মুন্সিগঞ্জের রেডিমেড ঘর: নকশায় উন্নতি, পৌঁছে যাচ্ছে সারা দেশেই

ফিচার

16 September, 2023, 10:55 am
Last modified: 16 September, 2023, 05:00 pm
জানালার রম্বস আকৃতির নকশাগুলোকে তারা বাংলায় ‘রুইতন’ বলেন। শাহিন জানান, এসব রুইতনের সঙ্গে এখন পাইপ বা পোল আকৃতির নকশা যোগ করা হয়েছে। কখনও কখনও তারা রম্বসের মাঝখানে ঢেউখেলানো নকশাও জুড়ে দেন। ঘর যত বড় আর দামি, নকশাও তত বেশি জটিল হয়। ছাদেরও বিভিন্ন রং আছে, তবে বেশিরভাগই লাল।

আগস্টের এক তপ্ত দুপুর। ৬০ বছর বয়সী আব্দুল খালেক ঘর দোর বাজারে নিজের দোকানে অলস বসে আছেন। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের বিখ্যাত রেডিমেড ঘরগুলোর প্রধান বাজার এটি।

খালেক দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রেডিমেড ঘর বানাচ্ছেন। অন্য দোকানগুলোর মতো তার দোকানটিও দেখে মনে হয় সাধারণ একটি কাঠের দোকান। কারণ দোকানের পেছনের অংশেই মূল ঘরগুলো তৈরি করা হয়।

তার কারিগরেরা বর্তমানে তিনটি নতুন ঘরের কাজ করছেন।

খালেক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এগুলো কয়েক প্রজন্ম ধরে মুন্সিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ঘর। বহনযোগ্য হওয়ায় এগুলো আবাস হিসেবে সুবিধাজনক। এসব ঘরের বিভিন্ন অংশে আলাদা করে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নেওয়া যায়। মুন্সিগঞ্জ ছাড়াও অন্যান্য জেলার লোকজনও এখন আমাদের কাছ থেকে ঘর কিনছেন।'

ঘোর দোর বাজারের অন্য ঘরনির্মাতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আদতেই গত দুই বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে এ রেডিমেড ঘরগুলো।

কাকরাইলে এরকম একটি রেডিমেড ঘরের নির্মাণকারী জসিম শরীফ জানান, তিনি সম্প্রতি নোয়াখালী ও ময়মনসিংহ জেলায় গ্রাহকদের কাছে বেশকিছু ঘর বিক্রি করেছেন। এ মুহূর্তে তার একটি ঘর গাজীপুরে বসানো হচ্ছে।

ছবি: নূর-এ-আলম

মুন্সিগঞ্জের এ ঘরগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে গেল কীভাবে? ঘর দোর বাজারের কারিগর এবং নির্মাতাদের কাছ থেকে জানা গেল সে রহস্যের উত্তর।

খালেকের কারিগর শাহিন বলেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তাদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার একটি কারণ হচ্ছে তারা সম্প্রতি এসব ঘরের নকশায় কিছু পরিবর্তন এনেছেন।

শাহিন বলেন, 'আগে এসব ঘর তৈরিতে সাধারণত স্রেফ কাঠ আর টিন ব্যবহার করা হতো। জানালা, গ্রিল বা দরজার ফ্রেমে ভেতরে ও বাইরে খুব বেশি নকশা খোদাই করা হতো না।'

জানালার রম্বস আকৃতির নকশাগুলোকে তারা বাংলায় 'রুইতন' বলেন। শাহিন জানান, এসব রুইতনের সঙ্গে এখন পাইপ বা পোল আকৃতির নকশা যোগ করা হয়েছে। কখনও কখনও তারা রম্বসের মাঝখানে ঢেউখেলানো নকশাও জুড়ে দেন।

জানালার রুইতন আকারে ছোট হলেও দরজায় এগুলো আরও বড় করে রাখায় চোখে আলাদা হয়ে ধরা দেয়। ঘর যত বড় আর দামি, নকশাও তত বেশি জটিল হয়।

জানালার গ্রিলের প্রান্তগুলোয় তারা কাঠকে তালার আকৃতিতে নকশা করেন। আর দরজার পাশটা দেখতে হয় কলসের মতো। এর সঙ্গে থাকে 'নিমতি' নামক আরেকটি নকশা।

ছবি: নূর-এ-আলম

ছাদেরও বিভিন্ন রং আছে, তবে বেশিরভাগই লাল। কারিগরেরা জানান, অতীতে ঘরের ছাদ, বেড়া হিসেবে কেবল সাদা টিন ব্যবহৃত হতো।

