বিস্ময়ের আধার, সব কাজের কাজি, সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ঘাস উপকারী বাঁশ
ফিচার
বাঁশ একটি ঘাস—দৈত্যাকার হলেও এটি এখনও ঘাস গোত্রেরই (Poaceae) ভেষজ উদ্ভিদ। এর কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই যেমন, কিছু প্রজাতির বাঁশ একদিনে ৭০ সেন্টিমিটার (২৭.৫ ইঞ্চি) থেকে ১ মিটার (৩৯.৩ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়। বাঁশ অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড ধারণ করতে সক্ষম। এ উদ্ভিদে গড়ে প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ বছরে একবার ফুল ফোটে এবং ফুল ফোটার পরপরই বাঁশ মারা যায়। বাঁশের শেকড় ১০০ সেন্টিমিটারের (৩৯.৩ ইঞ্চি) বেশি গভীরে যায় না, যদিও এর ডালপালার উচ্চতা মাত্র তিন বছরে (পরিপক্ক হওয়ার পর) ২৫ মিটার (৮২.০২ ফুট) ছাড়িয়ে যেতে পারে। এবং বাঁশ নিজে তিন বর্গমিটারের বেশি জায়গা দখল না করলেও নিজের চেয়ে ৬০ গুণ পর্যন্ত বড় এলাকায় ছায়া দিতে পারে।
স্পেনের সেভিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জীববিজ্ঞানী ম্যানুয়েল ট্রিলো ও আন্তোনিও ভেগা-রিওহা ইউরোপের প্রথম 'অ-আক্রমণকারী' (নন-ইনভেসিভ) বাঁশের নার্সারি তৈরি করেছেন। বাঁশের উপকারিতা সম্পর্কে জানাতে ও সেসব প্রয়োগ করতে গবেষণা করছেন তারা।
বাঁশের তৈরি হোটেল, বাড়ি, স্কুল, সেতু চোখে পড়ে অহরহই। বাঁশ হলো বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ঘাস। উদ্ভিদটি খাদ্য, অক্সিজেন ও ছায়া দেয়। এছাড়া গড় তাপমাত্রাও অনেক বেশি কমাতে সক্ষম।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাঁশের ওপর 'আক্রমণাত্মক' প্রজাতির মিথ্যে দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বাঁশের চিহ্নিত ১,৫০০-রও বেশি প্রজাতির মধ্যে মাত্র ২০টি প্রজাতি আক্রমণাত্মক হিসেবে স্বীকৃত, তা-ও অল্প কয়েকটি অঞ্চলে।
ভেগা-রিওহা বলেন, স্রেফ কুসংস্কারের কারণে মানুষ বাঁশকে আক্রমণাত্মক মনে করে।
ভেগা-রিওহার বাবা পেশায় টেকনিক্যাল আর্কিটেক্ট ছিলেন। তিনি বাঁশের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ছেলের কাছে নিজের বাঁশপ্রীতির কথা তুলে ধরেন তিনি। এরপর ম্যানুয়েল ট্রিলোর সঙ্গে মিলে ভেগা-রিওহা একটি পরিবেশগত বোটানিকাল ল্যাবরেটরি তৈরি করেন। উদ্দেশ্য, সাজসজ্জা, শিল্প ও বায়োক্লাইমেটিক কাজে বাঁশের উপযোগিতা সবাইকে জানানো। এভাবেই তাদের হাতে গড়ে উঠেছে ইউরোপের প্রথম অ-আক্রমণাত্মক বাঁশের নার্সারি লা বাম্বুসেরিয়া।
ভেগা-রিওহা এল পাইসকে বলেন, 'আমরা ১০ হাজার বীজ সংগ্রহ করেছি। এগুলোর মধ্যে সাড়ে ৭ হাজার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। এদের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে প্রায় ৪০০টি নির্বাচন করেছি।'
ভেগা-রিওহা ও ট্রিলো মিলে বাঁশের সংকরায়নের জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। দুনিয়াজুড়ে অনন্য সব বীজ সংগ্রহ করছেন। এসব বীজের একেকটির দাম ১০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। তারা এখন ২০০ জাতের বাঁশসংবলিত নার্সারি তৈরির জন্য বীজ সংগ্রহ করছেন।
এক হেক্টর আয়তনের বোটানিক্যাল ল্যাবরেটরিতে গেলেই চোখে পড়বে বিভিন্ন জলবায়ু অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ। কিছু প্রজাতি শূন্যের নিচে ১২ (–১২) ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রায়ও বেঁচে থাকতে পারে। আবার কিছু প্রজাতির বাঁশ মরুভূমিতেও টিকে থাকতে পারে। বোটানিক্যাল ল্যাবরেটরিতে প্রবেশের রাস্তায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু নার্সারিতে তাপমাত্রা ২৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
