বিশ শতকের ভুলে যাওয়া ‘সান ইঞ্জিন’

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
25 April, 2023, 06:10 pm
Last modified: 25 April, 2023, 07:21 pm
দীর্ঘ সময় ধরেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক বিকল্প আবিষ্কারে আগ্রহী ছিলেন মার্কিন উদ্ভাবক ফ্রাঙ্ক শুমান। ১৯০৬ সালে সূর্যের আলোর শক্তিতে চলবে এমন এক ইঞ্জিন তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। তার এই 'সান ইঞ্জিন' নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে বিবিসি।

উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার সময়টাকে অনেকটা কয়লা আর লোহার যুগ বলা যেতে পারে। কারখানাগুলো ছিল প্রচণ্ড নোংরা আর কোলাহলপূর্ণ, চিমনিগুলো থেকে কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তো দূর-দূরান্তে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক-তীরবর্তী ফিলাডেলফিয়া শহর ততদিনে বেশ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ১৯৫৫ সালে দেশটির জাতীয় বায়ু দূষণ আইন প্রণয়নের ৫০ বছর আগেই শহরটির প্রশাসকরা নিজেরাই পরিষ্কার বাতাসের জন্য নিজস্ব আইন তৈরি করেছিলেন। কারখানার চিমনি থেকে খোলা জায়গায় কতটুকু ধোঁয়া নির্গত হতে পারবে তার সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন তারা। এবং 'নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়েও বেশি কালো' ধোঁয়া নির্গত করলে জরিমানা করে শাস্তির বিধান জারি করা হয়েছিল।

এরকমই এক সময়ে এক আমেরিকান উদ্ভাবক একটি বিকল্প সমাধান নিয়ে এসেছিলেন: সূর্যের তাপকে সংগ্রহ করে এই শক্তিকে অন্য যন্ত্র চালানোর কাজে ব্যবহার। তবে তার এই বিকল্প শক্তির ব্যবহার নিয়ে মাথা ঘামাতে পুরো মানবজাতির প্রায় এক শতাব্দী সময় লেগে গিয়েছে। বর্তমানে সৌরশক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে আরও বেশি করে। এ বছরের এপ্রিলের শুরুতে জ্বালানি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এম্বারের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে শক্তি উৎপাদন ইতিহাসের সর্বোচ্চ হবে। 

এই চরম অবস্থা থেকে সরিয়ে আনতে আমাদেরকে যে প্রযুক্তি সাহায্য করছে তা হয়তো ১৯৮০-এর দশকেই আবিষ্কৃত এসেছে। কিন্তু সূর্যের শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য ফ্রাঙ্ক শুমানের আইডিয়া দেখিয়ে দেয় যে এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা আরও আগেই শুরু হয়েছিল। 

১৮৯০-এর দশকে শুমান কাঁচকে শক্তিশালী করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তার আবিষ্কৃত কাঁচটি আরও আগুন প্রতিরোধী ছিল। তাছাড়া এটি ফেটে গেলেও আলাদা না হয়ে একসাথে লেগে থাকতো, যার ফলে এই ভেঙে যাওয়া কাঁচ থেকে হাত-পা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে গিয়েছিল। স্কুল এবং জেলখানার মতো জায়গায় এর ব্যবহার বেড়ে যায়। ভার্জিনিয়াতে কর্মজীবন শুরু করা শুমান ফিলাডেলফিয়ায় গিয়ে তার চাচার ধাতুর কারখানাতে কাজ শুরু করেছিলেন। কারখানাটি তখন কাজ করছে পেনসিলভানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম পেনের মূর্তি তৈরির কাজে। তবে তখন তাদের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে যায়, আর তা হলো শহরের দূষিত বাতাস থেকে মূর্তিটিকে রক্ষা করার উপায় খুঁজে বের করা। অবশেষে মূর্তিটিকে অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে ইলেক্ট্রোপ্লেটিং করা হয়। একই সময়ে তিনি নতুন এক কোম্পানি খুলে বসেন, যার মাধ্যমে তার পেটেন্ট করা 'সেফটি গ্লাস' বিক্রি করা শুরু করেন।

