীভাবে কেটেছে কাউকে বলে হয়তো বোঝানো যাবে না। তবে হার মানিনি। চেষ্টা করে গেছি। হয়তো তাই আল্লাহও সাহায্য করলেন।'

ফুটপাতঘেঁষা এই দোকানের সামনে প্রতিদিন ভিড় করে অসংখ্য মানুষ। সপ্তাহের ৭ দিনই খোলা থাকে এটি। গড়ে প্রায় ৫-৬ জন অসহায় মানুষ খেতে আসে এখানে। মাঝে মাঝে সে সংখ্যা আরও বেশি হয়। এদের বেশিরভাগই হয়ে থাকেন বয়সে প্রবীণ। সব বয়সী মানুষেরই আছে আনাগোনা। তবে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। 

এই দোকানে প্রায়ই খেতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শোয়েব। থাকেন চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায়। তিনি বলেন, 'নানা ধরনের অসহায় মানুষ আসেন মামার কাছে। মামা হাসিমুখে তাদের খাবার খেতে দেন। এমন ট্রিট করেন, তাতে কারোরই লজ্জা লাগার কথা নয়। তার ব্যবহার এতই ভালো যে কেউ এখানে এসে খাওয়াটাই প্রেফার করবে আগে।'

করতে চান যা কিছু

এখনো নজরুলের কাঁধে চেপে আছে ২০-২৫ লক্ষ টাকার ঋণ। এই নিয়ে বেশ অস্থিরতায় দিন পার করেন। এ কারণে বিয়েও করেননি। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন কীভাবে এই ঋণ পরিশোধ করা যায়। 

নজরুল স্বপ্ন দেখেন একদিন সব ঋণ চুকে যাবে তার। কোনোরকম দায় থাকবে না। চাপমুক্ত হয়েই করবেন নিজের স্বপ্ন পূরণ। ভবিষ্যতে অনেক বড় খাবারের দোকান হবে। প্রতিদিন অসংখ্য অসহায় মানুষের জন্য রান্না হবে সেখানে। তৃপ্তি মিটিয়ে খেয়ে যাবেন সবাই। স্বপ্নের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর নজরুল। সে লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছেন তিনি। 

নজরুলের মতে, এমন কাজে খুব বেশি যে টাকার দরকার হয়, তা কিন্তু নয়। প্রতিদিন অনেকভাবেই টাকা নষ্ট হয় আমাদের। যে পরিমাণ অপচয় হয়, তার অর্ধেক টাকাও যদি জমানো হয় বা কাউকে এই কাজে সাহায্যের জন্য দেওয়া হয়, তবে তা দিয়ে অনেক মানুষের দুই বেলা ভাতের ব্যবস্থা করা যাবে সহজেই।

বর্তমানে লজ্জায় ক্ষুধার কথা বলতে না পারা মানুষ, বাসা-বাড়ির দ্বারে দ্বারে গিয়ে খাবার না পেয়ে ফিরে আসা মানুষজনের ভরসার স্থান হয়ে উঠেছে তার এই দোকান। পছন্দের খাবার ইচ্ছেমতো খেতে গুনতে হবে না কোনো টাকা। শুধু অসহায় নয়, প্রয়োজন যার, এসে নিজ অধিকারবলে খেয়ে যাবে এই দোকান থেকে। 

নজরুল বলেন, 'কেউ যখন এসে বলে, একটু খাবার দেবেন?—তখন খুব খারাপ লাগে। কেন সে চেয়ে চেয়ে খাচ্ছে? আবার চাইলেও কিন্তু সবাই দিচ্ছে না। কেউ কেউ চাওয়ার লজ্জায় ঠিকঠাক খাচ্ছে না। এমন যত মানুষ আছেন, তাদের জন্য আমার দোকানের দুয়ার খোলা থাকবে সবসময়। যতদিন আমার সামর্থ্য থাকবে, আমি এই কাজ করে যাব।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.