প্রাক্তনের ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট কেন চেক করেন? এই অভ্যাস থেকে বিরত থাকতে চান?

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
06 May, 2023, 10:00 pm
Last modified: 06 May, 2023, 09:59 pm
অতীতে প্রাক্তন সম্পর্কে তথ্য নিতে অনেক গভীরে গিয়ে খোঁজখবর নিতে হতো বা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে হতো তার হালচাল। সোশ্যাল মিডিয়া প্রাক্তন সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করাটা আমাদের জন্য অনেক সহজ করে দিয়েছে। প্রাক্তনের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে ঘুরতে থাকলে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।

কয়েক বছর আগে কারপুল কারাওকে-এর একটি এপিসোডে প্রভাবশালী মডেল ও ইনফ্লুয়েন্সার কেন্ডাল জেনার স্বীকার করেছিলেন যে তিনি ইনস্টাগ্রামে ভুয়া (ফেইক) অ্যাকাউন্ট খুলে তার প্রাক্তন প্রেমিকের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করেছেন; যদিও অনুষ্ঠানে এই উত্তর দেওয়ার সময় কেন্ডালের শরীরে একটি লাই ডিটেক্টর সংযুক্ত ছিল। নিজের সম্পর্কে সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য না দিয়ে ফেইক অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে অনেকেই প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের উপর নজর রাখেন। কিন্তু এ ধরনের প্রবণতার কারণ কী এবং তা আমাদের জন্য ক্ষতিকর কি না, তা উঠে এসেছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল পাইস-এর একটি প্রতিবেদনে।

ফেইক অ্যাকাউন্ট দিয়ে কারও গতিবিধি লক্ষ্য রাখলে ধরা পড়ার খুব একটা সুযোগ নেই। প্রাক্তনের 'স্টোরি' দেখলেও সেখানে ভিউয়ারের তালিকায় নিজের নাম ওঠার ঝুঁকি থাকে না কিংবা ভুলে কোনো একটা পোস্টে লাইক পড়ে গেলেও ভয়ের কিছু থাকে না। কখনো কখনো ফেইক অ্যাকাউন্ট তৈরি করার প্রয়োজনও পড়ে না, কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিচ্ছেদের পরেও প্রাক্তন জুটিরা একে অপরের সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টে কানেক্টেড থেকেই যান। এর ফলে প্রাক্তন কী কী করছে সেগুলো দেখার আগ্রহ আরও প্রবল হয়।

২০১৯ সালে পিউ রিসার্চ থেকে প্রাপ্ত ডেটা থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩ শতাংশ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী অন্তত একবার হলেও তাদের প্রাক্তনের প্রোফাইল চেক করার জন্য ফেইক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। প্রাক্তনের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট চেক করতে থাকা কোনো ইতিবাচক বিষয় না হলেও, ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী আমেরিকানদের মধ্যে ৭০ শতাংশই এই অস্বাস্থ্যকর কাজটির সঙ্গে জড়িত থাকেন।

কিন্তু প্রাক্তনের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ঘুরে এসে কারোরই খুব ভালো অনুভব করা কথা না, তবুও কেন আমরা এই কাজটি করি?

প্রযুক্তিগত নানা ক্ষেত্রে আসক্তির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েলা পাওলি বলেন, "এই আচরণের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় যে কারণটি থাকে তা হলো — কৌতূহল। একটা মানুষ আমাদের জীবনে আর নেই, ফলে তার ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে আমরা তাকে খুঁজে বেড়াই। আমাদের জানার কৌতূহল হয় যে প্রাক্তন কী করছে বা এখন কার সঙ্গে আছে… এই তথ্যগুলো নেওয়ার মাধ্যমে এক ধরনের 'ছদ্ম-যোগাযোগ' গড়ে তোলা হয়।"

এছাড়া, একাকীত্ব অনুভবের ভীতির কারণেও অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রাক্তনের আইডি ঘুরে দেখেন। "বিচ্ছিন্নতা আমাদের মধ্যে শূন্যতা তৈরি করতে পারে, তাই প্রাক্তনের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে নজর রাখার মাধ্যমে তাকে জীবনে রাখার একটা চেষ্টা করা হয়।"

স্পেনের কলেজ অব সাইকোলজিস্টস অব গ্যালিসিয়া-এর কারমেন গঞ্জালেস হারমো জানান, বিচ্ছেদের পরে যে শূন্যতা তৈরি হয় তা পূরণ করারই একটা উপায় এটি। তার ভাষ্যে, "বিচ্ছেদের পরে আমরা যা যা করি এর মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা থাকে, আপনার অভ্যাসগুলো বদলে যায়। ঐ মানুষটি (প্রাক্তন) সম্পর্কে যা যা জানতেন, সেগুলো আপনার জীবনের একটা সময়জুড়ে অধিকার করে থাকত। সেই মানুষটার সাথে কথা বলা, তার সঙ্গে থাকা… এই সব স্মৃতি মনে আসে এবং পুরনো-পরিচিত অভ্যাসে ফিরে যাওয়ার দিকে মন টানে। অনেকটা এমন যে, আমাদের মন চায় ওই মানুষটাকে নিয়েই সেই সময় কাটাতে।"

