গ্যাবো, তোমাকে ভালোবাসি

ফিচার

18 April, 2023, 02:20 pm
Last modified: 18 April, 2023, 02:37 pm
১৭ এপ্রিল ছিল প্রখ্যাত কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের প্রয়াণ দিবস। তাঁরই স্মৃতিচারণায় এ লেখা…  
ছবি- দ্য প্যারিস রিভিউ থেকে সংগৃহীত

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের পরিচয় আমার কাছে একটাই- শব্দজাদুকর। এই শব্দের মাঝেই আছে তার মানুষ বোঝার তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী ক্ষমতা, চরিত্র গঠনের মুন্সিয়ানা। আদিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা প্রান্তরে বুনো মোষের মত ঘটনার ঘনঘটা ঘটিয়ে, হঠাৎ তীব্র বজ্রপাত হেনে ঝলসে ওঠান কোনো দৃঢ় চরিত্র বা উধাও করিয়ে দেন প্রেক্ষাপট থেকে, আশ্চর্য নির্লিপ্ততায় তাকে বাদ দিয়েই প্রবাহ এগিয়ে চলে। 

আর আছে অগুনতি বাক্য। খুব সাধারণ- জীবনের মত আটপৌরে। কিন্তু গভীর। জীবনের মতই ভারী, জীবনের মতই মহান, ভালোবাসা এবং ঘৃণায় পূর্ণ। জীবনের মতই আলো ও আঁধারে ঢাকা।

তার চরিত্রদের সাথে এগিয়ে যাই চুপিসারে সবুজ বন, ঘোলা জলের নদী ছাড়িয়ে লাল ইটের শহরের দিকে, একনায়কের প্রাসাদে, জিপসি জাদুতাঁবুতে, তামাকচাষীর কাতারে, নীল সমুদ্রে ডুবু ডুবু ভেলাতে গাংচিলের সাথে, ইন্ডিয়ানদের জীবনযাত্রায়। 

মার্কেস

কিউবার ভিনিয়ালেসের জাদু উপত্যকায় চোখ ঝলসানো সবুজের মাঝে একাকী চালাঘর দেখে অবচেতন মন বলে উঠেছিল- এই তো মাকেন্দো, এইখানেই বুয়েন্দিয়া পরিবারের স্মৃতি ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে, আছে সব চারপাশেই; কেবল খুঁজে নেবার অপেক্ষা।

যেভাবে রূক্ষ চেহারার তোবড়ানো গালের কঠোর অভিব্যক্তির এক লোককে দেখেই মাথায় ঝিলিক দিয়েছিল জনাব বালথাজারের কথা, সে বাদে আর কেউ হতেই পারে না মুরগীর বাজারের কানাগলিতে দেখা হওয়া শক্তপোক্ত বৃদ্ধ মানুষটা। এভাবেই মার্কেস দেখা দেন বারংবার, শুধু রঙ ঝলমলে ল্যাতিন আমেরিকায় না, পাঁশুটে উত্তুরে শীতেও।

এল সালভাদর থেকে প্লেন ছেড়েছে। গন্তব্য বিশ্বাস করবেন না জানি। তাই আগেই বই টেনে, থুক্কু গুগল করে দেখে নিন মার্কেসের জন্মভূমি কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতার বিমান বন্দরের নাম কী। তবে মুহূর্ত দুই চিন্তা করলেই পেয়ে যাবেন সঠিক উত্তর এল দোরাদো! অলৌকিক কিংবদন্তীর সেই সোনায় মোড়া শহরের নামের নামকরণ করা হয়েছে দেশের ব্যস্ততম বিমানাশ্রয়ের। 

মার্কেসের আরাকাতাকা

এমনিতেই দেহ মনে যথেষ্ট পুলক অনুভব করছিলাম এল দোরাদোতে খানিকক্ষণ থাকার জন্য। সেই জগত আলো করা মুহূর্তে দেখা হল রেমিদিওসের সাথে- ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউডের সেই সুন্দরী- ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে সুন্দরী তরুণী। 'দুপুর দুটোর ঘুমপাড়ানিয়া গানে রেমেদিওস, গোলাপের কোমল নিঃশ্বাসে রেমেদিওস, প্রজাপতির জল-ঘড়ি রহস্যে রেমেদিওস, সকালের ধোঁয়া ওঠা রুটিতে রেমেদিওস, প্রতিটি স্থানে রেমেদিওস, অনন্ত কাল রেমেদিওস'। সেই সুন্দরী রেমেদিওস রাজসিক চালে হেঁটে যাচ্ছিল এল দোরাদো বিমানাশ্রয়ের মাঝ দিয়ে। সমগ্র মহাবিশ্ব যেন স্থাণু হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। একবার মনে হল উড়ন্ত বিমানের পাইলটেরাও বুঝি দেখতে পারছে রেমেদিওসের অমর আগুনের মত রূপ; হয়ত কিছু ক্রাশ ল্যান্ডিং ঘটবে আজ, এখনই।

সবজান্তা ঈশ্বরের মতই রেমেদিওস জানত হতভম্ব মানুষদের নির্নিমেষ চাহনির কথা। শুধু মদির কটাক্ষ হেনে হারিয়ে গেল সে যেন আকাশের মেঘে। সহযাত্রী হুয়ান ভিয়াল বারকয়েক ঢোক গিলে বললো- সাক্ষাৎ তরুণীকালের সালমা হায়েক। দাঁত খিচিয়ে বললাম- তোর মুণ্ডু। ও রেমেদিওস, আর কেউই না। হায় রেমেদিওস, তোমার সাথে একই মুহূর্তে অবস্থানের চেয়ে মানবজন্মের সার্থকতা আর কী হতে পারে?

