সাধারণ শিলা ব্যাসল্ট দিয়েই সম্ভব পরিবেশ থেকে কার্বন শোষণ?

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
08 June, 2023, 08:45 pm
Last modified: 08 June, 2023, 08:48 pm
‘এনহ্যান্সড রক ওয়েদারিং’ পদ্ধতিটি প্রাকৃতিক ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে কাজ করে। এ পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি প্রথমে পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সাথে নিয়ে মাটিতে পড়ে। এরপর এই পানি চূর্ণবিচূর্ণ ব্যাসল্টের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনেট তৈরি করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানে আগ্নেয়গিরিজাত শিলা হিসেবে পরিচিত ব্যাসল্ট হতে পারে বেশ কার্যকরী। এটি পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার করে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। খবর বিবিসি'র।

প্রকৃতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যাসল্ট রয়েছে। তবে অন্যসব খনিজের মতো এর ততটা বাণিজ্যিক চাহিদা নেই। আর এই ব্যাসল্ট ব্যবহার করেই 'এনহ্যান্সড রক ওয়েদারিং' পদ্ধতিতে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শোষণ করা যায়।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা পূর্বের তুলনায় আরও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা অনেকটা একমত যে, শুধু গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই পরিবেশ থেকে সক্রিয়ভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের কার্যকরী উপায়ও খুঁজে বের করতে হবে।

পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধটি বেশ প্রচলিত। প্রথমত, অধিক হারে বৃক্ষরোপণ করলে বায়ু থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের পরিমাণ বাড়বে।

কিন্তু যখন গাছের কাঠ জ্বালানি হিসেবে ফের ব্যবহার করা হবে, তখন কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিবেশে আবারও ছড়িয়ে যাবে। এছাড়াও বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রেও বহু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, 'ডিরেক্ট এয়ার ক্যাপচার' পদ্ধতি ব্যবহার করেও পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করা যায়। এক্ষেত্রে অনেকটা যান্ত্রিক উপায়ে কার্বন শোষণ করে তা স্থায়ীভাবে ভূগর্ভস্থে সংরক্ষণ করা হয়। তবে যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে, সেখানে এই প্রক্রিয়ায় কার্বন শোষণ কতটুকু গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এক্ষেত্রে 'এনহ্যান্সড রক ওয়েদারিং' পদ্ধতিটি প্রাকৃতিক ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে কাজ করে। এ পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি প্রথমে পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সাথে নিয়ে মাটিতে পড়ে। এরপর এই পানি চূর্ণবিচূর্ণ ব্যাসল্টের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনেট তৈরি করে।

তারপর এ কার্বনেটগুলো ভেসে আশেপাশের নদী, সাগরে কিংবা জলাশয়ে জমা হয়। ফলে বাহ্যিক কোনো প্রভাব ছাড়াই বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শোষিত হয়ে স্থায়ীরূপে জমা হয়।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি মোকাবিলায় সম্ভাবনাময় এ পদ্ধিতিটি নিয়ে কাজ করছে জিম ম্যানের কোম্পানি ইউএনডিও। ছবি: বিবিসি

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি মোকাবিলায় সম্ভবনাময় এ পদ্ধিতিটি নিয়ে কাজ করছে জিম ম্যানের কোম্পানি ইউএনডিও। এখন পর্যন্ত কোম্পানিটি ১২ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড জোগাড় করেছে এবং নিজেদের কার্যক্রম আরও প্রসারিত করছে।

শিল্পায়নের এ যুগে প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে; অবকাঠামো থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি নির্মাণের কাজে খনি থেকে তুলে ফেলা হচ্ছে খনিজ পদার্থ।

তবে অনেকটা ফেলনা মনে করেই ব্যাসল্টের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যার ফলে এটি এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রকৃতিতে আছে। আর বৃষ্টির সময় পানি সাথে সংস্পর্শে এসে শিলাগুলো পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে যাচ্ছে।

আর এই ধারণাটিকেই কাজে লাগাতে চায় ইউএনডিও। ভারী যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ একটি খনির মধ্যে থেকে কালো রঙের ব্যাসল্ট হাতে নিয়ে আঙ্গুলে ঘষতে ঘষতে জিম বলেন, "এটাই হচ্ছে আমার জাদুকরী কণা!"