তবে এ নকশাগুলো অবশ্য দরজা আর ঘরভেদে আলাদা হয়।

শাহিন বলেন, "আপনি যে ঘরগুলো দেখছেন এগুলো ১৫ ফুট বাই আট ফুট। সবগুলোই বিদেশ থেকে আনা 'নাইজেরিয়া লোহা' কাঠ দিয়ে তৈরি। এসব ঘরের দাম তিন থেকে চার লাখ টাকা।"

ঘর বানাতে ব্যবহৃত 'সুপার' ও 'বুলেট' নামক দুই ধরনের কাঠের কথাও উল্লেখ করেন শাহিন। কড়ইয়ের মতো স্থানীয় কাঠও ব্যবহার করা হয় ঘর নির্মাণে। তবে কড়ই কাঠের ঘরের দাম তুলনামূলক কম হয়।

নাইজেরিয়া লোহা কাঠের একটি ঘরের দাম চার লাখ টাকা হলে একই মাপের কড়ই গাছের ঘরের দাম পড়ে দুই লাখ টাকা।

'আপনি ৩০ হাজার টাকায় কড়ই কাঠ দিয়ে পুরো মেঝে তৈরি করতে পারবেন। তবে নাইজেরিয়া লোহা কাঠের জন্য খরচ হবে এক লাখ,' শাহিন জানান।

ছবি: নূর-এ-আলম

আব্দুল খালেকের আশপাশে তার মতো প্রায় ২৫ জন রেডিমেড ঘরনির্মাতা রয়েছেন।

তাদের মধ্যে খালেকের ব্যবসা খারাপ চলছে। 'আমি মাসে গড়ে দুটি ঘর বিক্রি করি, অন্যরা চার থেকে পাঁচটি বিক্রি করে,' তিনি বলেন।

কেন? কারণ অন্যরা ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার শিখে ফেলেছেন।

'আমি নিরক্ষর একজন মানুষ। আমার জানা নাই কীভাবে এগুলো ব্যবহার করতে হয়। তাই, আমার বেশি গ্রাহক নেই,' তিনি বলেন।

জসিম শরীফ তার ব্যবসার প্রচারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, কপাল ভালো হলে তিনি মাসে ১০টি পর্যন্ত রেডিমেড ঘর বিক্রি করেন। গড়ে পাঁচ থেকে সাতটি ঘর বিক্রি হয় তার।

'ইউটিউব এবং ফেসবুকে প্রচারের সুবাদে আমাদের ব্যবসা বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আমাদের ভিডিও দেখেন এবং ঘরের অর্ডার দেন। এদের বেশিরভাগই [মুন্সিগঞ্জের বাইরে] শখের বশে এগুলোকে বাংলো বাড়ি হিসেবে তৈরি করান,' জসিম বলেন।

ছবি: নূর-এ-আলম

তবে শুধু মুন্সিগঞ্জেই এসব ঘরের ক্রেতার অভাব নেই।

'আমি এখন একটা ঘর বানাচ্ছি যার দাম প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। মুন্সিগঞ্জের একজন নেবেন ঘরটা — উনি আমার বন্ধুমানুষ,' জসিম জানান।

আমাদের আলাপের মাঝখে মেহরাব নামক একজন ভ্লগার জসিমের কাছে আসেন। মেহরাব ইউটিউব এবং ফেসবুকে এ ব্যবসার প্রচার করেন।

তার ইউটিউব চ্যানেল ৯০ হাজার সাবস্ক্রাইবার রয়েছে।

মেহরাব বলেন, 'আমরা দর্শকদের নকশা, দাম, ঠিকানা, যোগাযোগের নম্বর ইত্যাদি নিয়ে ধারণা দিই আর অনলাইন-বিক্রয় প্রচার করি। আমরা ফেসবুক এবং ইউটিউবে ডকুমেন্টারি-স্টাইলের ভিডিও এবং লাইভ ভিডিও উভয়ই তৈরি করি।'

জসিম জানান, মেহরাবের মতো এরকম আরও কয়েকজন আছেন।

ছবি: নূর-এ-আলম

'আব্দুর রবের [আরেক নির্মাতা] একটি ভিডিও মানুষ ৮০ লাখবারের বেশি দেখেছেন। এরপর থেকে তার কাছে দেশ-বিদেশ থেকে কল আসা বন্ধ হচ্ছে না,' জসিম বলেন।

চঞ্চল এখানকার তারকা কারিগরদের একজন। নির্মাতা আবদুর রবের ২৫ ফুট বাই ২৪.৫ ফুট বিশাল দোতলা একটি রেডিমেড ঘর নির্মাণের প্রধান কারিগর ছিলেন তিনি।

