সত্যজিৎ রায় এখানে কখনো আসেননি, আসতে চান সন্দীপ রায়
ফিচার
জৈষ্ঠ্যের আগুন রোদে পুড়ে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে সকাল গড়িয়ে বেলা দ্বিপ্রহর। মসূয়া বাজারের শেষ প্রান্তে বিখ্যাত জমিদার বাড়ির সামনের রাস্তায় সিএনজি থামলো। রাস্তার একপাশে বাউন্ডারি দেওয়া বিশাল মাঠ, অন্যপাশে ঘাট বাঁধানো মস্ত পুকুর। সে পুকুরের পানি অবশ্য তলায় গিয়ে ঠেকেছে। ডালপালা ছড়ানো রেইনট্রি গাছের ছায়ার নিচে ঘাটের সিঁড়িতে বসে আড্ডারত গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা। তাদের কাছেই জানা গেলো জমিদার আমলে পুকুরে হাতি গোসল করানো হত বলে এর নাম ছিল 'হাতি পুকুর'। বাউন্ডারি পেরিয়ে জমিদার বাড়ির সীমানায় ঢোকার মুখে দুই পাশে প্রহরীর মতো দাড়িয়ে আছে সুউচ্চ দেবদারু গাছ। জনশ্রুতি শুনলাম গাছগুলো দু'শো বছরের পুরোনো।
বাউন্ডারির ভেতর ঢুকতেই বা'পাশে চোখে পড়লো মসূয়া বাইতুল আমান কাচারী জামে মসজিদ। বিশাল মাঠ পেড়িয়ে এগিয়ে দেখা মেলে জরাজীর্ণ ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে থাকা মসূয়া জমিদার বাড়ির অবশিষ্টাংশের। বাড়ির সামনেই বেখাপ্পা এক কালো সাইনবোর্ডে লেখা 'অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি'।
ছাদহীন একটা দোতলা বাড়ি। চারপাশের পিলারগুলোতে ভর করে কোনোরকম টিকে আছে। দরজার পাল্লা নেই একটাও। ছাদের কার্নিশের নিচে টেরাকোটার কারুকার্য এখনো দৃশ্যমান। বাড়ির পেছনে নড়বড়ে সিঁড়ির বেহাল দশায় নিষিদ্ধ হয়েছে দোতলায় যাওয়া। ছাদের দেয়াল জড়িয়ে আছে পুরোনো শেকড়ের জঞ্জাল। কিছুদিন আগেও পুরো দালান ছেয়ে ছিল গাছপালার জঙ্গল। এটি ছিল মূলত জমিদার বাড়ির ঠাকুর ঘর। প্রায় ৪.৩ একর জায়গা জুড়ে থাকা জমিদার বাড়ির অধিকাংশই বিলীন হয়েছে কালের গর্ভে।
আঙিনা জুড়ে স্তূপ করে রাখা লাল ইটের গুঁড়া। বাড়িটির সংস্কার কাজ চলছে। ডানপাশে জমিদার বাড়ির কাছারি ঘরে স্থাপিত হয়েছে মসূয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস। বাড়ির পেছনে বামপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া ছামেদ ফকির সাহেবের মাজার।
ভাঙা বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছিল মমতাজের গানের আওয়াজ। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম রাজমিস্ত্রিরা কাজ করছেন। খুব সন্তপর্ণে চলছে পুরোনো ইট খুলে নতুন ইট বাঁধানোর কাজ। রাজমিস্ত্রী চান মিয়া জানালেন, পুরোনো ইটগুলো বেশিরভাগই ব্যবহারের অযোগ্য। যেগুলো এখনো ব্যবহারযোগ্য আছে সেগুলো নতুন করে বসানো হবে। আগের ইটগুলোর মতো করেই নতুন ইট বানিয়ে আনা হয়েছে। গত মে মাসে শুরু হয়েছে এই সংস্কার কাজ।
সত্যজিৎ রায়কে কতটুকু চেনে মসূয়া গ্রামবাসী?
