হিজড়াদের নিজস্ব ভাষা উল্টি: নিরাপত্তার আরেক নাম

ফিচার

18 June, 2023, 12:35 pm
Last modified: 18 June, 2023, 01:35 pm
ভাষাটি ব্যাকরণ তেমন মেনে চলে না। তবে বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াপদ সমস্তটাই রয়েছে এতে। বাক্যগঠনের নিজস্ব রীতি না থাকলেও আঞ্চলিক বাক্য কাঠামোর সঙ্গে মিল রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা বাক্য কাঠামো ঠিক রেখেই উল্টি শব্দের প্রয়োগ করা হয়। একেক জেলার উল্টি শব্দ প্রয়োগের মধ্যেও রয়েছে পার্থক্য। যেমন, সিলেটের উল্টি ভাষা আর খুলনার উল্টি ভাষায় রয়েছে তারতম্য। আবার এ ভাষার একেকটি শব্দ, কমপক্ষে দশটি অর্থ প্রকাশ করতে পারে।
ছবি- শাহরিয়া শারমিন/বিবিসি

মানুষ তার মনের ভাব কেবল মাতৃভাষাতে প্রকাশ করেই শান্তি পায়। অন্য অনেক ভাষায় পারদর্শিতা থাকলেও মায়ের মুখের ভাষাই তার কাছে সবচেয়ে আপন।

কিন্তু মাতৃভাষার বাইরেও যদি কোনো ভাষা আপন হয়ে ওঠে, তবে সেটা কী রকম?

আজ যে ব্যতিক্রমী ভাষার কথা বলবো, তা কারও মাতৃভাষা না। জন্মের পর বা মায়ের মুখে এ ভাষা শোনেনি কেউ। বরং এ ভাষা তাকে প্রথম শুনতে হয়েছে 'গুরুমা'র থেকে। জীবনের এক পর্যায়ে এসে অনেককেই এ ভাষা শিখতে হয় তার গুরুমা থেকে। ভাষাটির নাম উল্টি বা গুপ্তি। উল্টি শব্দটাই বেশি প্রচলিত।

শুনে শুনে এ ভাষা শিখে ফেলেন

দক্ষিণ এশিয়ার হিজড়াদের ভাষা এটি। এছাড়াও সমকামী নারী-পুরুষ, মিডিয়া শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, যৌনকর্মীদের দ্বারাও এই ভাষা ব্যবহৃত হয়। তবে উল্টি মূলত হিজড়াদেরই ভাষা। এ ভাষার সাথে তাদের পরিচয় জন্মের পরই হয় না। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হিজড়ারা যখন ডেরায় বসবাস করতে শুরু করে, তখন থেকে শুরু হয় এ ভাষার সাথে তার বেড়ে ওঠা। ডেরায় আগমনের প্রথমদিন থেকেই তারা এ ভাষা শিখতে শুরু করে গুরুমা'র কাছ থেকে। কোনো লেখাপড়া দিয়ে নয়, কেবল শুনে শুনেই গুরুমা এবং সম্প্রদায়ভুক্ত অন্যান্য প্রবীণদের থেকে তারা এ ভাষা শিখে ফেলেন।

উৎপত্তি অস্পষ্ট

ভাষাটিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে 'গুপ্তি',  দিল্লিতে ও পাকিস্তানে 'হিজড়া ফারসি' এবং নেপালে 'ইয়োব্বান বা 'যোব্বান' বলা হয়ে থাকে। আর আমাদের দেশে এ ভাষাকে বলা হয় 'উল্টি'।

গুপ্তি শব্দ থেকে অনুমান করা যায়, এটি একটি গোপন বা সাংকেতিক ভাষা। আসলেও তাই। সমাজে হিজড়াদের বেঁচে থাকার তাগিদেই শিখতে হয় এ ভাষা। কীভাবে বা কেন এ ভাষার উদ্ভব হলো, তার সঠিক ইতিহাস আজও জানা যায়নি। তবে এ ভাষার উৎপত্তির পেছনে অনেক ঘটনাই দায়ী বলে মনে করা হয়- এক, মোগল আমলে হিজড়া খোজা, নপুংসক এবং 'মেয়েলি' ছেলেদের বেশ কদর ছিল রাজপ্রাসাদে। বেগম আর সুলতানদের রক্ষাকর্তা হিসেবেও তারাই নিযুক্ত হতেন।