ব্যাসল্ট শিলা আকারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করলেও সেটি বেশ সামান্য। অন্যদিকে 'এনহ্যান্সড রক ওয়েদারিং' পদ্ধতির মাধ্যমে শিলাগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বৃষ্টির পানির সাথে ব্যাসল্টের বিক্রিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়। এতে করে কার্বন শোষণের পরিমাণও বেড়ে যায়।

এক স্থানে স্তূপ আকারে ব্যাসল্ট রেখে দেওয়া হলে অল্প পরিমাণে ওয়েদারিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে কার্বনের শোষণের পরিমাণ বাড়াতে বড় এলাকাজুড়ে এটিকে ছিটিয়ে দিলে আরও বেশি পরিমাণে কার্বন শোষণ হয়।

অন্যদিকে কৃষকদের জন্যও ব্যাসল্ট যেন আশীর্বাদস্বরূপ। কেননা ফসলের ক্ষেতে এটি ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে কার্বন শোষণের পাশাপাশি এটি অনেকটা সার হিসেবেও কাজ করে।

ফসলি জমিতে এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ব্যাসল্ট ফসলের ফলন এবং চারণের গুণমান উভয়ই উন্নত করে। এছাড়া এটি মাঠে ছড়িয়ে দিতে আলাদা কোনো যন্ত্রেরও প্রয়োজন হয় না। বরং একটি ট্রাক্টর ও ট্রেইলার ব্যবহার করেই পুরো মাঠে বিচূর্ণ করা শিলাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

নিজের জমিতে ব্যাসল্ট ব্যবহারতারী কৃশক জন লোগান বিবিসিকে বলেন, "ব্যাসল্ট বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে যা কৃষকদের জন্য খুবই উপকারী। মনে হচ্ছে এটি জমির ঘাস আরও উন্নত করবে।"

ফসলি জমিতে এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ব্যাসল্ট ফসলের ফলন এবং চারণের গুণমান উভয়ই উন্নত করে। ছবি: বিবিসি

তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পরিবেশ থেকে কার্বন শোষণের এ কৌশলের কারণে কার্বন নিঃসরণের কমানোর মতো জরুরি দাবি থেকে সকলের দৃষ্টি সরে যেতে পারে। এমনকি এটিকে সমাধান হিসেবে দেখিয়ে কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারটিকে অনেকে সমর্থন করার ঝুঁকি রয়েছে।

এ বিষয়ে জিম বলেন, "কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনার বিষয়টিকেই অবশ্যই প্রথমে বিবেচনা করতে হবে। তবে এর পাশাপাশি আমাদের এমন কিছু প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়াতে হবে। ব্যাসল্ট ব্যবহারের সবচেয়ে ভালো দিকটি হচ্ছে, এ পদ্ধতিটি স্থায়ী।"

ইউএনডিও-এর বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেন যে, এক টন পরিমাণ কার্বন শোষণ করতে প্রায় চার টন ব্যাসল্ট শিলার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের বার্ষিক মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় ৭ টন। তাই গাণিতিক হিসেবে এ পদ্ধতিতে দেশটিতে বার্ষিক কার্বন নিঃসরণের সমপরিমাণ শোষণের জন্য জনপ্রতি ব্যাসল্টের প্রয়োজন হবে প্রায় ৩০ টন!

ইউএনডিও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নিজেদের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই কোম্পানিটি মাইক্রোসফটের মতো জায়ান্ট কোম্পানিকে সহযোগী হিসেবে পেয়েছে। যুক্তরাজ্যে জমিতে ২৫ হাজার টন ব্যাসল্ট ছিটানোর জন্য মাইক্রোসফট অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে। একইসাথে চুক্তির অংশ হিসেবে টেক জায়ান্ট কোম্পানিটি প্রজেক্টের অডিট ও কার্যকারিতা নিরূপণেও সহায়তা করবে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্বন শোষণের প্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞ ড. স্টিভ স্মিথ বলেন, "ঠিক কী পরিমাণ কার্বন শোষণ হচ্ছে এবং শেষমেশ সেগুলো কোথায় যাচ্ছে সেটি নির্ণয় করাটাই বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পরিমিত কোনো নিয়ম নেই।" শেষমেশ উদ্যোগটি শুধু জমিতে চাষাবাদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক বলে প্রমাণিত হয়েই সমাপ্ত হতে পারে বলে মনে করে তিনি।

ইউএনডিও-এর প্রজেক্টে আশেপাশের স্থানীয় খনি থেকে উপজাত হিসেবে পাওয়া ব্যাসল্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এটিকে আরও বৃহৎ পরিসরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে খনন, পরিবহণ ও মাঠে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন হবে সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।

চলতি বছর ইউএনডিও প্রায় ১,৮৫,০০০ টন ব্যাসল্ট মাঠে ছিটানোর পরিকল্পনা করেছে। কোম্পানিটির অনুমান, ২০২৫ সালের মধ্যে তারা এক মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারবে।

তবে প্রতি বছর নিঃসরিত কার্বনের তুলনায় এই পরিমাণ খুবই নগণ্য। ধারণা করা হয় যে, শুধু ২০২২ সালেই বিশ্বে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরিত হয়েছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.