নার্সারিতে আস্তানা গেড়েছে হরেক প্রজাতির পাখি। তবে ভেতরে হাজারো পাখির কুজন চললেও বাইরে থেকে সেই হই-হল্লার আওয়াজে কারও বিরক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ শব্দনিরোধী পর্দা হিসেবে বাঁশের উপযোগিতা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত। গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁশ একটি আদর্শ শব্দ শোষণকারী উপাদান।
এই ভেষজ দৈত্যের সম্ভাবনা প্রচুর। বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন অনুসারে, পান্ডাদের প্রধান খাদ্য বাঁশ সেই আদিমকাল থেকেই মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে রয়েছে।
আদিমকাল থেকে মানবজীবনে বাঁশের উপস্থিতির কারণ, এটি যেমন খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তেমনি এর গঠনও অনন্য। সব ধরনের নির্মাণকাজে বাঁশ ব্যবহার করা হয়ে আসছে। বাঁশ ব্যবহারের কারণে পরিবহনে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শক্তি বাঁচানো গেছে। এই অসাধারণ কিন্তু সরল সরঞ্জামটি ব্যবহারকারীর শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিতে পারে।
জিসিবি বায়োএনার্জি-তে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশের জন্য মূল্যবান সম্পদ হতে পারে বাঁশ। হাঙ্গেরিয়ান ইউনিভার্সিটি অভ এগ্রিকালচার অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস-এর ঝিওয়েই লিয়াং বলেন, বাঁশ থেকে মূলত বায়োইথানল ও বায়োচার সংগ্রহ করা যেতে পারে। বায়োচার হলো উদ্ভিদ থেকে তৈরি জৈবপদার্থ দিয়ে বানানো কাঠকয়লা—পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সরাতে এটি মাটিতে সংরক্ষণ করা হয়।
বাঁশের এই বৈচিত্র্যের চাবিকাঠি নিহিত এর ফাঁপা সিলিন্ডারের মতো ফাইবারগুলোর স্থানিক বণ্টনের মধ্যে। হোক্কাইদো ইউনিভার্সিটির গবেষক মোতোহিরো সাতো বলেন, বাঁশের হালকা ওজন ও মজবুত গড়ন নকল করে নানা পণ্য তৈরিতে সাফল্য এসেছে। এছাড়া বাঁশের জলবাহী ঝিল্লি একদল গবেষককে আরও দক্ষ ইলেক্ট্রোড তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করেছে। এ ইলেক্ট্রোড রিচার্জের গতি বাড়াতে পারে।
বাঁশের ব্যবহার ব্যাপক। বায়োডিগ্রেডেবল (পচনশীল) রান্নাঘরের জিনিসপত্র উৎপাদন থেকে শুরু করে সাইকেল বা আসবাবপত্র তৈরি করা পর্যন্ত নির্মাণের প্রায় সব শাখাতেই বাঁশের ব্যবহার রয়েছে।
বাঁশের একটি তাৎক্ষণিক উপকারিতা হচ্ছে এটি কীট-প্রতিরোধী, ছায়াময়, সবুজ স্থান তৈরি করে—ওই এলাকার কোনো ক্ষতি না করেই। এছাড়া বাঁশ লাগাতে মাটির ব্যবহারও একেবারেই কম করতে হয়।
এছাড়া বাঁশের ঘর ভূমিকম্প সহনীয়। জাপানে প্রচুর বাঁশের ঘর দেখা যায়। বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ বাঁশের ঘরে বসবাস করে।
হাইওয়ের আশপাশের জায়গা, স্কুলপ্রাঙ্গণ, শিল্প এস্টেট, ছায়াবিহীন চত্বর, ঘরোয়া বেড়া কিংবা বৃক্ষহীন এলাকায় বাঁশ লাগানো যেতে পারে। না, দেশীয় উদ্ভিদের বিকল্প হিসেবে বাঁশ লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছেন না ভেগা-রিওহা ও ট্রিলো। তাদের মতে, দ্রুততম সময়ে বৃক্ষের আচ্ছাদন প্রয়োজন, এমন জায়গাগুলোতে তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ঘাস বাঁশ লাগানো যেতে পারে।
বাঁশ সর্বোচ্চ পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। এর অক্সিজেন সরবরাহ করার সক্ষমতা ৩৫ শতাংশ বেশি। এবং তীব্র আবহাওয়ায় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে।
বাঁশ দিয়ে এমন অবকাঠামোও বানানো সম্ভব যা কয়েকশ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে সক্ষম। বাঁশ দিয়ে তৈরি অবকাঠামোতে প্রতি বর্গমিটারে খরচ অনেক কম হয়। এছাড়া প্রথম তিন বছর পানি বেশি শোষণ করলেও এরপর তা অনেক কমে আসে।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.