এদের সাথে যুক্ত হয়ে হিজড়া, নর্তকী বা বাঈজি, যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত বারাঙ্গনা, ভাড়, যারা মোগলদের রংমহলে মনোরঞ্জন করতো। যার ফলে প্রাসাদের অনেক খবর সম্পর্কেই তারা অবহিত থাকতো। এসব গোপন খবরাখবর যেন মানুষের কাছে প্রকাশ না করে ফেলে, তাই সম্রাটের উদ্যোগেই গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এসব কর্মচারীদের (হিজড়া) জন্য সাংকেতিক ভাষার প্রচলন করা হয়।

হিজড়াদের এই গোপন ভাষাটি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে হিজড়া ফারসি এবং হিন্দুদের মধ্যে গুপ্তি বা উল্টিভাষা হিসেবে পরিচিতি পায়। এই হিজড়া ফারসির সাথে আরবি ফারসির কিন্তু কোনো সম্পর্ক নেই। মোগল যুগে ফারসি ভাষার বিকাশ, নামটাও তাই রয়ে গেছে কেবল। 

তবে, হিজড়াদের কথা রামায়ণ ও মহাভারতেও উল্লেখ আছে। যদিও তখন হিজড়াদের আলাদা কোনো ভাষা ছিল কি-না তা জানা যায়নি। কিংবা হয়তো সে সময় হিজড়াদের এই গোপনীয়তার বিষয়টিই ছিল না।

দুই, এ ভাষা গড়ে ওঠার পেছনে আরেকটি কারণ ধরা হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল। ব্রিটিশরা এই সকল হিজড়া ও প্রাসাদে বসবাসকারী লোকদেরকে তাদের নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে মনে করত এবং সন্দেহের চোখে দেখতো। তাই তারা প্রাসাদের এসব কর্মচারীদের হত্যা করে এবং প্রাসাদ থেকে বের করে দেয়। এই বিতাড়িত জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায় এবং বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ উপায়ে (এরা অনেকে ভারতে মন্দিরভিত্তিক কমিউনিটি গড়ে তোলে। অনেকে আবার পেটের তাগিদে বাচ্চা নাচিয়ে, ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে ও যৌনকর্মের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ হিসেবে) অর্থ উপার্জন এবং জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করে।

ব্রিটিশ আমলের দুজন হিজড়া; ছবি-ব্রাউন হিস্ট্রি/সংগৃহীত

এছাড়া হিজড়াদের জৈবিক বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্রিটিশদের কাছে তাদের চালচলন 'নোংরামো' এবং সমাজ বিশৃঙ্খলার কারণ বলে মনে হয়। হিজড়া নির্মূলে তারা একটি বিশেষ আইনও (Criminal Tribes Act of 1871) চালু করে যা দ্বারা, হিজড়াদের কোনো কারণ ছাড়াই জেলে ভরা যায় এবং কোনো প্রমাণ ছাড়াই দোষী সাব্যাস্ত করা যায়।

ব্রিটিশদের থেকে বাঁচতে এমন একটি ভাষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে যা কেবল হিজড়েরাই বুঝতে পারবে। এমন একটি ভাষা যা তাদের কারাবাস, অপব্যবহার এবং সহিংস আচরণ থেকে রক্ষা করতে পারে।

তিন, বহুকাল ধরে তারা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক ও অবহেলিত শ্রেণী হিসেবে চলে এসেছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের কটুক্তি থেকে রেহাই পেতে হিজড়া সম্প্রদায় দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। তারা বাংলায় কথা বললেও অপরিচিতদের সামনে গোপন সাংকেতিক ভাষায় আদান-প্রদান করে। এভাবেই নিজেদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে এবং বেঁচে থাকার তাগিদেও স্বতন্ত্র ভাষা তৈরি হওয়ার একটা কারণ হতে পারে।

এক একটি শব্দ, কমপক্ষে দশটি অর্থ প্রকাশ করতে পারি

এবার আসি, ভাষাটি ঠিক কেমন। অনেকে আবার মনে করে, নাম যেহেতু উল্টি, তারমানে এটি বাংলা ভাষাকে উলটো করে পড়ে। কিন্তু এটি আসলে তা না। এটি মূলত মৌখিক এক ভাষা, যার নিজস্ব শব্দভান্ডার রয়েছে। তাদের এ শব্দভান্ডারে আছে বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাব। যেমন মুম্বাইয়ের গুপ্তি ভাষায় উর্দু, হিন্দি, মারাঠি থেকে শব্দ এসেছে। আবার করাচির ভাষায় উর্দু এবং পশতু থেকে অনেক শব্দ এসেছে। অর্থাৎ জায়গাভেদে উল্টি ভাষায় রয়েছে বিভিন্ন পার্থক্য এবং প্রভাব।

