ইংরেজদের রবার্ট ক্লাইভকে বীররূপে দেখানোর চেষ্টা যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিল

ফিচার

স্ক্রল ডটইন
12 June, 2023, 05:15 pm
Last modified: 12 June, 2023, 06:02 pm
ক্লাইভের সম্পদ বাড়তে থাকার সময়েই বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। প্রায় এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয় এতে। ক্লাইভের সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাকে নিয়ে ব্রিটেনের গণমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়।

পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের নেতৃত্ব দেওয়া রবার্ট ক্লাইভকে ঘৃণা করতেন বাংলার মানুষ। দুই দফা বাংলার গভর্নর হওয়ার পর ক্লাইভ বিপুল সম্পদ নিয়ে ইংল্যান্ডে ফেরার পর এ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চেষ্টা করে গিয়েছিল ব্রিটেনে তাকে নায়ক রূপে দেখাতে। তবে সেখানকার এক সাময়িকীতেই বারবার সমালোচনা করা হয় ক্লাইভের।

রবার্ট ক্লাইভের জীবদ্দশায় তাকে নায়ক হিসেবে দেখাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুটি প্রতিকৃতি প্রকাশ করে। প্রথমটি ছিল রোমান সামরিক পোশাকে ক্লাইভের একটি মার্বেল মূর্তি। ১৭৬৪ সালে কোম্পানির লন্ডনের প্রধান কার্যালয় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে মূর্তিটি স্থাপন করা হয়।

১৭৬০ সালে কোম্পানি কর্তৃক রোমান পোশাকে তৈরি করা চারটি মার্বেল মূর্তির একটি ছিল এটি। মূর্তিগুলোর মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নতুন এশীয় সাম্রাজ্যের বিজয়ী হিসেবে দেখানো হয়।

তবে এক দশকের মধ্যেই ক্লাইভের নায়কোচিত ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়ে যায়। ১৭৬০-এর দশকের শেষ দিকে তৎকালীন বাংলা থেকে লুণ্ঠিত বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে ব্রিটেনে ফেরেন তিনি। তখন ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ ধনী বনে যান তিনি। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে প্রচুর সম্পদ কেনেন ক্লাইভ। নিজের নতুন বাসভবন তৈরিতেও বিপুল অর্থ ব্যয় করেন তিনি।

রোমান সামরিক পোশাকে ক্লাইভের মার্বেল মূর্তি। পিটার শীমেকার্স, ১৭৬৪। ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ফস্টার ৫৩।

ক্লাইভের সম্পদ বাড়তে থাকার সময়েই বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। প্রায় এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয় এতে। ক্লাইভের সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাকে নিয়ে ব্রিটেনের গণমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়।

১৭৭১ সালের মে মাসে টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি নামক এক ব্যাঙ্গাত্মক সাময়িকী ক্লাইভের স্মৃতিকথা তুলে ধরে। সেখানে ক্লাইভের নাম দেওয়া হয় 'নিরো এশিয়াটিকাস', যিনি এশিয়ানদের যতটা সম্ভব বঞ্চিত করেছেন। নিরো ছিলেন সেই রোমান সম্রাট, যিনি চোখের সামনে রোম আগুনে পুড়তে দেখেও ফিডল (এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে ক্লাইভের রোমান পোশাকের মূর্তি স্থাপনের কারণে তার এমন নামকরণ করা হয়।

ওই সময় তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এডওয়ার্ড পেনি নামক একজনকে নিয়োগ দেয়। এডওয়ার্ড পেনি ছিলেন রয়্যাল অ্যাকাডেমির চিত্রাঙ্কনের প্রথম অধ্যাপক। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্লাইভকে নিয়ে দ্বিতীয় শিল্পকর্ম তৈরির।

লর্ড ক্লাইভ'স মিলিটারি ফান্ড-এর জন্য বাংলার নবাব থেকে অনুদান গ্রহণ করছেন রবার্ট ক্লাইভ। এডওয়ার্ড পেনি, ১৭৭২। ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ফস্টার ৯১।

ওই ছবিটিতে ক্লাইভকে নায়কোচিত কাজ করতে দেখা যায়। বাংলায় ছবির শিরোনাম ছিল এমন: 'লর্ড ক্লাইভ ভারতে অসুস্থতার কারণে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া ব্যক্তিদের পরিস্থিতি নবাবের কাছে ব্যাখ্যা করছেন'। ছবিতে তাকে বাংলার নবাবের সঙ্গে দেখা যায়, তাও এমন সময়ে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সামরিক তহবিল চালু করে।

ছবির ডানপাশে দেখা যায় অর্থ প্রয়োজন এমন সেনাদের। আর মাঝখান দেখানো হয় এক সুন্দরী বিধবা নারীকে, যাকে ঘিরে রেখেছে সন্তানেরা। ১৭৭২ সালে এ ছবি আঁকার কাজ শেষ হয়। এটি ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে নেওয়ার আগে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির বাৎসরিক প্রদর্শনীতে রাখা হয়।

ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির বাৎসরিক প্রদর্শনী ছিল একটি জনপ্রিয় ইভেন্ট। হাজার হাজার লোক এডওয়ার্ড পেনির তৈরি ক্লাইভের চিত্রকর্ম তখন দেখেছেন। টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি সাময়িকীর এক কার্টুনিস্টও তাদের একজন। সে বছরই 'দ্য ইন্ডিয়া ডিরেক্টরস ইন দ্য সুডস' শিরোনামে একটি কার্টুন প্রকাশিত হয় সাময়িকীতে।

‘দ্য ইন্ডিয়া ডিরেক্টরস ইন দ্য সুডস।' টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি, ডিসেম্বর ১৭৭২।

সুডস শব্দটি সাধারণ মানববর্জ্য বোঝাতে ব্যবহার হয়ে থাকে ইংল্যান্ডে। কার্টুনে নবাবের জায়গায় দেখানো হয় একদল ভূতকে, যারা ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিনিধিত্ব করছে। ক্লাইভকে দেখা যায় ভয়ে পেছনের দিকে লাফ দিতে।

মার্বেল মূর্তি ও চিত্রকর্ম ব্যবহার করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিল্পকর্মের মাধ্যমে লন্ডনে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চেয়েছিল। তবে ব্রিটেনের জর্জিয়ান যুগে (রাজা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও ষষ্ঠ জর্জের শাসনামল) এ ধরনের প্রচেষ্টায় অনেক সময় হিতে বিপরীতও হয়েছে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.