পিংক কোকেন: কিছুই না! তবু স্পেনের এক ব্যয়বহুল ‘ট্রেন্ডি’ মাদক  

ফিচার

এল পাইস
29 August, 2023, 03:15 pm
Last modified: 29 August, 2023, 04:12 pm
তবে এই মাদক এখনও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি বলে জানিয়েছে স্প্যানিশ পুলিশ সূত্র।

গোলাপি রঙা দ্রব্যটির গন্ধ কখনো কখনো স্ট্রবেরির মতো---স্পেনে এর বিভিন্ন নামে পরিচয় রয়েছে যেমন, তুসিবি, তুসি, পিংক পাউডার। তবে বেশিরভাগই একে 'পিংক কোকেন' নামে চেনে যা বর্তমানে বিত্তশালীদের জন্য একটি বিলাসবহুল মাদকদ্রব্য হিসাবে বিবেচিত হয়। এক গ্রাম পিংক কোকেনের দাম ছাড়িয়ে যায় ৮০, ৯০ কিংবা ১০০ ডলারও।

অন্যদিকে স্প্যানিশ অবজারভেটরি অন ড্রাগস অ্যান্ড অ্যাডিকশনস-এর চলতি বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, একই পরিমাণ সাধারণ কোকেনের দাম ৬০ ডলারের কাছাকাছি।

অথচ এই পিংক কোকেন আদতে নাকি কোকেনই না; নয় কোনো বিলাসী দ্রব্যও!

২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে স্পেনে মাদকদ্রব্যের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতে কাজ করা সংস্থা, 'এনার্জি কন্ট্রোল' পিংক কোকেনের ১৫০টি নমুনা বিশ্লেষণ করেছে৷ প্রায় সবকটি নমুনাতেই রঞ্জক পদার্থ এবং মাত্র দুটিতে কোকেন পাওয়া গেছে। 

অধিকাংশ পিংক কোকেনই ছিল কয়েকটি সস্তা মাদকের ককটেল যার ৮৮% ছিল কিটামিন, এমডিএমএ (এক্সট্যাসি) এবং ক্যাফেইন।

ছবি-সংগৃহীত

মাদ্রিদের এনার্জি কন্ট্রোলের সমন্বয়ক বার্টা দে লা ভেগা বলেন, "গোলাপী কোকেনের রহস্য উদঘাটন করা দরকার। দিন শেষে, এটা নিছকই একটা ব্যবসা, যা ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে। একে অতিরঞ্জিত করে বিক্রি করা হচ্ছে।"  

এক গ্রাম এমডিএমএ'র মূল্য কমবেশি ৪০ ইউরো (৪২ ডলার); কিটামিনের দাম পড়বে ২০ থেকে ৩৫ ইউরো (২১ থেকে ৩৭ ডলারের মধ্যে), আর ক্যাফেইন পাউডার তো মোটামুটি সস্তায় অনলাইনে কেনা যায়।

"আপনি এসব একটু একটু করে মেশান, গোলাপি রঙ যোগ করুন, সাথে একটু স্ট্রবেরির ঘ্রাণ, এরপর একে ১০০ ইউরোর বিনিময়ে বেঁচে দিন…এসব দ্রব্যাদি কিনে নিজে মেশানোই সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ", যোগ করেন দে লা ভেগা।

গত গ্রীষ্মে এনার্জি কন্ট্রোল 'তুসি: নো হোয়াট ইউ আর টেকিং' (আপনি কী গ্রহণ করছেন, তা জানুন) নামে একটি ক্যাম্পেইন চালু করে; এটি ছিলো মাদক কেনা বা গ্রহণের আগে এর ঝুঁকি এবং উপাদান সম্পর্কে ভোক্তার সচেতনতা বাড়ানোর একটি উদ্যোগ।

সংস্থাটি যে নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করেছে তার মধ্যে কয়েকটিতে অ্যাসিটিল সালিসাইলিক অ্যাসিডের চূর্ণ, এমনকি সাধারণ অ্যাসপিরিনও পাওয়া যায়।

