‘এক টাকা’র শিক্ষার আলো
ফিচার
এক টাকার মূল্য একেক জনের কাছে একেক রকম। কয়েকশ বছরের ব্যবধানে এই টাকার মূল্যে ঘটেছে আকাশ পাতাল তফাত। সাড়ে তিনশ বছর আগে শায়েস্তা খাঁর আমলে ১ টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া গেলেও বর্তমান বাজারমূল্যে ১ টাকায় ছোট্ট চকলেট পাওয়াও খানিকটা কষ্টসাধ্যই বটে। টাকার মান কমে যাওয়ায় এক টাকার মূল্য হয়তো কমেছে; কিন্তু এই ১ টাকাই যদি শিক্ষার আলো জ্বালাতে পারে, তাহলে কেমন হয়?
এক টাকায় দেশজুড়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ২০১৭ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে 'এক টাকায় শিক্ষা'। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী শিক্ষাকে সমাজের সর্বস্তরে উন্মুক্ত করতে শুরু করে এই কার্যক্রম। নেপথ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোহাম্মদ রিজুয়ান। এক টাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার মশাল জ্বালাতে ষোলশহরের ছোট একটি কক্ষ থেকে শুরু হয় পথচলা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যয়নরত মোহাম্মদ রিজুয়ান বর্তমানে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও চট্টগ্রাম শহরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার পথে ফিরিয়ে আনতে শুরু করা হয়েছিল এক টাকায় শিক্ষা-র কর্মযজ্ঞ। লক্ষ্য, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান ও শিক্ষার সরঞ্জাম সরবরাহ করা। তবে বর্তমানে সেই উদ্যোগটি কেবল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং ডালপালা মেলেছে প্রচুর। শুরুটা পথশিশুদের দিয়ে হলেও বর্তমানে স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের যেকোনো সমস্যায় সর্বাগ্রে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এক টাকায় শিক্ষা।
'গিভ ওয়ান টাকা ডেইলি, চেঞ্জ বাংলাদেশ গ্র্যাজুয়ালি'-কে প্রতিপাদ্য করে সূচনা হয়েছে এক টাকায় শিক্ষা-র উদ্যোগ। অর্থাৎ প্রতিদিন ১ টাকার বিনিময়ে দেশকে বদলে দেওয়ার প্রবল প্রতিজ্ঞাই এখন মুখ্য।
যেভাবে শুরু 'এক টাকায় শিক্ষা'
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে পরিচিত এক টাকায় শিক্ষা-র পদযাত্রা শুরু হয়েছিলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষার্থীর হাত ধরে। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, যেসব শিশুরা ভিক্ষা করে তাদেরকে শিক্ষার আলোতে নিয়ে আসা। মৌলিক অধিকার শিক্ষাকে পথশিশুদের হাতে তুলে দিয়ে তাদেরকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনায় সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও নতুন কিছু করার সদিচ্ছায় মোহাম্মদ রিজুয়ান তার বন্ধুদের নিয়ে শুরু করে এমন উদ্যোগ।
রিজুয়ান বলেন, '২০১৭ সালে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেসময় একটি শিশু আমাদের কাছে এসে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য টাকা চায়। তখন আমি চিন্তা করি, এখন শিশুটিকে যদি আমরা টাকা দেই তাহলে সে হয়তো দুপুরের খাবার খেতে পারবে, কিন্তু রাতের খাবার বা পরেরদিনের খাবারের জন্য আবার কারো না কারো কাছে হাত পাতবে। একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওকে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে তখন মনে হলো, আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে। যার মাধ্যমে আমরা এই শিশুদের উন্নত জীবন দিতে পারি। সেই চিন্তা থেকেই এক টাকায় শিক্ষার পরিকল্পনা শুরু হয়।'
পরিকল্পনার কথা বন্ধুদের জানালে তারাও সানন্দে রাজি হয়ে যায়। অতঃপর ২০১৭ সালের জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এক টাকায় শিক্ষা। কিন্তু উদ্যোগ শুরু করলেই তো চলবে না, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন অর্থ। প্রথম অবস্থায় ঠিক করলেন নিজেরাই প্রতিদিন এক টাকা করে জমা রাখবেন। কিন্তু ২২ জনের অর্থে পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করা ছিল কার্যত অসম্ভব ব্যাপার।
