‘খালে হবে’: ময়লামুক্ত নগরী গড়ার সাহসী যোদ্ধারা!

ফিচার

04 October, 2023, 06:25 pm
Last modified: 05 October, 2023, 06:24 pm
মোহাম্মদপুর সোসাইটির ভেতরের এই খাল, যা ছিল এতদিন আবর্জনায় ভর্তি, আবর্জনার কারণে যেখানে পানির দেখাই মিলতো না সেখানে এমন রূপ দেখতে পাওয়া অনেকের কাছে ছিলো অকল্পনীয় বিষয়। কিন্তু মোর্শেদ এবং তার দলের সদস্যরা সেই কল্পনাকেই বাস্তবে রূপ দিলেন। 

২৮ সেপ্টেম্বর। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ময়লায় ডুবে থাকা একটি খালের আবর্জনা পরিষ্কার করতে শুরু করলেন একদল তরুণ। ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই খালের পুরো দৃশ্যপট পাল্টে ফেলেন তারা। পুরো খাল ময়লামুক্ত করার পাশাপাশি সংযুক্ত ব্রিজকে তারা রাঙিয়ে তোলেন বিভিন্ন রঙে!  

উদ্দেশ্য ছিলো রাস্তায় হাঁটলে যারা বাজে গন্ধের কারণে হাত দিয়ে মুখ ঢাকতেন, তারা যাতে মুখে একরাশ স্বস্তি এবং শান্তি নিয়েই পথ চলতে পারেন হাসিমুখে। 

এই অসাধারণ উদ্যোগের পেছনের কারিগর হলেন ৩০ বছর বয়সী এক যুবক। নাম মোর্শেদ মিশু। পেশায় একজন কার্টুনিস্ট। উন্মাদ পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের কাজের পাশাপাশি করেন অভিনয় এবং উপস্থাপনাও। কিন্তু এই সবকিছু ছাপিয়ে বর্তমানে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন অন্যভাবে। ময়লামুক্ত দেশ গড়ার একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবেই সমাদৃত হচ্ছেন সবার কাছে। 

'যে শহরে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, যে শহর আমাকে আগলে রেখেছে এতবছর, সে শহরকে আগলে রাখাও তো আমার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই এই যাত্রার শুরু'- দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মোর্শেদ মিশু। 

খালের বর্তমান অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই আগে তা কেমন ছিল। ছবি: রিশি কাব্য

মোহাম্মদপুর সোসাইটির ভেতরের এই খাল, যা ছিল এতদিন আবর্জনায় ভর্তি, আবর্জনার কারণে যেখানে পানির দেখাই মিলতো না সেখানে খালটিকে এমন রূপ দেওয়া যায় সেটাই যেন অনেকের কাছে ছিলো অকল্পনীয় বিষয়। কিন্তু মোর্শেদ এবং তার দলের সদস্যরা সেই কল্পনাকেই বাস্তবে রূপ দিলেন। 

যেভাবে শুরু 'খালে হবে' প্রজেক্ট 

কিছুদিন আগের ঘটনা।  ভারি বর্ষণে পুরো ঢাকা শহরে দেখা দেয় ভয়াবহ পরিস্থিতির। রাজধানীর  অনেক এলাকা সেদিন পানিতে নিচে ডুবে যায়। এসবের  মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোহাম্মদপুরে বসবাসরত এক বন্ধুর পোস্টের মাধ্যমে মিশু জানতে পারেন খালের এমন পরিস্থিতির জন্যই এই অবস্থা আরও তীব্র হয়েছে সেই এলাকায়। বিষয়টা তখন তাকে ভাবাতে থাকে। সেদিনই চিন্তা করলেন এই খালের কোনো একটা গতি করতেই হবে। সেই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু। 