বাড়ির সামনের সাইনবোর্ডে বা গণমাধ্যমে সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি নামে পরিচিত হলেও, অধিকাংশ গ্রামবাসী বাড়িটিকে চেনেন মসূয়া জমিদার বাড়ি হিসেবেই। সত্যজিতের নাম তারা পর্যটকদের মুখেই শুনেছেন বেশি।
মসূয়ার জমিদার ছিলেন হরিকিশোর রায়চৌধুরী। তার পালকপুত্র উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র সুকুমার রায়ের সন্তান সত্যজিৎ রায়। দেশভাগের পর একবার ঢাকায় আসলেও কখনো এ বাড়িতে আসেননি তিনি। গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে তাই জমিদার হরিকিশোর আর উপেন্দ্রকিশোরের গল্প যতটা পরিচিত, সত্যজিৎ রায় ততটাই অপরিচিত।
তবে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে গণ্যমান্য দর্শনার্থীদের দেখে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে নানান জল্পনাকল্পনা চলে গ্রামবাসীদের মধ্যে। জমিদার বাড়ির সামনেই দেখা হয়েছিল ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া তারিকুল ইসলামের সঙ্গে। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম সত্যজিৎ রায়কে চেনে কি না। তারিকুলের উত্তর, 'শুনছি সিনেমা বানাতো। কলকাতার নায়িকা কোয়েল মল্লিক নাকি তার বংশধর।'
আশেপাশের বাড়ির লোকজন জানালেন, সত্যজিতের নাম শুনেছেন অনেক বড় চলচ্চিত্র নির্মার্তা হিসেবে। কিন্তু কোনো সিনেমা দেখা হয়নি তার।
বছর দুয়েক আগে চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রসূন রহমান তার 'প্রিয় সত্যজিৎ' চলচ্চিত্রের শ্যুটিং করেছিলেন বাড়িটিতে। তিনি বলেন, 'গ্রামের বর্তমান বাসিন্দারা সত্যজিতের বংশের কাউকেই তো দেখেনি কখনো। তাই হয়তো খুব একটা ধারণা নেই। তবে আমার সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় তাদের খুব আগ্রহ ছিল। জমিদার বাড়িতে সিনেমাটির স্ক্রিনিং করারও আবদার করেছিলেন তারা। গ্রামের মানুষদের সত্যজিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে সেখানে একটা স্ক্রিনিং করার পরিকল্পনা আছে আমার।'
এ বাড়ির মাঠেই যাত্রা শুরু উপমহাদেশের ক্রিকেটের
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় ভাই সারদারঞ্জন রায় ছিলেন এই উপমহাদেশের ক্রিকেট খেলার অগ্রদূত। চার ভাই উপেন্দ্রকিশোর, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জনকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ক্রিকেট ক্লাব।
সারদারঞ্জনকে বলা হত 'বাংলার ডব্লিউ জি গ্রেস' (কিংবদন্তি ব্রিটিশ ক্রিকেটার)। মসূয়া গ্রামের এই জমিদার বাড়ির মাঠেই ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন তিনি। সে সময়ে ক্রিকেট শুধু অভিজাতদের খেলা ছিল। সারদারঞ্জনের হাত ধরেই ক্রিকেট হয়ে উঠেছিল বাংলার আমজনতার খেলা। ক্রিকেটের নিয়মকানুন নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বইটিও তার।
দু'শো বছর পুরনো মেলা এখনো বসে বাড়ির প্রাঙ্গণে
বৈশাখ মাসের শেষ বুধবারে কাল ভৈরবী পূজা উপলক্ষে জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী প্রচলন করেছিলেন সপ্তাহব্যাপী মেলার। দু'শো বছরের বেশি সময় ধরে এখনো প্রতিবছর একই সময় জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে আয়োজিত হচ্ছে এই মেলা। দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয় সেখানে।
মাঠ আর পুকুরপাড় জুড়ে বসে কয়েকশত দোকান। মাটি ও কাঠের হাড়ি-পাতিল, খেলনা, পুতুল, তৈজসপত্র, নাগরদোলা আর নানান ধরনের খাবারের পসরা সাজানো থাকে মেলায়।
গ্রামের কৃষক আলী হোসেন বলেন, 'ছোটবেলা থেইকা প্রতিবছর দেইখা আইতাছি এই মেলা। দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজন বেড়াইতে আসে মেলার সময়। মেলার সাতদিনই অনেক জমজমাট থাকে এলাকা।'
যেভাবে চলছে সংস্কারকাজ
জমিদার বাড়ির সংস্কার কাজ নিয়ে কথা হয় কটিয়াদীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খানজাদা শাহরিয়ার বিন মান্নানের সঙ্গে। তার ভাষ্যে, 'গেল তিন বছর ধরেই বাড়িটি সংস্কার নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। দ্রুত সংস্কার কাজ শুরু করার জন্য বারবার উপর মহলে যোগাযোগও করেছি। মাসখানেক আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তা এসেছিলেন। তখন থেকেই মূলত পুরোদমে সংস্কার কাজ শুরু হয়।'