'বিন্দু থেকে সিন্ধু' কথাটিতে প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন রিজুয়ান। তাই এই উদ্যোগ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সবার মধ্যে। রিজুয়ানের ভাবনা, প্রতিদিন যদি ১০০ জনও ১ টাকা করে দেয় তবে তা মাস শেষে ৩ হাজার টাকায় দাঁড়াবে। আর এই উদ্যোগে প্রতিদিন ১ হাজার মানুষকে যুক্ত করতে পারলে দিন শেষে হাজার টাকা এবং মাস শেষে ৩০ হাজার টাকা তারা সংগ্রহ করতে পারবে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে যেটি আসলে তৈরি করবে বড় অবলম্বন।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। একজন থেকে হাজারজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এবার রিজুয়ান দ্বারস্থ হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের। ফেসবুকে 'এক টাকায় শিক্ষা' নামক গ্রুপ খুলে সবাইকে জানান নিজেদের পরিকল্পনার কথা। সময় যত পেরোতে থাকে, মানুষের আগ্রহও তত বাড়তে থাকে। এভাবেই শুরু হয় এক টাকায় শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার নতুন বিপ্লব।
'এক টাকায় শিক্ষা' লেনদেনের আদ্যোপান্ত
২০১৭ সালে চট্টগ্রামের ষোলশহরের রেলস্টেশন এলাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল এক টাকায় শিক্ষা-র কার্যক্রম। সেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানো হতো। সপ্তাহ হিসেবে ভাগ করে একেকদিন একেকজন গিয়ে নিতেন ক্লাস। ষোলশহরে সফলতা পাওয়ার পর চট্টগ্রামের জিরো পয়েন্টে শুরু হয় একই কার্যক্রম। পাশাপাশি চলতে থাকে চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষা উপকরণ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ।
এখানে প্রশ্ন উঠে আসে, এক টাকায় শিক্ষা কি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করে থাকে? রিজুয়ানের উত্তর, সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা যারা স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে কিংবা পায়নি, তাদের শিক্ষা প্রদানের কাজ করে এক টাকায় শিক্ষা। সপ্তাহে চারদিন প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়ায় তারা।
এরপর থেকে এক টাকায় শিক্ষা-র চলার পথ আর থেমে থাকেনি। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশাপাশি প্রতিবছর ঈদ ইভেন্ট, শীত বস্ত্র ইভেন্ট, ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে সংগঠনটি। এর মধ্যে এক টাকায় শিক্ষা ২০২০ সালে সম্পন্ন করে রেজিস্ট্রার অফ জয়েন স্টক কোম্পানিস অ্যান্ড ফার্মের অধীনে রেজিস্ট্রেশনের কাজ।
২০২১ সালে নতুন মোড় আসে সংগঠনের কার্যক্রমে। নিজেদের প্রতিপাদ্যকে স্মরণে রেখে তারা বিকাশের সাবস্ক্রিপশন মেথডের মাধ্যমে অর্থ আদানপ্রদানের বিষয়টি এক টাকায় শিক্ষা-র ওয়েবসাইটে অটোমেটেড করে দেয়। এর মাধ্যমে কে কত টাকা দিয়েছে এবং সর্বশেষ কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তার পুঙ্ক্ষানুপুঙ্খ হিসাব ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত থাকছে। যে কেউ চাইলেই ওয়েবসাইটে চোখ বুলিয়ে দেখতে পারবেন তাদের লেনদেনের আদ্যোপান্ত।
রিজুয়ান বলেন, 'বাংলাদেশে সংগঠন হিসেবে প্রথম আমরা ওয়েবসাইটে অটোমেটশনের বিষয়টি চালু করি। পরে হয়তো আরও কিছু সংগঠন এটি শুরু করেছে। অটোমেটেড কার্যক্রম শুরু করার পর প্রাপ্ত ডোনেশন সরাসরি ওয়েবসাইটে চলে আসছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোন খাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে তার হিসাব আমরা উল্লেখ করছি।'
শিক্ষার্থীদের সহায়তাই মুখ্য 'এক টাকায় শিক্ষা'য়