সদস্য সংগ্রহে দ্বারস্থ হলে সামাজিক মাধ্যমের। আগ্রহীদের এগিয়ে আসতে বললেন। প্রথম দিনেই ব্যাপক সাড়া পেলেন মোর্শেদ। বিষয়টি তাকে নিজের উদ্যোগ বাস্তবায়নে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পুরোদমে কাজে নেমে পড়েন তিনি। 

মোর্শেদ মিশু বলেন, 'যখন আমি ফেসবুকে আমার এক বন্ধুর এই খাল নিয়ে পোস্ট দেখলাম তখন ভাবলাম আপাতত দেয়াল বা রাস্তা পরিষ্কারের কাজ বাদ দিই। সামনে আবার বৃষ্টি হবে, অবস্থা আবার খারাপ হবে এই চিন্তা থেকে তখনই আমি খাল পরিষ্কার নিয়ে কাজ করার জন্য ফেসবুকে পোস্ট দিই। সেখানে অনেক ইতিবাচক সাড়া আসতে শুরু করে। এই কাজে আমাকে হেল্প করার জন্য অনেক মানুষ পেয়ে যাই। স্বেচ্ছাসেবী, বন্ধু, বড় ভাই, ছোট বোন,  সিটি কর্পোরেশন এর কমিশনার; সবার সাহায্যেই এই কাজ শুরু করি।' 

আগে যেমন ছিল খালের অবস্থা। ছবি: রিশি কাব্য

মোর্দেশ মিশু জানতেন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে না। কিন্তু তার এই কাজকে কিছুটা সহজ করে দেয় তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। যোগ দেন  সিটি কর্পোরেশনের কিছু পরিচ্ছন্নতা কর্মীও। এক্ষেত্রে মোহাম্মদপুরের স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের কাছ থেকেও পেয়েছিলেন আন্তরিক সহযোগিতা। রঙ, খাবার, লজিস্টিক সহযোগিতাও পেয়ে যান মোর্শেদ। 

খালের উপরিভাগ থেকে গভীর পর্যন্ত যত আবর্জনা ছিল তার সবটাই পরিষ্কার করেন তারা। মোট ৪ ট্রাক আবর্জনা ট্রাকে করে অন্যত্র সরিয়ে নেন। 

অনেক তরুণ স্বেচ্ছাসেবী যুক্ত ছিলেন এই কাজে। ছবি: রিশি কাব্য

আর ময়লা তুলে ফেলার পরে নিজেদের মনের মত করে রাঙিয়ে তোলেন খালের উপরের ব্রিজও!  

ময়লামুক্ত অভিযানের শুরু

রাজধানীর মিরপুর-১৪, বাসার নিচে চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে মিশুর চোখে পড়ে এক যাত্রী ছাউনির পাশের দেয়ালের করুণ চিত্র। দেয়ালের পাশেই ময়লা-আবর্জনার বিরাট একটি স্তূপ।  বিষয়টি অস্বস্তি দেওয়ার পাশাপাশি কিছু একটা করার তাড়না দেয় তাকে। যথারীতি সামাজিক মাধ্যমে নিজের উদ্যোগের কথা জানিয়ে দেন। এগিয়ে আসে সাহায্যের হাত। পরবর্তীতে পুরোদমে কাজে লেগে পড়েন তিনি। 

মিরপুর ১৪-তে ময়লা সরিয়ে এভাবে রাঙানো হয় দেয়াল ও রাস্তাকে। ছবি: রিশি কাব্য

এই কাজের জন্য রঙ দেয় এশিয়ান পেইন্টস এবং লজিস্টিক সাপোর্ট পেয়েছিলেন ইউএনডিপি পক্ষ থেকে। ৮ সেপ্টেম্বর ভোর ছয়টা থেকে শুরু করেন কাজ। পুরো একটি ময়লার স্তূপের দেয়ালকে রাঙিয়ে তুললেন অসাধারণভাবে। সেই শুরু। এরপর এই কাজ তার মাথায় চেপে বসে। পণ করেন এভাবে একটি একটি করে রাজধানীর অনেক রাস্তা আবর্জনা মুক্ত করবেন তিনি। খাল পরিষ্কারের উদ্যোগও তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে। যে কাজ সাড়া ফেলেছে কোটি মানুষের হৃদয়ে। 

