পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ: কেন নতুন চাকরিতে যেতে মানুষ ভয় পায়?

ফিচার

এল পাইস
07 June, 2023, 08:00 pm
Last modified: 07 June, 2023, 07:58 pm
মনোবিজ্ঞানী এলেনা আলামিডা বলেন, "মানুষ স্থিতিশীলতা পছন্দ করে। যা তার কাছে পরিচিত এবং জানা — তা-ই সে পছন্দ করে। আমাদের লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনবে এবং নতুন কোনো পরিবেশে নিয়ে ফেলবে — এমন যেকোনো কিছু আমাদের মনে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে।"
প্রতীকী ছবি/সংগৃহীত

নিজের বর্তমান কর্মস্থল নিয়ে সুখী নন, এমন অনেক ব্যক্তিই আছেন। তবুও পুরোনো চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মনে এত উদ্বেগ কাজ করে কেন? কেন আমরা এই সিদ্ধান্তটি নিতে পারিনা বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি? স্প্যানিশ গণমাধ্যম এল পাইস-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমবাজারের জটিলতা এবং যেটুকু স্থিতিশীলতা আছে তা আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতা ছাড়াও আরও অনেক কারণ নতুন চাকরিতে আবেদন করার আগে আমাদেরকে দুবার ভাবায়।

শ্রম ও ব্যবসা বিষয়ক মনোবিজ্ঞানী এলেনা আলামিডা বলেন, "মানুষ স্থিতিশীলতা পছন্দ করে। যা তার কাছে পরিচিত এবং জানা — তা-ই সে পছন্দ করে। আমাদের লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনবে এবং নতুন কোনো পরিবেশে নিয়ে ফেলবে — এমন যেকোনো কিছু আমাদের মনে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। যে কাজ আমরা খুব ভালো পারি, সেটাই আমাদের 'কমফোর্ট জোন' হয়ে দাঁড়ায়; সে কারণেই চাকরি বদলানো আমাদের কাছে এত কঠিন মনে হয়।"

অন্যদিকে, কর্পোরেট ওয়েল-বিইং বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী রাফায়েল সান রোমান মনে করেন, নতুন শুরুর ক্ষেত্রে সব পরিস্থিতি একই থাকে না। এক চাকরি ছেড়ে আরেক চাকরিতে যাওয়া, একটা নিয়ন্ত্রণাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং নতুন চাকরি না পেয়েই এখনকার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরিস্থিতি এক নয়।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের মনে মিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়। "নতুন যাত্রা আরম্ভ করার উত্তেজনা এবং পেশাদার অর্জনের সুখকর অনুভূতির মতো ইতিবাচক আবেগ থাকাটা যেমন স্বাভাবিক তেমনিভাবে নেতিবাচক আবেগও কাজ করতে পারে। যেমন কর্মস্থলে নতুন পদে গিয়ে যথেষ্ট ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে না পারার আশঙ্কা," বলেন আরেক মনোবিজ্ঞানী বার্নার্ডো রুইজ।

চাকরির জন্য আবেদন প্রক্রিয়ায় যে সময় ও শক্তি ব্যয় হয়, তাতে ইতোমধ্যেই কাজটি চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। কখনো কখনো চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা এবং প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খুঁজতে গিয়ে হয়রান হতে হয়। কোম্পানি যদি আপনাকে নিতে আগ্রহী থাকে, এরপরে শুরু হয় কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়ার সেই কষ্টকর যাত্রা। লিংকডইন থেকে প্রাপ্ত ডেটা অনুযায়ী, এই কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ কার্যদিবস সময় লাগে।

"কিছু কিছু প্রক্রিয়া খুবই দীর্ঘমেয়াদি, খুবই চাহিদাপূর্ণ হয় এবং মাঝে অনেকদিনের নিঃশব্দ বিরতি থাকে। ওই সময়টা আমরা জানিই না যে আবেদনপত্রের কী হয়েছে। সেই সঙ্গে আরও কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে যার ভিত্তিতে আমরা গোটা বিষয়টা প্রত্যক্ষ করি: যেখানে আবেদন করেছি সেই চাকরিটা আমি কতটা চাই, আমার কতখানি প্রয়োজন এবং আমার বর্তমান অবস্থা কী," অপেক্ষাকালীন সময়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন রাফায়েল রোমান।

আর সবকিছু যদি ভালোয় ভালোয় উতরে যায়, তখন এক পর্যায়ে এমন সময় আসবে যখন আপনাকে নতুন চাকরিতে যোগদান করতে হবে, যা সাধারণত একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এসব পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা সহজ হবে।