অনবদ্য উদ্ভাবক ফ্রাঙ্ক শুমান দীর্ঘ সময় ধরেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক বিকল্প আবিষ্কারে আগ্রহী ছিলেন। শুমানের জীবনি লেখা ক্রিস্টোফার ডোগার্টি জানান, "শুমান কয়লার ধোঁয়ার সমস্যা নিয়ে ভালোই সচেতন ছিলেন। তার সান ইঞ্জিনের বিজ্ঞাপনে তিনি দাবি করেছিলেন যে, তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তির ফলে শহরের বাতাস আরও স্বাস্থ্যকর এবং বিশুদ্ধ হবে।"

ফ্রাঙ্ক শুমান; ছবি: পাবলিক ডোমেইন

"তখন নদীর তীরগুলো ছিল কয়লার গুদাম, তেল শোধনাগার আর সস্তা জীবাশ্ম জ্বালানিতে পূর্ণ। এরকম সময়ে শুমানের আইডিয়া তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল।"

সেফটি গ্লাসের ব্যাপক সাফল্যের পর ১৯০৬ সালে সূর্যের আলোর শক্তিতে চলবে এমন এক ইঞ্জিন তৈরির কাজ শুরু করেন শুমান। তার যন্ত্রের রিফ্লেকটরগুলো সূর্যরশ্মিকে একটি পানির পাত্রের দিকে পাঠিয়ে দিতো। পাত্রের ভেতরে থাকা পানির স্ফুটনাঙ্ককে কমিয়ে আনার জন্য পাত্রটিকে একটি ভ্যাকুয়াম জায়গায় রাখা হতো। পাত্রটির সাথে যুক্ত ছিল একটি নিম্নচাপের বাষ্পীয় ইঞ্জিন। ১৯১০ সালের মধ্যেই শুমান এই আইডিয়াকে আরও উন্নত করে ছোট খেলনা ট্রেন চালানোর মতো শক্তি সংগ্রহ করে ফেলেন।

শুমান যখন তার 'সান ইঞ্জিন' নিয়ে কাজ করছেন, তখন আরেক মার্কিন উদ্ভাবক অব্রে এনিয়াস এক বিশাল ধাতব সৌর ইঞ্জিন তৈরি করেন। ১,৮০০ আয়না দিয়ে তৈরি এই ৩৩ ফুটের বিশাল যন্ত্র ১৯০৬ সালে এক উটপাখির খামারের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য পাম্প চালানোর উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা যায় যন্ত্রটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তাছাড়া খুব একটা কার্যকরীও নয় এটি।

শুমানের এই সান ইঞ্জিনের খবর পৌঁছে যায় মিশরেও। তখন মিশর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দখলে। মিশরের বিস্তীর্ণ তুলার ক্ষেতে হাতে সেচ দেওয়া বেশ শ্রমসাধ্য কাজ, কয়লা চালিত ইঞ্জিন ব্যবহারও তেমন সাশ্রয়ী ছিল না। ডোগার্টি জানান, "শুমান ব্রিটিশ শিল্পপতিদেরকে তাদের কয়লার খরচ কমানোর উপায় হিসাবে তার সান ইঞ্জিনে বিনিয়োগ করার কথা জানান।" 

১৯১৩ সালে শুমান তার প্রযুক্তি প্রদর্শনের জন্য মিশরে যান। জেরেমি শিয়ার তার 'রিনিউয়েবল: দ্য ওয়ার্ল্ড চেঞ্জিং পাওয়ার অফ ওয়ার্ল্ড এনার্জি' বইয়ে লেখেন: "শ্যাম্পেন চুমুক দেওয়া, পনির আর ক্যাভিয়ার খাওয়া, পানামা টুপি-পরা গোঁফওয়ালা পুরুষ আর প্যারাসল নিয়ে হেঁটে বেড়ানো নারীরা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন বিশাল যন্ত্রটির দিকে। লোহা দিয়ে তৈরি বয়লারের ওপর সূর্যের আলো কেন্দ্রীভূত হচ্ছে আয়না থেকে প্রতিফলিত আলোর দীর্ঘ উজ্জ্বল সারি। ৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তপ্ত হলেই এই বিশেষভাবে ডিজাইন করা নিম্নচাপের বাষ্পীয় ইঞ্জিন ৭৫ হর্স পাওয়ার উৎপাদন করতে পারতো। কেবল সূর্যের আলো দিয়েই ইঞ্জিনটি নীলনদ থেকে হাজার হাজার গ্যালন পাম্প করে শুষ্ক তুলার ক্ষেতে পাঠিয়ে দিত।