মোর্শেদ মিশু। ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত

মিশু বলেন, 'আমি যখন এই উদ্যোগগুলো নেওয়া শুরু করলাম তখন দেখলাম সবাই আমার মতই ভাবে। আমার মতই চিন্তা করে। কিন্তু হয়তো সেভাবে সাহস করে উঠতে পারে না। অনেকের মধ্যেই এই ব্যাপারটা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। আমার কোনো কাজের মাধ্যমে উৎসাহ পেয়ে যদি তাদের সুপ্ত বিষয়টা জেগে ওঠে তবে তা কেবল ভালোই বয়ে আনবে। এমনকি আমি যখন এই কাজে অনেক মানুষের সাড়া পাই সেটা আমার মধ্যে আরও সাহস ও শক্তি জোগাতে সাহায্য করেছে।' 

যে উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু 

কোনো উদ্দেশ্য নয় বরং একান্ত নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই এই কাজে হাত বাড়ান তিনি। তার মতে, যে যেখানেই বেড়ে ওঠে সে জায়গার প্রতি তার দায়বদ্ধ থাকাও জরুরি। পাশাপাশি মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে পারার মানসিক প্রশান্তির ব্যাপার তো আছেই। 

এই কাজে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা তরুণ ফটোগ্রাফার রিশি কাব্য বলেন, 'আমরা মানুষকে জানাতে চাই যে, কোনো কিছুকে সুন্দর রাখলে কত ভালো লাগে সব। সুন্দর যদি থাকতে চাই সুন্দর রাখতে হবে সবকিছু। সুন্দর রাখতে না পারলে আমরা সুন্দর থাকতে পারবো না।'

তিনি আরও বলেন সবাই চায় নিজে যে জায়গায় থাকে সেটা ঠিক থাকুক, পরিষ্কার থাকুক। তাদের এই কাজের মাধ্যমে মানুষ কিছুটা হলেও যদি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয় তবেই এই কাজ স্বার্থক। অন্তত মানুষ বুঝবে যে চাইলেই পরিষ্কার রাখা যায়। পরিষ্কার করা সম্ভব। দরকার শুরু সদিচ্ছার।

ময়লা সরানোর কাজে ব্যস্ত মোর্শেদ মিশু। ছবি: রিশি কাব্য

হতাশার কথাও শুনান রিশি। তার ভাষ্যমতে, ৫০ জন মানুষ অমানুষিক পরিশ্রম করে যে কাজটি করেছে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হয়তো ৭ দিনেরও বেশি সময় লাগবে না। তিনি জানেন অনেক মানুষই আছেন যারা পুনরায় ঐ খালে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন। প্রতিদিন কেউ না কেউ এই কাজ করবে।  এই খাল হয়তো ৭ দিন পরিষ্কার থাকবে। কিন্তু ৭ দিনের লক্ষ্য নিয়ে এই কাজে নামেননি তারা। এই কাজের পেছনে তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো যে কাজ তারা করেছেন, সাহস দেখিয়েছেন সেসব থেকে যেন মানুষ কিছুটা হলেও  শিক্ষা নেয়। 

সাথে ছিলেন আহসান হাবিবও 

অনেক তরুণের ভিড়ে 'খালে হবে' প্রজেক্টের প্রথম দিনে পরিষ্কারের কাজে যোগ দিয়েছিলেম উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবীব। তিনি এই কাজে তাদের সাথে থেকেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, এমনকি নিজেও করেছেন রঙ করার কাজ। এছাড়া মিশুর বন্ধু-বান্ধব, সিটি কর্পোরেশন এর পরিচ্ছন্নতা কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ  শিক্ষার্থীরাও এই কাজে অংশ নেন, মোর্শেদের কাজকে আরও সহজ করে তোলে। 

