যে রূপলাল হাউস একসময় শরৎচন্দ্র, ওস্তাদ গোলাম আলীদের পদচারণায় মুখর ছিল!
ফিচার
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এক বিদেশির হাতে আঁকা একটি ছবিতে বুড়িগঙ্গা পাড়ের একটি প্যানারমিক ভিউ দেখেছিলাম। স্কেচটিতে দৃশ্যমান সুউচ্চ বাড়িটির নাম রূপলাল হাউস, সেই সময়ের ঢাকার অভিজাত বাড়িগুলোর মধ্যে একটি।
ধারণা করা যায়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আর্মেনিয়ান জমিদার আরাতুন এই বাড়িটি বানিয়েছিলেন। উনিশ শতকের শেষার্ধে রূপলাল পরিবার বাড়িটি কিনে নেয় এবং মার্টিন কোম্পানিকে দিয়ে পুনঃনির্মাণ বা সংস্কার করায়।
রূপলাল হাউস নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার জমকালো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা শহরে নবাব পরিবারের পরই বোধহয় স্থান ছিল রূপলাল পরিবারের। নবাব আব্দুল গণির আহসান মঞ্জিলের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না তাদের এই বাড়িটি। শরৎচন্দ্র, ওস্তাদ গোলাম আলীর মত বিখ্যাত লোকেদের পদচারণা ছিল এই বাড়িতে।
ঢাকার সামাজিক ও সংস্কৃতির কর্মকাণ্ডে রূপলাল পরিবারের সম্পৃক্ততার কথা জানা যায়। গ্রিক ও ইংরেজ স্থাপত্যের সংমিশ্রণের নিদর্শন রয়েছে এই বাড়ির নির্মাণশৈলীতে।
বাড়ির সম্মুখ ভাগে ছয়টি ডরিক কলাম, মধ্যখানে একটি কোর্ট ইয়ার্ড, কাঠের সিঁড়ি, কাস্ট আয়রনের মনোমুগ্ধকর আর্চ ও রেলিং ডিজাইন মনে করিয়ে দেয় প্রাসাদোপম এই বাড়িটির হারানো গৌরবের কথা। স্থাপত্য, প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের গবেষণায় এবং পুরনো ঢাকার ইতিহাস সংরক্ষণে এই বাড়ির গুরুত্ব অপরিসীম।
বর্তমানে বাড়িটির অবস্থা বেহাল। নিচতলা হলুদ, মরিচের আড়ত, ওপরের তলা সরকারি কর্মচারীদের নিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাড়িটির তিনপাশ টিন শেডের আড়ত দিয়ে ঘেরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই জায়গাগুলো সরকারি সম্পত্তি। পুরো বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে অবৈধ দখলদাররা।
বাড়িটির সম্মুখভাগের দোতলার করিডোরের একাংশ টয়লেট এবং একতলা ডাস্টবিন রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাস্ট আয়রনের টুকরো খুলে পড়ে আছে। খিলানের মধ্যে মানুষের মূর্তিগুলো সিমেন্ট বালুর প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দিয়েছে।
নিচতলার আড়তগুলোতে পুরনো কোনো স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাতের নাগালের মধ্যে আছে এমন সবকিছুর মধ্যেই ধ্বংসের ছোঁয়া পাওয়া গেছে।
এই বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তালিকায় থাকলেও সরকারি পর্যায়ে রূপলাল হাউসের কোনো সংস্কার কাজ হচ্ছে না। পুরাকীর্তি ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। আদল ঠিক রেখে সংস্কার করে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ব্যবহারের নামে এই ধ্বংস গ্রহণযোগ্য নয়।
রূপলাল হাউস সরকারি সম্পত্তি। সরকার চাইলে যেকোনো সময় এর সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মালিকানার ব্যাপারে কোনো আইনগত জটিলতা আছে বলে মনে হয় না।
এ অবস্থা অনেক দিনের। অনেক লেখা হয়েছে পত্রিকার পাতায়, বিশিষ্ট নাগরিকরা বিভিন্নভাবে সব সরকারকে বোঝাতে চেয়েছেন এই বাড়ির গুরুত্ব। কিন্তু কোনো সরকারই কর্ণপাত করেনি, অবহেলিত অবস্থায় রেখেছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে।
জনবলের অপ্রতুলতা, দক্ষ কর্মীর অভাবে যা একটু কাজ হচ্ছে, তা-ও সন্তোষজনক নয়। এ অবস্থায় সরকার এই বাড়ির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ না নিলে হয়তো বা এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
- ছবি: লেখক [সাদা-কালো ছবিগুলো রূপলালের কলকাতাবাসী আত্মীয়দের কাছ থেকে পাওয়া।]
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.