ইউএনও জানান, ভবনের গায়ে উনিশ শতকের, বিশ শতকের ও একবিংশ শতকের মোট চার ধরনের ইট পাওয়া গেছে। যা থেকে বোঝা যায় নির্মাণের পর এখন পর্যন্ত প্রায় তিনবার বাড়িটির সংস্কার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু সে সবই ছিল অস্থায়ী সংস্কার। এবার বাড়িটির আসল কাঠামো ও নকশা ঠিক রেখে ছাদসহ পুরোটাই সংস্কার করা হবে স্থায়ীভাবে।
পুরাকীর্তি সংস্কারের কাজ আর দশটা বাড়ি সংস্কারের চেয়ে বেশ আলাদা বলে জানালেন নাটোর থেকে আসা রাজমিস্ত্রী চান মিয়া। এ কাজে তার দীর্ঘ ২০ বছরের অভিজ্ঞতা। নাটোরে রাজবাড়ি, রাজশাহীতে মন্দির, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অনেক ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি সংস্কারের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। তার ভাষ্যে, 'এই কাজগুলো খুব আস্তেধীরে করতে হয়। যেন মূল স্থাপনার অংশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রতিটা ইটই আলাদা আলাদা করে যত্ন নিয়ে সরাই আমরা। তাই সময়ও অনেক বেশি লাগে। এই বাড়ির কাজ এক বছরের আগে শেষ হবে না।'
সংস্কার কাজের বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলাম প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতার কাছে। তিনি বলেন, 'বাড়িটির সংস্কার ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ লাখ টাকা। শুরুতে বাড়ির যে অবশিষ্টাংশটুকু আছে সেটার মূল কাঠামো অনুযায়ী সংস্কার করা হবে। পাশাপাশি এর চারপাশের ল্যান্ডস্কেপটাও ঠিক করার চেষ্টা করা হবে। ক্রমশ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে সামনের পুকুরসহ, আশেপাশে জমিদার বাড়ির স্মৃতি সংবলিত অন্য কোনো স্থাপনা থাকলে সেগুলোও সংরক্ষণের আওতায় আনা হবে।'
পূর্বপুরুষের ভিটায় আসতে চান সন্দীপ রায়
কাঠফাটা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে সপ্তাহের মাঝের দিনেও মসূয়া জমিদার বাড়ি ঘুরতে এসেছিলেন কয়েকজন পর্যটক। বাড়ির ভগ্নদশা দেখে হতাশ হলেও সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় আশাবাদী তারা।
ঢাকা থেকে বন্ধুর সঙ্গে এক কাজে কিশোরগঞ্জ এসেছিলেন উজ্জ্বল হোসেন। এসে জানতে পারেন কাছেই সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের ভিটা। এই সুযোগে বন্ধুকে নিয়ে বাড়িটি দেখতে এসেছেন তিনি। প্রিয় চলচ্চিত্রকারের পৈত্রিক ভিটাটিকে এই অবস্থায় দেখে আশাহত হয়েছেন বলে জানান উজ্জ্বল।
কিশোরগঞ্জের মানিকখালী থেকে সাজিদুল ইসলাম এসেছিলেন ড্রোন নিয়ে বাড়িটির ভিডিও করতে। তার ইউটিউব চ্যানেলের দর্শকদের জন্য ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির দৃশ্য ধারণ করছেন তিনি। কিশোরগঞ্জের ভেতর এমন ঐতিহাসিক জায়গার ভিডিও দেখে অনেক পর্যটক আকৃষ্ট হবে বলে মনে করেন তিনি।
এলাকাবাসীর কাছে জানা যায়, দেশ-বিদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ, সরকারি কর্মকর্তাসহ আরো অনেকেই নিয়মিতই আসেন সত্যজিৎ রায়ের এই পৈত্রিক বাড়ি দেখতে। কয়েকবছর আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার আসার ঘটনা বেশ মনে আছে তাদের।
ইউএনও শাহরিয়ার বিন মান্নান জানান, মসূয়া জমিদার বাড়ির সামনে উপজেলার রেস্টহাউজ চালু হয়েছে মাস দুয়েক আগে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা অতিথিরা উপজেলা অফিসের অনুমতি সাপেক্ষে থাকতে পারবেন সেখানে। রেস্টহাউজে প্রতিদিনের থাকার খরচ পড়বে ৫০০ টাকা।
সম্প্রতি সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানান ইউএনও। পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। সংস্কার কাজ শেষ হলে খুব শীঘ্রই মসূয়া জমিদার বাড়িতে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর এই বংশধরের আগমন ঘটবে বলে আশা করছেন।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.