ভাষাটি ব্যাকরণ তেমন মেনে চলে না। তবে বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াপদ সমস্তটাই রয়েছে এতে। বাক্যগঠনের নিজস্ব রীতি না থাকলেও আঞ্চলিক বাক্য কাঠামোর সঙ্গে মিল রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা বাক্য কাঠামো ঠিক রেখেই উল্টি শব্দের প্রয়োগ করা হয়। একেক জেলার উল্টি শব্দ প্রয়োগের মধ্যেও রয়েছে পার্থক্য। যেমন, সিলেটের উল্টি ভাষা আর খুলনার উল্টি ভাষায় রয়েছে তারতম্য।

এ ভাষার একটি বিশেষ দিক হলো, এ ভাষার এক একটি শব্দ, কমপক্ষে দশটি অর্থ প্রকাশ করতে পারে। অর্থাৎ দশ রকম অর্থে ব্যবহার করা যায় একটি শব্দ দিয়ে।

এ কারণে, শব্দভান্ডারের বেশি প্রয়োজন হয় না। এই ভাষার যে ঠিক কতগুলো শব্দ আছে তার হিসেব কখনো বের করা হয়নি সেই অর্থে। তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কয়েকজন ব্রিটিশ গবেষকের করা গবেষণা থেকে একটা আনুমানিক হিসাব জানা যায় যে কমপক্ষে দশ হাজার শব্দ থাকতে পারে এই ভাষার শব্দভান্ডারে।

আবার, ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি একাডেমিক পেপারে হিমাদ্রী রায় দেখিয়েছেন ১০ হাজারের বেশি শব্দ রয়েছে।

এমনকি সংখ্যা এবং মুদ্রার মূল্যের জন্য তাদের নিজস্ব শব্দ আছে। যেমন, দাসোলা মানে দশ, আধি ভাদভি পঞ্চাশ, ভাদভি শত, পাঞ্জ ভাদভি পাঁচশো ইত্যাদি।

শুধু আলাদা শব্দভান্ডার বা ভাষাই নয়, তাদের বলার ভঙ্গিও অন্যরকম; আরও রয়েছে নিজস্ব সাংকেতিক চিহ্ন।

বাংলা ভাষায় যা 'নিষিদ্ধ', উল্টিতে তা-ই আদিষ্ট

যে ভাষার জন্মই গোপনীয়তা থেকে, সে ভাষা গোপন ভাষা হিসেবেই পরিচিতি পাবে। 'এই গোপন করার প্রথা তারা শিয়া ও সুফী মুসলিমদের 'কিতমান' বা 'তাকিয়া' বা 'জাহেরী-বাতেনী' নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে প্রয়োগ শুরু করে মোগল আমল থেকেই।' (হিজড়া শব্দকোষ, পৃ ৩০২)

এই ভাষাটিই একমাত্র, যা কিনা কেবলই তাদের জন্য সৃষ্টি। যখনই কোনো বিবাদ আসে, তারা এই ভাষার মাধ্যমে এক হয়।

পশ্চিমে রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের মধ্যে এরকম বিশেষ গোপন ভাষার প্রচলন ছিল। এগুলো এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায় এই ভাষার আর প্রয়োজন নেই। (বৈশালি শ্রফ, স্ক্রল ইন, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩)

কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো তাদের গ্রহণযোগ্যতা মেলেনি। ২০১৩ সালের নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি  দেওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু আমরা তাদের কোনো সুযোগ সুবিধা দিতে পারেনি। পারিনি অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে। তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা বা তাদের সংস্কৃতি মেনে নিতেও আমাদের রুচিতে বাঁধে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক রিজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা এ বিষয়ে বলেন, 'হিজড়ারা অনেক ওপেন। আমরা যেগুলোকে ট্যাবু বানিয়ে রাখি, তারা সেগুলোকে অন্য আর দশটা বিষয়ের মতোই দেখে এবং প্রকাশ করে। আমাদের সামনে তো তারা সেটা করতে পারবেনা। তাই 'প্রাইভেট বা ইন্টিমেট' আলাপের জন্যও, তাদের এই ভাষার দরকার। তখন তারা এ ভাষাতেই নিজেদের নিরাপদ মনে করে।'