তবে মনোবিজ্ঞানী ইয়োলান্ডা মেদিনা মেসা মনে করেন, পুরো বিষয়টা নির্ভর করে একটা সম্পর্ক কীরকম ছিল এবং বিচ্ছেদটা কীভাবে হয়েছে তার উপর। তিনি বলেন, "যদি আগের সম্পর্কে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থেকে থাকে এবং মিথ্যা বলা বা বিশ্বাসঘাতকতা থেকে সম্পর্ক শেষ হয়, তাহলে এটা খুবই স্বাভাবিক যে কেউ তার প্রাক্তনের আইডি স্ক্রল করবে এবং চাইবে যেকোনো উপায়ে ওই ব্যক্তির জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে।"

অন্যদিকে পাওলির মতে, কখনো কখনো স্রেফ একঘেয়েমি কাটাতে মানুষ তার প্রাক্তনের আইডি ঘুরে দেখে। "হয়তো একদিন সোফায় বা বিছানায় শুয়ে আছেন, যে মানুষটার সাথে বিচ্ছেদ হয়েছিল তার কথা ভাবছেন, তখনই চট করে তার সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টে একটু ঘুরে আসতে ইচ্ছা হলো — দেখার ইচ্ছা হলো যে তারা কী করছে, কী আপলোড দিয়েছে। এরকম সময়ে একঘেয়েমি বিষয়টাই খুব খারাপ," বলেন পাওলি।

এদিকে বিচ্ছেদ যদি হয়ে থাকে খুবই সাম্প্রতিক সময়ে তাহলে এই আচরণ আরও বেশি দেখা যায়। কিন্তু বহুদিন আগে বিচ্ছেদ হলেও অনেকে প্রাক্তনের সোশ্যাল মিডিয়া আইডি ঘাঁটতে ভুলেন না… এক্ষেত্রে কৌতূহলই প্রধান কারণ, বলেন পাওলি। যদিও এ থেকে এটাও ধারণা করা যায় যে এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি!

যার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন, তার ইনস্টাগ্রাম আইডি দুয়েকবার ঘুরে দেখা খুব বিপজ্জনক কিছু না; এতে যে সমস্যা হবেই এমনটা নয়। কিন্তু এই প্রবণতা যদি একটা মানসিক সমস্যায় পরিণত হয় তখন কী হবে?

পাওলি এ সম্পর্কে বলেন, আমাদের আগে বুঝতে হবে কেউ তার প্রাক্তনের আইডি কতবার দেখে এবং তখন সে কী ধরনের আবেগ অনুভব করে। একজন ব্যক্তি অবশ্যই বুঝতে পারবে যে কোনটা সাময়িক আর কোনটা অবসেশনে পরিণত হচ্ছে, বলেন তিনি।

পার্থক্য আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে গঞ্জালেস হারমো পরামর্শ দেন, প্রাক্তনের আইডি দেখার পরপর কী অনুভূতি হয় সে সম্পর্কে সজাগ থাকতে। "যদি দেখা যায় আপনার হৃদয় শান্ত হচ্ছে না, যদি দুঃখ বোধ করেন বা ক্ষোভ বা ঈর্ষা অনুভব করেন, তাহলে এই কাজ আপনার আর না করাই উচিত," বলেন তিনি। তিনি এও জানান যে এটা একটা দুষ্টচক্রের মতো, কারণ প্রাক্তনের সোশ্যাল মিডিয়া উপস্থিতির উপর নজর না রাখলে পাল্টা এক ধরনের উদ্বিগ্নতা তৈরি হয়।

সোশ্যাল মিডিয়া প্রাক্তন সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করাটা আমাদের জন্য অনেক সহজ করে দিয়েছে। অতীতে প্রাক্তন সম্পর্কে তথ্য নিতে অনেক গভীরে গিয়ে খোঁজখবর নিতে হতো বা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে হতো তার হালচাল। যখন আমাদের মনে হয় যে কোনো একভাবে শূন্যতা পূরণ হচ্ছে (যদিও এতে মানসিকভাবে ভালো অনুভব করা যায় না), তখন থেমে যাওয়া কঠিন, বলেন এই মনোবিজ্ঞানী।

"কিন্তু এই আচরণ যদি আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক বা কর্ম জীবনে ব্যাঘাত ঘটায় তাহলে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। সে পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই এই অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত," বলেন মেদিনা মেসা।