এ ঘরটির নকশায় একটি বারান্দাও যুক্ত করা হয়েছিল। নানা রংয়ের দামি এ ঘরটির আকার গড়পড়তা অন্য ঘরের চেয়ে অনেক বড় ছিল।

চঞ্চল জানান, বিভিন্ন নকশা ও প্যাটার্ন তৈরি এবং বিভিন্ন রংয়ের সঙ্গে সেগুলো মেলানোর জন্য তাদের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রয়েছে।

এখনকার সুন্দর ডিজাইনের প্যাটার্নগুলো মোটামুটি দুই বছর আগে থেকে জনপ্রিয় হতে শুরু করে বলে জানান চঞ্চল। 'এগুলো শখের ঘর। আমি মিরপুরে একজন কাস্টমারের জন্য এরকম একটা ঘর বানিয়েছি। আরেকটা বড় ঘর নড়াইল যাচ্ছে। আমাদের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত কাস্টমার আছে,' বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ভ্লগাররা সব সময় তাদের কাজের প্রচার করতে আসে। 'শেষবার একজন ভ্লগার আসার পর আমার মহাজন সৌদি আরব থেকে [একজন বাংলাদেশী অভিবাসীর কাছ থেকে] অর্ডারের জন্য কল পেয়েছিলেন।'

ছবি: নূর-এ-আলম

তিনি বলেন, 'আমরা এখানে শুরুতে কিছুটা আলগাভাবে এগুলো তৈরি করি। কোনো গ্রাহক সেগুলো কেনার পর তখন সব অংশ খুলে জায়গামতো নেওয়া হয়। তারপর আমরা সেখানে ঘরটি আবার সেট করি,' তিনি বলেন।

তিনি জানান তাদের তৈরি করা ঘরগুলো প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি হবে। 'আমরা এক মাসে এটি তৈরি করেছি। মহাজন এটির জন্য আমাদেরকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। ছয়জন কারিগর এ ঘরটি বানাতে কাজ করেছেন।'

এসব ঘরে বাস করা অনেক স্থানীয়দের কাছে এগুলোর সবচেয়ে পছন্দের দিকটি জানতে চেয়েছিলাম।

তাদের দেওয়া বিভিন্ন যুক্তির মধ্যে ছিল বহনযোগ্যতা, সহজ প্রতিস্থাপনসুবিধা, স্থায়িত্ব, খোলামেলা এবং সহজ বায়ুচলাচল ব্যবস্থা।

এ ধরনের ঘরের মালিকদের একজন অপু বলেন, 'আমি ১৫ বছর ধরে একটি রেডিমেড ঘরে বাস করছি। জমি বিক্রি করে একবার অন্য জায়গায় গিয়েছিলাম, ঘরটাকে খুলে নিয়ে নতুন জায়গায় বসিয়ে দিয়েছি। একটি কাঠও নষ্ট হয়নি বা হারায়নি।'

কাদির নামক আরেকজন বলেন, ঘরগুলোতে বাতাস চলাচল ভালো। ভেতের পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢোকে।

ছবি: নূর-এ-আলম

আব্দুল খালেক নিজে এ ধরনের ঘরে সারাজীবন বাস করেছেন। তার বাবা-মা এবং দাদা-দাদীকেও এসব ঘরে থাকতে দেখেছেন।

একই বাজেটে যখন কংক্রিটের বাড়ি তৈরি করা যায়, তাহলে মানুষ কেন এসব ঘর কেনেন? খালেকের কাছে জানতে চাই।

'কারণ মানুষের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা থাকে। ধরুন আপনার জরুরি অর্থের প্রয়োজন, আপনি এ ঘরগুলো বিভিন্ন খুচরা অংশে বিক্রি করতে পারেন, হয়ত কিছুটা লোকসানে। কিন্তু কংক্রিটের বাড়ি তৈরি করলে তার সঙ্গে আপনার জমিও চলে যাচ্ছে। একটা বিল্ডিং ভাঙলে কেবল সুরকি বা ইট-ধুলা পাওয়া যায়,' খালেকের কথায় এ ধরনের ঘরে বাস করা মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গ্রামবাসীদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠল।

'এ ঘরগুলো ভবনের চেয়ে আরামদায়ক এবং শীতল... কারণ এগুলোতে বাতাস বেশি ঢোকে। আপনার-আমার গ্যারান্টি নাই তবে এই নাইজেরিয়ান কাঠের ঘরগুলোর ১০০ বছরের গ্যারান্টি আছে,' খালেক বলেন।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.