দে লা ভেগা সতর্ক করে বলেন, "কেউ যদি না-ই জানে যে সে আসলে কী গ্রহণ করছে, তাহলে তার প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন।"

তুসি তথা পিংক কোকেনের ক্ষেত্রে মিশ্রণে থাকা বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি পদার্থগুলোর অনুপাতের ওপরও ঝুঁকি নির্ভর করে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তি অ্যালকোহলের সাথে এমন পিংক কোকেন সেবন করেন যাতে উচ্চমাত্রায় কিটামিন কন্টেন্ট রয়েছে, তাহলে এই দুই উপাদানেরই 'ডিপ্রেস্যান্ট ইফেক্ট' বর্ধিত হবে; যা ব্যক্তির মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অবসাদ বাড়িয়ে তুলবে, এমনকি ব্যক্তি সংজ্ঞাও হারাতে পারেন।

স্পেনের ইবিজায় জব্দ করা পিংক কোকেন ও অন্যান্য মাদকের প্যাকেট সহ স্প্যানিশ সিভিল গার্ড অফিসাররা

আবার যদি প্রধান উপাদান হয় এক্সট্যাসি, তাহলে অ্যালকোহলের সাথে এটি গ্রহণে পানিশূন্যতা দেখা দিবে এবং হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়বে।

মাদ্রিদের তরুণ ইগনাসিও (২৫) জানান, তাকে কখনো গ্রামপ্রতি ৯০ ইউরো ব্যয় করে তুসি কিনতে হয়নি। বরং প্রতিবার বন্ধুরাই তাকে দিয়েছে। ইগনাসিও'র প্রথমে পিংক কোকেন নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তিনি শুধু জানতেন, একে বলা হয় মাদকের 'পটপউরি'।

পরিচিত কোকেন সেবনকারীদের কাছে জানতে চেয়ে ইগনাস উত্তর পান যে, প্রতিবারের পিংক কোকেন ছিলো 'আলাদা'।

"কে জানে এতে কী রয়েছে বা এটি কী দিয়ে তৈরি, একমাত্র এর রঙটাই ধ্রুবক।"

তবে মাদকটি বরাবরই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ইগনাসিও জানান, উচ্চমূল্যের কারণে তিনি সচরাচর পিংক কোকেন দেখেন না। তাই বলে শুধু যে, স্বচ্ছলদের মধ্যেই এই মাদকদ্রব্যের আনাগোনা সেটি এই তরুণ মনে করেন না।

বহু ইলেকট্রনিক মিউজিক ভেন্যু, বিশেষ করে উৎসব বা বড় ক্লাবে অন্যান্য মাদকের সাথে তিনি পিংক কোকেনও দেখতে পেয়েছেন বলে জানান।

কয়েক বছর আগেও তিনি এই মাদক দেখেন নি কোথাও, অথচ গত কয়েক মাসে একাধিক পার্টিতে তিনি এর খোঁজ পেয়েছেন। তবে একে 'ট্রেন্ডি' বলতে নারাজ এই স্প্যানিশ।

ইগনাসিওর বন্ধুদের পিংক কোকেন সংগ্রহে বেগ পেতে হয়নি। তারা এটি 'সাধারণ ডিলারদের' কাছ থেকেই কেনে, যারা তুসি সহ নানান মাদকের বিকিকিনি করে থাকে।

স্পেনের ন্যাশনাল পুলিশ সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত স্বল্প পরিমাণেই পিংক কোকেন জব্দ করা হয়েছে। এই মাদক কখনো পৃথকভাবে বিক্রি করা হয় আবার কখনো কোকেন, হাশিস বা হেরোইনের মতো অন্যান্য মাদকের স্তুপের সাথে এটির সেবন করা হয়।

তবে এই মাদকের পাচার এখনও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি বলে জানায় সূত্র।