কমেডি-ড্রামা সিরিজ ক্রেজি এক্স গার্লফ্রেন্ড-এর দ্বিতীয় সিজনের একটি গানে উঠে এসেছে যে প্রবণতার কথা, তা হলো- প্রাক্তনের বর্তমান সঙ্গী/সঙ্গীনির সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ঘুরে দেখা। এটিও সেই একই রকম ক্ষতিকর চর্চা।

গ্যাব্রিয়েলা পাওলি বলেন, প্রাক্তনের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে ঘুরতে থাকলে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনাকে, বাস্তবে যা করেন, অনলাইনেও তা-ই করতে হবে। বাস্তবে যেমন আপনি চান না প্রাক্তনের সঙ্গে বা তার পরিচিত কোনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আপনার দেখা হোক; তেমনই অনলাইনেও আপনার জীবন থেকে তাদেরকে মুছে ফেলতে হবে। যদি নিজেকে আটকে রাখতে না পারেন তাহলে ব্লক দিতে হবে। কোনো কথাও যদি না বলেন, তাদেরকে ম্যাসেঞ্জারে বা হোয়াটসঅ্যাপে অনলাইন দেখলেও শোক জেগে ওঠে।

গ্যাব্রিয়েলা এমন একটি ফর্মুলার কথা জানিয়েছেন যা আমাদেরকে প্রাক্তনের ইনস্টাগ্রাম আইডি ঘুরে দেখা থেকে বিরত রাখবে। এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, "মেনে নেওয়া, সহায়তা করা এবং আনন্দদায়ক কাজকর্মে যুক্ত থাকা — এই তিনটির সমন্বয়ে এই ফর্মুলা। প্রথম ধাপ হচ্ছে, বিচ্ছেদ যেভাবেই হোক না কেন, সেই পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া; যত দ্রুত ভার্চুয়াল যোগাযোগ বন্ধ হবে, বিচ্ছেদের বিষয়টি মেনে নেওয়া তত বেশি সহজ হবে।"

তিনি আরও বলেন, "পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে ডিভাইসের মাধ্যমে প্রাক্তনের সাথে সংযুক্ত থাকার ফলে কত রকমের অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হচ্ছে। সারাক্ষণ প্রাক্তন কী করছে সেই চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকায় আমরা এমন একজনকে নিজের জীবনে জায়গা ও সময় দিয়ে রাখি, যে এখন আর আমাদের জীবনে নেই।

"কেউ মারা গেলে আমরা শোক করি- কিন্তু এক্ষেত্রে আপনাকে মেনে নিতে হবে যে এই ব্যক্তি আপনার জীবনে নেই কারণ সে থাকতে চায়নি বা আপনারা দুজনেই একসঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। এটা কিন্তু মৃত কাউকে স্মরণ করার মতো ব্যাপার না।"

পাওলির ফর্মুলার দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে 'সহায়তা'। অর্থাৎ পরিবার ও কাছের বন্ধুদের ওপর নির্ভর করা। তৃতীয় অংশ হচ্ছে, নিজেকে সক্রিয় রাখা এবং মন ভালো রাখার জন্য অন্যান্য আনন্দদায়ক কাজে মনোনিবেশ করা।

তবে এই ফর্মুলায় চতুর্থ আরেকটি জিনিস যুক্ত হতে পারে, তা হলো মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে পেশাদার কারও কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া যেন আপনি এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেন; যিনি আপনাকে ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন।

"তবে আপনার নিজেকে ভালোবাসতে হবে, নিজেকে বিশ্রাম ও শান্তি দিতে হবে এবং যারা আপনাকে ভালোবাসে তাদের সহায়তা নিতে দ্বিধা করবেন না," পরামর্শ দেন গঞ্জালেস হারমো।

"আপনার যদি ঈর্ষা অনুভব হয়, তাহলে মনে রাখবেন যখন কেউ আমাদের ছেড়ে যায়, সে আমাদের জীবনের সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিনিয়ে নিতে পারে না। ওই ব্যক্তি আমাকে যা দিয়েছে বলে মনে হয়, তা আসলে আমাদের আগে থেকেই ছিল," যোগ করেন তিনি।

আমাদের মূল লক্ষ্য হলো, প্রাক্তনের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল ঘুরে দেখার প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখানো। মেদিনা মেসা বলেন, "যে কারণে সম্পর্কটা ভেঙেছে সেগুলোই আসলে বাস্তবতা; সেই কারণগুলো মনে করলেই আমাদের আর প্রাক্তনের প্রোফাইল দেখার আগ্রহ থাকবে না, কারণ আমরা জানি আমরা কোনটা চাই আর কোনটা চাই না।" এক্ষেত্রে যেটি মনে রাখা সবচেয়ে কঠিন তা হলো, মাত্র কয়েকটি ক্লিকেই একসময় আমাদের জীবনে থাকা কারও সম্পর্কে আপডেটেড সকল তথ্য জেনে ফেলা যায়।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.