আহসান হাবিবের উপস্থিতি নিয়ে মিশু বলেন, 'আহসান হাবিব স্যার যে আমাদের সাথে ছিলেন সেটা আমার জন্য অন্যরকম পাওয়া। আমার প্রথম কাজেও তিনি থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু কোনো এক ব্যস্ততায় সেটা সম্ভব হয়নি। স্যারই আমাদের ব্রিজে রঙ করানোর ব্যাপারে বলেন।'

এই কাজে প্রথমদিন থেকেই অসংখ্য মানুষের সাহায্য পেয়েছিলেন মিশু। তার দেওয়া তথ্যমতে প্রথমদিন কাজ করে ৪৫-৫০ জনের মত। দ্বিতীয় দিন এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬০-৭০ জনে। এত এত মানুষের সহযোগিতার বিষয়টি অবাক করে দেয় মিশুকেও।  

দেশি-বিদেশি মানু্ষের অর্থায়নে হয় কাজ 

কাজ শুরু করার আগেই মোর্শেদ মিশুর কাছে দেশ বিদেশে অবস্থানরত অনেক মানুষের আর্থিক সাহায্য আসতে শুরু করে। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী এই কাজে অংশ নেয়। সর্বোচ্চ ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন একজন। এই কাজের জন্য তাদের সংগ্রহে আসে ৮৮ হাজার ১০০ টাকা। কাজ সম্পন্ন করতে খরচ হয় ৮৬ হাজার ৫৩০ টাকা।

এই বিষয়ে মিশু বলেন, 'যখন কাজটি করবো বলে ভাবছিলাম তখনও জানতাম না কত টাকা লাগতে পারে। তখন পযর্ন্ত আমি খাবার, পানি এসব নিয়ে ভাবছিলাম। তখন ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিই কারা আমাদের এই কাজে হেল্প করতে চায়। ঐ পোস্টে অনেকের সাড়া পেতে থাকি । দেশ বিদেশের অনেকেই আমাকে টাকা পাঠাতে থাকে। এমন অনেকেই আছেন যারা নিজের পরিচয় গোপন করেই টাকা পাঠিয়েছে আমাকে।'

সাথে ছিলেন উন্মাদের সম্পাদক আহসান হাবিবও। ছবি: রিশি কাব্য

শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের প্রতিও মুগ্ধতার কথা শুনান মোর্শেদ।  

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা 

মোর্শেদ মিশুর এই কাজ নিয়ে আছে দীর্ঘ এক পরিকল্পনা। দেড় বছর আগে তিনি ভেবে রেখেছিলেন শহরের ২০০ জায়গা ময়লামুক্ত করবেন তিনি। ২০২৩ সালে এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজের বাসার সামনের দেয়াল রাঙানো দিয়ে শুরু, এরপর পরিষ্কার করেছেন খাল। এখন তিনি স্বপ্ন দেখেন পাহাড় পরিষ্কারের। 

মিশু বলেন, 'চিন্তা ছিলো ঢাকা শহরের ময়লা-আবর্জনা যুক্ত যত রাস্তা আছে সেগুলো সব একে একে পরিষ্কার করবো। এখন খাল পরিষ্কার করলাম। এরপরে নভেম্বরের দিকে পাহাড় পরিষ্কার করার পরিকল্পনা আছে আমার। তারপর আবার রাস্তা পরিষ্কার করার কাজে ফিরবো।'

মিশুর এমন উদ্যোগ নিয়ে একটা কথাই বলা যায়, এমন মানুষ আছেন বলেই হয়তো মানুষ ইতিবাচক পরিবর্তনে বিশ্বাস রাখেন এখনো। স্বপ্ন দেখেন একদিন এই পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তির বাতাস। যে বাতাসে মানুষ নি:শ্বাস নেবেন প্রাণ ভরে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.