হেলিকপ্টার—কিন্তু ওড়ে না, চলে রাস্তায়

ফিচার

19 January, 2024, 11:10 am
Last modified: 19 January, 2024, 02:01 pm
বাইসাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে স্ক্রুর সাহায্যে আটকানো হয় কাঠ কিংবা তক্তা। তার ওপর ফোম বা গদি বসালেই তৈরি হয়ে যায় বসবার আরামদায়ক ব্যবস্থা। এটিই দ্বিচক্রযান হেলিকপ্টার।
ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী

হেলিকপ্টার শব্দখানা শুনলে আপনার চিন্তায় নিশ্চয় তিনপাখাআলা উড়োযানের ছবি ভেসে উঠবে। কিন্তু দ্বিচক্রযান হিসেবে হেলিকপ্টারকে একবার কল্পনা করে দেখুন তো! এই হেলিকপ্টার ওড়ে না, চলে সড়কপথে। যেমন করে 'শিং নেই তবু নাম তার সিংহ', ঠিক তেমনিভাবেই পাখা নেই তবু নাম তার হেলিকপ্টার। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরায় দেখা মিলবে এই ঐতিহ্যবাহী যান হেলিকপ্টারের; যা ওড়ে না আকাশে, চলে ভাঙাচোরা এবড়োথেবড়ো সড়কে।

দ্বিচক্রযান হেলিকপ্টার কী?

বাইসাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে স্ক্রুর সাহায্যে আটকানো হয় কাঠ কিংবা তক্তা। তার ওপর ফোম বা গদি বসালেই তৈরি হয়ে যায় বসবার আরামদায়ক ব্যবস্থা। এটিই দ্বিচক্রযান হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারের কাজে 'হিরো রয়েল' বাইসাইকেলের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ এটি অন্যান্য সাইকেলের তুলনায় মজবুত। শুধু তা-ই নয়, হিরো রিয়েল সাইকেলের ক্যারিয়ার বেশ বড়।

এই গদি বা ফোমে সাধারণত এক বা দুজন মানুষকে বহন করবার ব্যবস্থা রয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় সামনের রডে আরো একজন যাত্রী বহন করা হয়। যিনি হেলিকপ্টার চালান তাকে বলা হয় 'পাইলট'। হেলিকপ্টারের সিটে বসে স্থানীয় মানুষ দূরদূরান্তরে যাতায়াত করেন। চুক্তি ও দূরত্বের ভিত্তিতে ঠিক হয়ে থাকে ভাড়া। এই হেলিকপ্টার সার্ভিস সাতক্ষীরা জেলার বাইরে যশোরের কেশবপুর, খুলনার ডুমুরিয়া, পাইকগাছা পর্যন্ত ছড়িয়েছে এক সময়।

হেলিকপ্টারের ইতিহাস

লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে সাতক্ষীরা অঞ্চলের কথা লিখতে গিয়ে হেলিকপ্টার নিয়ে একটি কথিত গল্পের উল্লেখ করেছেন। সাতক্ষীরা অঞ্চলের জমিদারের অতিথি হিসেবে একবার এক ধনী ব্যবসায়ী এলেন। তখন বৃষ্টি কাদার সময়। রাস্তাঘাট ডুবে গিয়েছে। জমিদার তো পড়লেন মহা বিপদে। অতিথি ব্যবসায়ীকে নিয়ে আসবার জন্যে বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে গদি বসিয়ে বানানো হলো একটি বসবার জায়গা। জমিদার এই অদ্ভুত যানের নাম দিলেন হেলিকপ্টার।

ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী

হেলিকপ্টারের কোনো সুনির্দিষ্ট লিখিত ইতিহাস সেভাবে নেই। তবে প্রচলিত আছে নানা ধরনের গল্প যা মুখে মুখে বেঁচে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কেউ কেউ মনে করেন, সাইকেলের পেছনে বসবার জায়গা বানিয়ে কেউ একজন মজার ছলে বলেছিলেন, এটা হেলিকপ্টার। সেই থেকে এই নাম প্রচলিত। আবার কথিত আছে, কালিগঞ্জ উপজেলার কোনো এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম হেলিকপ্টার যানের প্রচলন করেন। ব্যবসার কাজে দূরদূরান্তে যাতায়াতের জন্যে এই যানের উদ্ভব বলেও মনে করা হয়।

কেন এই হেলিকপ্টার

দেশের অন্যতম উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার অধিকাংশ রাস্তাঘাট ছিল অনুন্নত। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পাকা রাস্তা একেবারেই ছিল না। একেই নিচু অঞ্চল, তার ওপর কাঁচা রাস্তা। সামান্য বৃষ্টি হলেই নিচু কাঁচা রাস্তায় উঠে যেত পানি। এমন রাস্তায় পায়ে হেঁটে যাতায়াত করা একেবারেই সহজসাধ্য নয়। তাই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবস্থা করা হলো হেলিকপ্টার সার্ভিসের। ষাটের দশকে হেলিকপ্টার সাতক্ষীরা অঞ্চলে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। আবার দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় জরুরি কাজে পৌঁছানোর ব্যাপারেও হেলিকপ্টার দারুণ সাহায্য করেছে।

আশাশুনি উপজেলার সাইহাঁটি গ্রামের সাবেক পাইলট বীর মুক্তিযোদ্ধা জেহের আলী মিস্ত্রী (৮২) জানান, ১৯৬৮ সালে থেকে তিনি দীর্ঘ ৫০ বছর হেলিকপ্টার চালান। ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে আশাশুনি এলাকায় খুবই কম সংখ্যক পাইলট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে বহু মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি হেলিকপ্টারে করে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন।

ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী

তিনি জানালেন, উজিরপুর থেকে আশাশুনি পর্যন্ত আট কিলোমিটার পথের জন্যে ভাড়া ছিল ৫০ পয়সা। আশাশুনি থেকে সাতক্ষীরা সদর ভাড়া নিতেন পাঁচ টাকা। দিনে রোজগার হতো ১৬-১৭ টাকা। পরবর্তীকালে সাইহাঁটিতে মুনসুর সর্দার, মোহাম্মদ বিশ্বাস হেলিকপ্টার ব্যবসা শুরু করেন।

হেলিকপ্টার দূর দূরান্তে মানুষকে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সংবাদপত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজেও ব্যবহৃত হয়েছে। তবে রাস্তাঘাটের উন্নতির সাথে সাথে সাইকেল হেলিকপ্টারও আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে বিগত কয়েক দশক থেকে। কালের বিবর্তনে এখন সেই সাইকেল হেলিকপ্টার হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস, বইয়ের পাতায় খুঁজতে হচ্ছে এর গল্প। আজকাল সাতক্ষীরার বিভিন্ন গ্রাম তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাওয়া যায় না একটি সাইকেল হেলিকপ্টার।

অনেকগুলো গ্রামে খোঁজখবর করবার পর পাওয়া গেল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালি গ্রামের পাইলট মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাককে (৬৫)। সাতক্ষীরার সাইকেল হেলিকপ্টারকে এখনো পর্যন্ত ধরে রেখেছেন তিনি। তিনিই এই উপজেলার একমাত্র মানুষ যিনি সাইকেল হেলিকপ্টার চালান। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে হেলিকপ্টার চালিয়ে আয় রোজগার করেন এ পাইলট।

শ্বশুরবাড়ি থেকে সাইকেলটি উপহার পেয়েছিলেন রাজ্জাক। সেটিকে হেলিকপ্টার বানিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। দিনপ্রতি আয় হয় ১৫০-২০০ টাকা। কোনো কোনোদিন আবার কোমরে ব্যথার জন্যে বের হতে পারেন না। পরিবারে চার সদস্য। পাইলট আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কোনো এনজিও কিংবা সরকারি সংস্থা থেকে ঋণ পেলে তিনি মোটরসাইকেল হেলিকপ্টারে স্থানান্তরিত হতে চান। আর্থিক অসঙ্গতির জন্যে সেটি কিছুতেই হচ্ছে না।

হেলিকপ্টারের আধুনিকায়ন

সাতক্ষীরা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী যান হেলিকপ্টারে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বাইসাইকেল হেলিকপ্টারের ঐতিহ্যের সাথে কিছুটা আধুনিকতা যোগ করে চালু হয়েছে মোটরসাইকেল হেলিকপ্টার। বর্তমানে জেলাব্যাপী প্রায় ১৫হাজার পাইলট মোটরসাইকেল হেলিকপ্টার ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রেখেছে। এই ব্যবস্থায় মোটরসাইকেলের সিট যাত্রী বহনের কাজে ব্যবহার করা হয়; আলাদা করে গদি বসানোর ঝক্কি নেই।

ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দহকুলার গ্রামের হেলিকপ্টার চালক আব্দুল জব্বার জানালেন, তিনি ২০ বছর আগে ব্যাঙদহ, গাভা, ফিংড়ি অঞ্চলে সাইকেল হেলিকপ্টার চালাতেন। প্রতি কিলোমিটার পথের জন্যে ভাড়া পেতেন ৫০ পয়সা। এভাবেই টেনেছেন ছয় জনের সংসার। বিগত ৮-১০ বছর যাবৎ তিনি মোটরসাইকেল হেলিকপ্টার চালান। এখন প্রতি কিলোমিটার পথের জন্যে নেন ১০ টাকা।

তিনি আরও জানান, এখন সাতক্ষীরার রাস্তাঘাট বেশ উন্নত। মানুষ দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছাতে চান। সাইকেল হেলিকপ্টার এখন পিছিয়ে, কেননা সময় বেশি লাগে। তাই তিনি মোটরসাইকেল হেলিকপ্টারকেই বেশি উপযোগী বলে মনে করেন।  তবে অনেকসময় তিনি ভাড়া নিয়ে গ্রামের দিকে যান। ফিরতি পথে আরেকটি ভাড়া পান না। সেক্ষেত্রে তেল খরচ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়।

এখন সাইকেল হেলিকপ্টারের পাইলটদের নামের আগে সাবেক শব্দটি বসতে শুরু করেছে। অনেক সাবেক পাইলট মোটরসাইকেল কেনবার মতন সচ্ছল না হওয়ায় ভাড়ার ভিত্তিতে মোটরসাইকেল হেলিকপ্টার চালান। তাতে আয়ের বড় অংশ দিতে হয় মালিককে। হেলিকপ্টারের আধুনিকায়নের সাথে সাথে সাতক্ষীরা অঞ্চলের প্রবীণ বাইসাইকেল পাইলটরা পেটের দায়ে আর মূলধনের অভাবে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।

ডানাবিহীন হেলিকপ্টারের গল্পগুলো পুরোনো হয়, তবু ধুলো জমে না। হেলিকপ্টার হারায় না এত সহজেই। কেননা এ শুধু একটি সামান্য যান নয়, হেলিকপ্টারের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক গরিব মানুষের দুবেলা দুমুঠো ভাতের গল্প আর বেঁচে থাকবার লড়াই। যাদের কাছে আকাশে ডানা মেলে ওড়াটা স্বপ্ন নয়, বরং মাটিতে পা ফেলে বেঁচে থাকাটাই স্বপ্ন। যে স্বপ্ন হেলিকপ্টার যানটির মতোই প্র‍য়োজনীয় কিন্তু আড়ম্বরহীন।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.