'বাংলা ভাষায় গালিগুলো যেমন হয় নারীকেন্দ্রিক, তাদের গালিগুলো হয় শক্তি বা আধিপত্য প্রদর্শন কেন্দ্রিক। কে কতটা অপরের উপর যৌন আধিপত্য দেখাতে পারে তা উঠে আসে উল্টি ভাষার গালিতে,' যোগ করেন স্নিগ্ধা।

ছবি- মধুরা কামাত/ সংগৃহীত

আমরা যেমন গালিগালাজের সময় কখনো কখনো যৌনতাকে নিয়ে আসি, তারা মনের স্বাভাবিক ভাব প্রকাশেই কোনোরকম দ্বিধা ছাড়া এই যৌনতাকে নিয়ে আসে। তাদের কাছে এটি অন্য আর দশটা বিষয়ের মতোই স্বাভাবিক ভাব প্রকাশ। যা তারা নিজেদের ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, 'সেক্সুয়াল ট্রান্সফরমেশন' শব্দটির কথা। উল্টি ভাষায় একে বলা হয় 'ছিবড়ানো'। কেউ যখন এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যায়, সে তখন বলে, 'আমি ছিবড়াইসি'। এই ভাব প্রকাশ তো সে সচরাচর আমাদের সামনে করতে পারবেনা। তাই তাকে আশ্রয় নিতে হয় এই গোপন ভাষার।

এরকম অনেক শব্দ তাদের নিজেদের তৈরি। নিজেদের অভিজ্ঞতা, চেতনা থেকে তৈরি। যা হয়ত বাইরের সমাজে প্রচলিত নয়, সেইসাথে শ্রুতিকটু। তাদের শব্দভান্ডারে যৌনতাকেন্দ্রিক শব্দের আধিক্যও বাংলা ভাষার চেয়ে অনেক বেশি।

তাদের ভাষাগুলোর অন্যতম ব্যতিক্রমী দিক হলো, এতে কোনো লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য নেই।

তাদের মতো তাদের ভাষাকেও ছোট চোখে দেখে মানুষ

হিজড়া সম্প্রদায় বা কমিউনিটিতে ঢোকার পর প্রচুর নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় হিজড়াদের। তাদের সংস্কৃতি, নিয়ম-রীতি, বিশ্বাস বাইরের থেকে আলাদা। তাই তাদেরকে  ভাবতে হবে একটি কমিউনিটি হিসেবে।

তবে হিজড়া হলেই যে, সে এই কমিউনিটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত তা নয়। হিজড়া অ্যাক্টিভিস্টরা যেমন এ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। তেমনি ট্রান্স বা রূপান্তরকামীরাও এ কমিউনিটির বাইরে।

এমন একজন হলেন ইভান আহমেদ কথা। তিনি একজন হিজড়া অ্যাক্টিভিস্ট ও ট্রান্সজেন্ডার। বেড়ে উঠেছেন পরিবারের মধ্যেই। তবু এ ভাষা তিনি জানেন। তিনি বলেন, 'উল্টি ভাষা হলো হিজড়াদের শাস্ত্রীয় সম্পদ। বিশেষ করে গুরুমা'রা কোনোভাবেই চান না এ ভাষা কমিউনিটির বাইরের কেউ জানুক। কেউ যদি বাইরে এ ভাষা বলে বেড়ায়, তার ওপর ডন জরিমানা ধার্য্য করা হয়।'

গুরুমার নিয়মরীতির বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলেই তার ওপর 'ডন' পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ তার নিয়ম ভঙ্গ হওয়ার শাস্তিস্বরূপ জরিমানা করে।

এ কারণেই এ ভাষার প্রচলন কম। মাঝে মাঝে সাক্ষাৎকারে বা শুটিং বা বই লেখার জন্য কিছু কিছু শব্দ সামনে আসে। অর্থাৎ নিজেদের উপস্থাপন করার জন্য হয়তো কিছু শব্দ তারা বাইরে প্রকাশ করে। তবে সেটা কমিউনিটির বাইরে থেকেই হয়ে থাকে বেশিরভাগ।