২২ জন থেকে শুরু হওয়া 'এক টাকায় শিক্ষা' সংগঠনে বর্তমানে ১২ শতাধিক শুভাকাঙ্ক্ষী যুক্ত আছেন। যারা নিয়ম করে প্রতি মাসে সংগঠনে অর্থ প্রদান করে থাকেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হলেও পরিধি বড় হওয়ার পর ক্লাস নেওয়ার জন্য দুজন ক্লাসরুম ইনচার্জ যুক্ত হয়েছেন তাদের সাথে। যাদেরকে প্রতিমাসে সম্মানি দেওয়া হয়।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও করোনা পরবর্তী সময়ে তারা অর্থাভাবে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা চালু করেছে। ধরা যাক, কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফি জমা দিতে পারছে না কিংবা অর্থাভাবে বই কিনতে পারছে না- তাদের জন্য এককালীন বৃত্তির ব্যবস্থা করে থাকে সংগঠনটি। এক্ষেত্রে যাদের বৃত্তির প্রয়োজন তারা প্রয়োজনীয় তথ্য সমেত এক টাকায় শিক্ষা-র কাছে আবেদন করলেই চলবে। যাচাই-বাছাইয়ের পর তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে থাকেন।
রিজুয়ান বলেন, 'কারো যদি সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে, তারা আমাদের পেজে গিয়ে আমাদের কাছে লিখিত আবেদন করলেই হবে। পাশাপাশি যে সহযোগিতাটি লাগবে সেটি তার ডকুমেন্ট দেখে আমরা নিশ্চিত করি। এরপর আমাদের পেজে একটা ফর্ম আছে, সেই ফর্ম পূরণ করতে হবে। পূরণ করতে না পারলে আমাদের সাহায্যকারী টিম তাদের সাহায্য করবে। সব যাচাইবাছাই শেষে আমরা ঠিক করি কত পরিমাণে টাকা আমরা তাকে দিতে পারবো।'
এক টাকায় শিক্ষা কোন শিক্ষার্থীকে কত টাকা দিয়ে সহায়তা করেছে তার হিসাবও ওয়েবসাইটে গেলে পাওয়া যাবে। বিগত ৬ বছরে সংগঠনটি স্কুলকেন্দ্রিক ৫০টির মতো ইভেন্টের আয়োজন করেছে এবং ৫ হাজার ৫০০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে সহায়তা করেছে। তাছাড়া চট্টগ্রামের পাশাপাশি কক্সবাজারের একটি স্কুলে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের প্রতিমাসে ৬০০ টাকা থেকে ২৪০০ টাকা পর্যন্ত বৃত্তি প্রদানের কাজও তারা করে থাকে।
স্বপ্ন এখন অনেক বড়
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে এক টাকায় শিক্ষা। সংগঠন শুরুর প্রাক্কালে নানারকমের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনারও মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাদের। অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রিজুয়ান বলেন, 'আমরা যখন পড়ানো শুরু করি, তখন প্রতি ক্লাসের ক্লাসরুম বাবদ ভাড়া ছিলো ১০০ টাকা। সেখানে আমরা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। যেদিন আমরা না যেতাম, সেদিনও রুমের মালিক টাকা চার্জ করে বসতেন। প্রশ্ন করলে বলতেন, আপনারা এভাবে তো ক্লাস নিতে পারেন না।'
এখন অবশ্য সেই সমস্যা নেই। সংগঠন বড় হওয়ার পাশাপাশি গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে অনেক গুণ। সমালোচনাকে সবসময় ইতিবাচকভাবেই দেখেন সংগঠনের কর্ণধার রিজুয়ান। এটিই তাদের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় বলে মনে করেন।
এক টাকায় শিক্ষা-র আলো পৌঁছে গেছে চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে বাংলাদেশের আরও ৫ টি জেলায়। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সাহায্যের লক্ষ্যে এক টাকায় আলোকিত ফেনী, এক টাকায় আলোকিত বরিশাল, এক টাকায় আলোকিত পটুয়াখালী, এক টাকায় আলোকিত কক্সবাজার এবং এক টাকায় আলোকিত নোয়াখালী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তারা। কাজের পরিচালনা চট্টগ্রাম থেকে হলেও দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় চালিয়ে যাচ্ছে কর্মকাণ্ড।
এক টাকায় শিক্ষা কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ২০২০ সালে 'জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড' অর্জন করে এই সংগঠনটি। তাছাড়া ২০২৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ডায়না অ্যাওয়ার্ডও আসে এক টাকায় শিক্ষা-র ঝুলিতে।
এক টাকায় শিক্ষা-র স্বপ্ন এখন অনেক বড়। তারা তৈরি করতে চান সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পরিপূর্ণ বিদ্যালয়। যেখানে কেবল সুবিধাবঞ্চিতরাই পড়াশোনা করবে। এই লক্ষ্য নিয়েই এখন এগিয়ে যাচ্ছে এক টাকায় শিক্ষা।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.