আরাকাতাকায় মার্কেস

বিমানে ভূমির আদর ছেড়ে শূন্যের কোলে আশ্রয় নেবার সময় শহর ছাড়িয়ে দূরে ঘন আঁধারের মাঝেও টিমটিমে বাতির অস্তিত্ব নজরে আসে, সেখানেই কি আরাকাতাকা? যেখানে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন গাবো, মার্কেস স্বয়ং এক অনন্য পৌরাণিক বিশ্বে। জন্ম হয়েছিল মাকেন্দোরও সেখানেই, পথের ধূলায় বেড়ে ওঠা এক শিশু যার স্বপ্ন বিহ্বল চোখে বরফ ছিল সর্বযুগের মহানতম আবিস্কার। যার কানে চুপি চুপি মার্কেস বলে দিয়েছিল-জীবনে সবসময়ই ভালবাসার জন্য কিছু না কিছু থাকেই।

কিছু দূরেই সেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কালি, যেখানে থাকে বন্ধু জুলিয়ানা আন্দ্রেয়া গোমেজ। জুলিয়ানার সাথে কথা হয় না কত দিন, বিস্মৃতির কবর থেকে ঠেলে বাইরে আসে কত স্মৃতি! মনে পড়ে যায় তাকে ফারমিনা নামে আহ্বানের পেছনের কারণ ছিল মার্কেসের এক চরিত্র, এক অসাধারণ গল্প। শতবর্ষ আগের কলম্বিয়ার কর্দমাক্ত, মিহি ধুলাময়, চটচটে ঘামের গন্ধযুক্ত, তোতাপাখির সপ্তবর্ণা পালকের মত বিচিত্রময় সেই কাহিনী।

দুই বছর বয়সী মার্কেস

ঘটনার ঘনঘটা আমায় নিয়ে চলে আমাজনের সবুজ থেকে উপনিবেশিক ধূসর ভুবনে, ঘোড়সওয়ারদের আস্তানা থেকে চিকিৎসকের চেম্বারে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রেমিকাকে আমার এখন একটি নামেই ডাকতে ইচ্ছে করে- ফারমিনা। পৃথিবীর মধুরতম নাম, সাবলীলতম শব্দ, পাহাড়ি নদীর কুলকুল ধ্বনিময় শীতল হাওয়ার পরশ বুলানো সম্বোধন- ফারমিনা, ফারমিনা দাজা।

জুলিয়ানার সাথে আজ এক আলোকবর্ষের ব্যবধান। জাহাজ কোম্পানির মালিকের মত বুকের ভিতরে হাওয়া ঘুরে ওঠা সন্ধ্যায় চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আবেগপ্রবণ বর্তমানের উদ্দেশ্যে- আমার হৃদয়ের প্রকোষ্ঠের সংখ্যা একটা গণিকালয়ের সকল কক্ষের চেয়েও বেশী! বলতে পারি না, শুধু মনে মনে বলি জীবনের সুদীর্ঘ পথে কী ঘটেছে তারচেয়ে অনেক অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাদের মাঝে তুমি কী কী মনে রেখেছ এবং কিভাবে মনে রেখেছ।

কল্পিত রেমিদিওস শিল্পীর আচঁড়ে

পেরুর উপত্যকার এক গ্রামের রৌদ্রকরোজ্জল ফুলের বাগান, যেখানে সূর্যকিরণের প্রাচুর্যে সূর্যমুখী ফুলেরা বুঝে ওঠে না যে কোনদিকে তাদের মুখ ঘোরানো উচিৎ। সেই বাগানেই মধ্য দিয়ে হেঁটে চলা একপলক দেখা বিশালদেহীই কি ছিল এস্তেবান? জগতের সবচেয়ে রূপবান পুরুষটি, নাকি পথ ভুলে বিশ্বে চলে আসা এক দেবদূত, যার আশ্রয় হবে শীঘ্রই মুরগীর পূতিগন্ধময় খোঁয়াড়ে। এখানেই শেষ দিনগুলি ধুকেছিলেন ত্রাতা বলিভার, অস্ত্র ও বুদ্ধির জোরে মহাদেশকে স্বাধীনতা এনে দেওয়া সেনাপতি ভালবাসার জোয়ারে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলে দাসী তরুণীর ভাগ্যে। এক পর্যায়ে বলেছিলে- স্মৃতিকে জয় করা আমার কাজ না, সে-ই উল্টো আমাকে জয় করে আছে! মার্কেসের লাইনে মূর্ত হয়ে উঠেছে গোলকধাঁধায় সেনাপতির শেষ দিনগুলো।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আরাকাতাকায় এক অ্যাকর্ডিয়ানের বাদন শুনছেন

ভোরের শিশির ভেজা শিউলির মত স্নিগ্ধ অপাপবিদ্ধ আর্জেন্টাইন তরুণী হিমেনার সাথে দেখা হয়েছিল পুনো শহরের অতল হ্রদের প্রান্তে। সে চলেছে আন্দেজের গহনে ভিলকাবামবার খোঁজে, আমরা চলেছি তারই স্বদেশে। বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না, শেষে মার্কেস এসে দাঁড়ান আমাদের মাঝে "Do not allow me to forget you" বলেই আবার দেখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। 

দিন শেষ হয়ে আসে ল্যাতিনের ভূখণ্ডে, হাতে ধরা তখনো প্রিয় বইটা। মহাসাগরের মাঝে ডুবু ডুবু ব্রাজিলের পাহাড়সারি, ঘন কালো বন, উড়ে যাওয়া বুনো পাখি, সঙ্গীতের উদ্দামতা, আর গোধূলি সূর্যের শেষ আভা, সাথে মার্কেস। বলেন চিরতরুণ শব্দজাদুকর - I discovered to my joy, that it is life, not death, that has no limits.

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.