ইদানিং ট্রান্সদের মাঝেও এ ভাষা শেখার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে করোনার সময় ট্রান্সদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দেয়। সমকামী বা ট্রান্সরা (রূপান্তরকামীরা) বহিরাগতদের সামনে হিজড়াদের মতো নিজেদের প্রকাশ করতে পারেনা। নিজেদেরকে তুলে ধরতে তাদের হিজড়াদের সাহচর্য দরকার। তাই নতুন করে এই ভাষার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে তারা। অনেক গবেষকও এই ভাষা শেখার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানে না-কি অনেক হিজড়াই এই ভাষা শেখানোর নাম করে উপার্জন করছে। যদিও আমাদের দেশে এমনটি নেই।

তবে বিভিন্ন কাজের সুবাদে এ ভাষা হয়তো অনেকেই (নৃত্যশিল্পী, যৌনকর্মী, মিডিয়াশিল্পী ইত্যাদি) জানে। অন্তত তারা যাদের বিশ্বাস করে তাদের সামনেই ভাষাটি প্রকাশ করে। তাই বলে এ ভাষা যে খুব গ্রহণযোগ্য তা নয়। বেশিরভাগ মানুষ জানেই না তাদের এই ভাষার কথা। জানলেও তাদের মতো তাদের ভাষাকেও ছোট চোখে দেখে মানুষ, জানান কথা।

ছবি- শাহরিয়া শারমিন/বিবিসি

কীভাবে ভাষা তাদের শক্তিশালী করেছে?

আসলে হিজড়াদের নিজস্ব ধ্যানধারণার একটি বড় দিক এই উল্টি ভাষা।

হিজড়ারা মনে করে, ভিন্ন ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিচয়কে খুঁজে পায়। নিজেদের খুঁজে পাওয়া এবং প্রকাশ করার একটি হাতিয়ার হলো এই ভাষা। কেননা, যে সমাজে তারা বাস করছে, সে সমাজে নেই তাদের কোনো অস্তিত্ব। নারী এবং পুরুষ কোনোটাই না হওয়ার কারণে সমাজে তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়। হতে হয় বিভিন্ন জুলুম এবং সামাজিক নিষেধাজ্ঞার শিকার।

বাইরের সবাই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে বলেই, এ ভাষা তাদের কাছে রক্ষাকবচের মতো। কথা বলেন, 'কেউ যখন আমাদের ওপর কোনো অত্যাচার বা ক্ষতি করতে আসে, আমরা নিজেদের মধ্যে এ ভাষা দিয়েই শত্রুকে প্রতিহত করতে পারি। কারণ এ ভাষা তো অন্য কেউ জানেনা।'

সময়ের সাথে সাথে, তারা বুঝতে পেরেছে, এটি কেবল মনের ভাব প্রকাশের ভাষা নয়, এটি একটি অস্ত্র যা তাদের সংঘবদ্ধ করেছে এবং দিয়েছে একাত্মতা।

এটি একটি হাতিয়ার যা তাদের সমগ্র সম্প্রদায়ের প্রতি সংহতি প্রদর্শন করতে ব্যবহৃত হয়।

এ ভাষা বেঁচে থাকবে তাদেরই মধ্য দিয়ে…

পুরাণ থেকে শুরু করে মোগল দরবার পর্যন্ত হিজড়াদের অবস্থান যে আজকের মতো ছিল না তা পরিষ্কার।

তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার নিমিত্তেই গড়ে উঠেছে আজকের এই উল্টি ভাষা। টিকেও আছে বেঁচে থাকার লড়াইকে ঘিরেই। এ ভাষাই তাদের নিরাপত্তা দেয় এবং সেইসাথে করে স্বতন্ত্র।

মাতৃভাষা না হয়েও এ ভাষাই এখন তাদের আপন। সমাজই হয়তো বাধ্য করেছে আপন করে নিতে। কেবল মুখে মুখে এ ভাষা আজ এত যুগ ধরে চলে এসেছে। এ ভাষা তাদের যেমন দিয়েছে মর্যাদা তেমনি দিয়েছে শক্তি। এই ভাষার ব্যবহার তাদের সৃজনশীলতাকে করেছে প্রসারিত।

তবে নিজস্ব শিলালিপি না থাকায় এবং সব সময় গোপন করা রাখার ফলে এ ভাষা আজ কিছুটা হুমকির সম্মুখীন। কিন্তু হিজড়ারা চায় তাদের এ ভাষা বেঁচে থাকুক প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তাদের বিশ্বাস, এ ভাষা বেঁচে থাকবে তাদেরই মধ্য দিয়ে…

(বি:দ্র: তাদের গোপনীয়তার স্বার্থেই লেখায় এ ভাষার শব্দ বা বাক্য তুলে ধরা হয়েছে নগণ্য পরিমাণে)  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.