শুমানের এই প্রযুক্তি দেখতে আগ্রহীদের মধ্যে ছিলেন লর্ড কিচেনার, সুদানকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসা ইংরেজ সামরিক শাসক। ডোগার্টির মতে, "কিচেনার সান ইঞ্জিনের সম্ভাবনা দেখে একে মিশরের অবকাঠামোগত উন্নতির জন্য তার পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নির্ধারণ করেন। কিচেনার শুমানকে তার ইঞ্জিনের একটি প্রতিরূপ বানানোর বিনিময়ে ৩০ হাজার একরের একটি তুলা বাগানের মালিকানার প্রস্তাব দেন।"

তবে শুমানের এই আবিষ্কারের জন্য দুটো জিনিস বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। একটি হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয়টি হলো মধ্যপ্রাচ্যে সস্তা তেলের আবিষ্কার। তবে শুমানের নকশা দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট আদর্শ ছিল না বলেও মত দেন ডোগার্টি। তার মতে, "ইঞ্জিনটির প্রযুক্তিগত জটিলতা থাকায় তা ব্যাপকমাত্রায় গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।"

মিশরের তুলা খামারে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল 'সান ইঞ্জিনের'; ছবি: গেটি ইমেজেস

এ সত্ত্বেও শুমানের দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার এই 'সান ইঞ্জিন' প্রচুর পরিমাণে নির্মিত হলে জীবাশ্ম জ্বালানিকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে। ১৯১১ সালে সায়েন্টিফিক আমেরিকানে এক নিবন্ধে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, 

"ভবিষ্যতের সৌর-বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে আরও কর্মদক্ষতা সম্পন্ন; এর ইনস্টলেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচও কমে আসবে; এটি চালানোর জন্যও জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত মেকানিকের প্রয়োজন হবে না। সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারযোগ্য এই কেন্দ্রগুলো ১০ হাজার হর্সপাওয়ার উৎপাদন করতে পারবে।"

১৯১৯ সালে শুমান মারা যান। এবং তার এই আইডিয়াকে আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা শুরু করতেই সময় লেগে যায় আরও ৫০ বছর, যখন ১৯৭৩ সালে তেল সংকটের পর সস্তা তেলের যুগের অবসান হয়। এর এক দশকেরও বেশি সময় পর ক্যালিফোর্নিয়ার মোজাভে মরুভূমিতে প্রথম সৌর-শক্তি প্ল্যান্ট সোলার এনার্জি জেনারেটিং সিস্টেম (সেগস) উন্মোচন করা হয়। সেগসে শেষ পর্যন্ত ৯,৩৬,০০০ এরও বেশি আয়না লাগানো হয়। এই আয়নাগুলোর মাধ্যমে সূর্যের আলোকে এর চেয়ে ৭০ থেকে ৮০ গুণ বেশি তীব্রভাবে প্রতিফলিত করে সিনথেটিক তেল ফোটানো হয়, যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ-সৃষ্টিকারী টারবাইন ঘোরানো হতো। যদিও পরবর্তীতে মূল সেগসগুলোর বেশিরভাগই ফটো-ভোল্টাইক প্যানেল দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তারপরও এর সর্বোচ্চ অবস্থায় এটি দিয়ে ২,৩০,০০০ টিরও বেশি বাসাবাড়ির জন্য শক্তি উৎপাদন করা যেত।  

১৯১৪ সালে শুমান লিখে গিয়েছিলেন: "একটি জিনিস নিয়ে আমি নিশ্চিত, আর সেটি হলো মানব জাতিকে শেষ পর্যন্ত সূর্যের শক্তিই ব্যবহার করতে হবে, অন্যথায় ফিরে যেতে হবে বর্বর যুগে।"

শুমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে পৃথিবী অবশেষে সান ইঞ্জিনের উদ্দেশ্যকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পারছে বলে মনে হয়। মিশর নিজেই বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সোলার প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছে। আসওয়ান বাঁধের উত্তর-পশ্চিমে ৩৭ কিলোমিটারজুড়ে তৈরি করা বেনবান সোলার প্ল্যান্ট এতটাই বড় যে, এটি মহাকাশ থেকে দেখা যায়। শুমানের ভবিষ্যদ্বাণী অবশেষে সত্যি হতে চলেছে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.