একটা নতুন চাকরিতে মানিয়ে নিতে একজন ব্যক্তির কত সময় লাগে, সেটিও এখানে প্রাসঙ্গিক। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ থেকে প্রাপ্ত ডেটা অনুযায়ী, ৭২ শতাংশ মানুষ বলেন যে তারা কর্মক্ষেত্রে নিজের মতোই থাকেন, যদিও তাদের গড়ে দুই থেকে তিন মাস লেগে যায় নতুন পরিবেশে 'আমার আমি' হয়ে উঠতে। এ দলের ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করেন তারা তিন মাসের মধ্যেই স্বরূপে ফিরতে পেরেছেন, আর ২২ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তাদের সময় লেগেছে নয় মাস।

নতুন কর্ম-পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক আচরণ ও কাজকর্ম করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর গুরুত্ব এতটাই বেশি যে জার্নাল অব হ্যাপিনেস স্টাডিজ-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, একজন কর্মী নতুন কর্মস্থলে নিজেকে যত বেশি 'অকৃত্রিম' মনে করবেন; চাকরি, গৃহীত দায়িত্ব ও পারফরম্যান্সে তত বেশি সন্তুষ্টি আসবে।

এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে বার্নার্ডো রুইজ বলেন, 'একটা নতুন কাজের বাস্তুতন্ত্রের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে নতুন নতুন টাস্কের সঙ্গে, সহকর্মীদের সঙ্গে এবং নতুন কোম্পানির কর্মপদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া।

তবে চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফ্যাক্টর যদি কিছু থাকে, তার মধ্যে একটি হলো নতুন সামাজিক দলের সাথে মানিয়ে নেওয়া। "আমি মনে করি, নতুন কর্ম-পরিবেশের অংশ হওয়ার চ্যালেঞ্জের সঙ্গে আমরা কীভাবে সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করি, তার একটি দৃঢ় সম্পর্ক আছে। কোম্পানি কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে হলে আমাদের নির্দিষ্ট একটা সময় লাগে, আর এটা মেনে নিতেই হবে। এসব ক্ষেত্রে সহকর্মীদের সহায়তা খুবই দরকার", বলেন এলেনা আলামিডা।

অবশ্যই, বসদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। "নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়াতে সময় দেওয়ার অর্থ হলো কোম্পানি ও কর্মীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের একটা ব্যাপার। দুই পক্ষকেই যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে করে কোম্পানি ও কর্মী দুজনেই ভাবে যে তার সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিকই ছিল", বলেন সান রোমান।

এ মনোবিজ্ঞানী জোর দিয়ে বলেন, কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোম্পানির সঙ্গে আস্তে আস্তে পরিচিত হতে শুরু করলেও, যখন একজন কর্মী নতুন কাজ শুরু করে, তখনও তারা নিজেকে কিছুটা 'অনিরাপদ' বা ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে ভাবে। কারণ তাকে খুব দ্রুত এমন একটা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়, যেখানে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত অনেক কর্মী এবং 'কর্পোরেট ডায়নামিকস' রয়েছে। আর সেগুলোকে গ্রহণ করেই তাকে নতুন কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হয়।

নতুন চাকরিতে যাওয়ার নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে এলেনা আলামিডা নতুন কর্ম-পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে প্রধান কিছু উপদেশ দিয়েছেন:

১. তাড়াহুড়া করা যাবে না। নিজেকে থিতু করতে সময় নিন এবং নতুন পদ গ্রহণের সাথে সাথে নতুন বিষয়গুলো শিখুন।

২. নিজের জন্য কিছু সময় বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। নিজের পছন্দের কাজগুলো করুন, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন যে 'নানা পরিবর্তন সত্ত্বেও আপনি আপনার মতোই আছেন'।

৩. স্বাস্থ্যকর রুটিন মেনে চলুন। রোজ একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, ঘুমাতে যাওয়া এবং খাওয়ার অভ্যাস করুন। মানুষের সঙ্গে মেলামেশার জন্য এবং অবসর যাপনের জন্যও সময় রাখতে হবে।

৪. রাতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। নতুন রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গেলে অনেক রকম দুশ্চিন্তা ভর করে মনে, তাই রাতে পর্যাপ্ত বিশ্রামও নিতে হবে।

৫. কৌতূহলী হন। নতুন চাকরির ভিত্তিই হচ্ছে শেখা। নিজে কৌতূহলী হয়ে নতুন নতুন কাজ শিখতে হবে, আগে থেকে যা জানেন তা আরও ঝালাই করে নিতে হবে।

৬. নিজের আবেগ-অনুভূতির দিকে গুরুত্ব দিন, সামলাতে শিখুন। যখন আমরা পরিবর্তনের মুখোমুখি হই, তখন আমাদের আবেগে আঘাত লাগতে পারে। সে কারণেই আবেগ সামলানো শিখতে হবে। সেটা হতে পারে চিত্তবিনোদন, ধ্যান করা, জার্নালিং-ডায়েরি লেখা বা বিশ্বস্ত কারও সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে।

দিনশেষে, নিজের 'কমফোর্ট জোন'কে আরও প্রসারিত করার, আরও সহজবশ্য হয়ে ওঠার এবং শিখতে থাকার লক্ষ্য থাকতে হবে আপনার।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.