মার্চে স্প্যানিশ পুলিশ একটি দলকে পাকড়াও করে যারা দেশটির দক্ষিণে এবং রাজধানী মাদ্রিদে বিতরণের উদ্দেশ্যে পিংক আর হোয়াইট কোকেন পাচার করছিল।

মাদকগুলো বিমানে পরিবহন করা হয়েছিল এবং স্যুটকেসের মাধ্যমে ল্যাটিন আমেরিকা থেকে স্পেনের অ্যাডলফো সুয়ারেজ মাদ্রিদ-বারাজাস বিমানবন্দরে পৌঁছেছিল।

এ ঘটনায় কর্তৃপক্ষ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে এবং বারাজাস বিমানবন্দরে স্যুটকেসে লুকানো ২৪ কিলো (প্রায় ৫৩ পাউন্ড) কোকেন আর এক লাখ ২০ হাজার ইউরো (প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার ডলার) উদ্ধার করে।

তুসি বিভিন্নভাবে খরিদ করা যায়। একটি সাধারণ পদ্ধতি হলো 'টেলিকোক'- এই প্রক্রিয়ায় আপনি পরিমাণ উল্লেখ করে একটি বার্তা পাঠান। মূল্য পরিশোধ করার পর পিংক কোকেন সরাসরি আপনার বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

কিন্তু এমনও অনেকে আছে যারা পিংক কোকেনের নামে অন্য দ্রব্য বিক্রি করেন! এর রঙ এবং দাম একই থাকলেও প্রচলিত পিংক কোকেনের চেয়ে এটি পৃথক হয়। 

ছবি-সংগৃহীত

দ্বিতীয় ধরনের এই কোকেন সাইকেডেলিক ফেনিথাইলামিন ফ্যামিলির অন্তর্গত। ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আলেকজান্ডার শালগিন প্রথম এটি উৎপন্ন করেন। এ মাদক অনেকটাই এলএসডি ও এক্সস্ট্যাসির মতো তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং কম উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। একে 'নেক্সাস' বা 'ট্রিপি পিল' হিসাবেও উল্লেখ করা হয়।  

"দুটির মধ্যে পার্থক্য করা খুব জরুরি। মিডিয়া তুসি এবং টু-সিবি শব্দগুলোকে একই অর্থে ব্যবহার করছে। অথচ তারা এক নয়, টু-সিবি তো পুরাই আলাদা একটি দ্রব্য (সাবস্ট্যান্স)", বলেন দে লা ভেগা। 

প্রক্রিয়াগতভাবেও তুসি আর টু-সিবির মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে।

দে লা ভেগা বলেন, "প্রথমটি বাড়িতেই তৈরি সম্ভব, কিন্তু দ্বিতীয়টি আরও জটিল। এর জন্য অ্যাডিশনাল তথা অতিরিক্ত উপকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রিএজেন্টস সম্পর্কে জ্ঞান রাখা আবশ্যক—যা সবাই পারবেনা।"

'এনার্জি কন্ট্রোলে'র এই সমন্বয়ক বলেন, কাস্টমাররা একটির সাথে অন্য উপাদানকে মিলিয়ে ফেলে আর এটারই সুযোগ নেয় মাদক বিক্রেতারা। তারা সবকিছুরই উচ্চমূল্য রাখে।

তবে স্পেনের সিভিল পুলিশ ড্রাগ অ্যানালাইসিস গ্রুপের মারিয়া এলেনা কগোলোর ভাষ্যে, এই মাদকের ব্যবহার এখনও 'সমস্যাপূর্ণ 'হয়ে উঠেনি। মূলত ইলেকট্রনিক মিউজিক ভেন্যু, নাইটক্লাব আর পার্টিগুলোতেই এর পসার; মাদ্রিদ, লেভান্ট এবং বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে রয়েছে পিংক কোকেনের বহুল ব্যবহার।  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.