৭০ বছর আগেই এখনকার পরিবেশ সংকটের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল 'দ্য বার্ডস'   

ফিচার

ক্যাথেরিন ওয়েন, দ্য কনভারসেশন
17 April, 2023, 04:45 pm
Last modified: 02 May, 2023, 09:04 pm
২০২৩ সালে আলফ্রেড হিচককের 'দ্য বার্ডস' নির্মাণের ৬০ বছর পূর্তিতে ড্যাফনি ডু মরিয়ের লেখা ছোটগল্পটি আরও একবার আমাদের প্রমাণ করে দেয়- কিভাবে লেখিকা বহু বছর আগেই বর্তমানের সবচেয়ে গুরুতর একটি পরিবেশগত উদ্বেগের বিষয়টি অনুমান করেছিলেন।
আলফ্রেড হিচককের দ্য বার্ডস সিনেমার পোস্টার/ ছবি- সংগৃহীত

ইংরেজ লেখিকা ড্যাফনি ডু মরিয়ের ছোটগল্প 'দ্য বার্ডস' অবলম্বনে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা আলফ্রেড হিচকক নির্মাণ করেছিলেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'দ্য বার্ডস'। রহস্যরোমাঞ্চকর থ্রিলার চলচ্চিত্রকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য হিচকককে 'মাস্টার অব সাসপেন্স' বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'দ্য বার্ডস' ছবিটি ছিল এই পরিচালকের অন্যান্য সিনেমার চাইতে একটু আলাদা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রভাবের সঙ্গে পাখিদের আচরণগত পরিবর্তনের যে একটি যোগসূত্র রয়েছে, এটিই হলো ড্যাফনি ডু মরিয়ের গল্পের মূল বিষয়বস্তু।

২০২২ সালের 'স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড'স বার্ডস' শীর্ষক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, 'পাখিরা পৃথিবীর স্বাস্থ্যের ব্যারোমিটার' হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক প্রজাতির পাখি হ্রাস পেয়েছে। যুক্তরাজ্যের কর্নওয়াল অঞ্চলের পটভূমিতে লেখা সেই বিপর্যয়কর গল্পের মধ্যে ড্যাফনি ডু মরিয়ে দেখিয়েছেন যে, পাখিরা মানুষের উপর বিনা প্ররোচনায় ভয়াবহ আক্রমণ শুরু করে।

২০২৩ সালে আলফ্রেড হিচককের 'দ্য বার্ডস' নির্মাণের ৬০ বছর পূর্তিতে ড্যাফনি ডু মরিয়ের লেখা ধ্বংসাত্বক ছোটগল্পটি আরও একবার আমাদের প্রমাণ করে দেয় কিভাবে লেখিকা বহু বছর আগেই বর্তমান যুগের সবচেয়ে গুরুতর একটি পরিবেশগত উদ্বেগের বিষয়টি অনুমান করেছিলেন।

নিজের ১৯৮৯ সালের স্মৃতিকথা 'এনচ্যান্টেড কর্নওয়াল'-এ ডু মরিয়ের দাবি করেছিলেন যে, একদিন কর্নওয়ালের একটি জমিতে একটি ট্রাক্টরকে ঘিরে গাংচিলের ঝাঁককে উড়ে যেতে দেখে তিনি এই গল্প লেখার অনুপ্রেরণা পান।

আলফ্রেড হিচককের 'দ্য বার্ডস' সিনেমার একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

এই দৃশ্যটিই দ্য বার্ডস-এ বর্ণনা করা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত প্রাক্তন সৈনিক ও ভূমি শ্রমিক ন্যাট হকেনের মুখ দিয়ে। কিছু অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করে তিনি বলেন- "ট্রাক্টরটা যখন পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে ওঠানামা করছিল, তখন তারস্বরে ডাকতে থাকা পাখিরা তাকে এমনভাবে ঘিরে ধরেছে যে ট্রাক্টরে থাকা লোকটা তাদের মধ্যে হারিয়ে গেছে...।

ন্যাট জানান যে, শরতে জমিতে লাঙ্গল দেওয়ার সময়টায় পাখিরা সবসময়ই এর পিছু পিছু অনুসরণ করতো; তবে এরকম ঝাকে ঝাকে দলবেধে কখনো আসতো না বা এতটা কোলাহলও করতো না। এখানে ট্রাক্টর এবং পাখিদের আক্রমণের দৃশ্যটি গুরুত্বপূর্ণ- কারণ ট্রাক্টর এখানে যান্ত্রিকীকরণ এবং ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তনের প্রতীক।

ইতিহাসবিদ জেআর ম্যাকনিল তার বই 'সামথিং নিউ আন্ডার দ্য সান'-এ ব্যাখ্যা করেছেন যে, ১৯৫০ এর দশক থেকে কৃষি বাস্তুশাস্ত্র পরিবর্তিত হতে শুরু করে, বড় বড় মাঠ তৈরি করা হয় এবং শিল্প কৃষির সুবিধার্থে রাস্তাঘাট-মাঠের চারপাশের ঝোপঝাড়-গাছপালা কেটে ফেলা হয়। এর ফলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে 'প্রাণীদের টিকে থাকা এবং প্রজননের সম্ভাবনা মানুষের কার্যকলাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে যায়'।

ছবি: সংগৃহীত

ড্যাফনি ডু মরিয়ের গল্পটিতে পাখিরা এ বিষয়টি মেনে নিতে পারে না- প্রতিবাদ জানায় তাদের সত্যিকার আক্রমণের মাধ্যমে এবং মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। অজ্ঞাতনামা সেই ট্রাক্টরচালক ন্যাটকে বলেন: "আমি যে কী করছিলাম তা দেখতেই পারছিলাম না", কারণ পাখিরা তার চোখে আক্রমণ করেছিল; আর 'চোখে দেখতে পাওয়া' কথাটিই রূপক অর্থে বোঝানো হয়েছে যে মানুষ দেখতে পাচ্ছে না প্রকৃতিতে কি কি পরিবর্তন ঘটছে।

অন্যদিকে, ন্যাট নিজে আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রত্যাহার করে প্রথাগত পদ্ধতিতেই মাঠে কাজ করতে যায় (সে একটা ঝোপঝাড় ঠিক করে এবং কোদাল দিয়ে কাজ করে)। আর খুব শীঘ্রই সে বুঝে যায় যে জমির মালিকের গুলি করে পাখি তাড়ানোর চেষ্টা করা সম্পূর্ণ বৃথা।

কিন্তু আরও অনেক পরিবেশবাদীর মতো ন্যাটের উদ্যোগকেও অবজ্ঞা করা হয়। পাখিদের প্রতি তার সচেতনতা এবং প্রথাগত উপায়ে কৃষিকাজ করাকে সবাই 'অদ্ভুত' রূপে গণ্য করে।

এদিকে ফার্মার ট্রিগকে তার বন্দুক হাতেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়; যুদ্ধ ও কৃষির আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিতে পাখিরা যুদ্ধকালীন আকাশপথের কৌশলের অনুকরণে মানুষের উপর হামলা চালায়। পরবর্তীতে আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, যে মাঠে ট্রাক্টর চলছিল, একটি আরএএফ যুদ্ধবিমানের উপর হামলা করে সেটিকে সেই মাঠেই নামিয়ে আনে পাখিরা।

লেখিকা ড্যাফনি ডু মরিয়ে পৃথিবীর এমন একটি অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, যেখানে মানুষ ক্রমশ পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

প্রকৃতির সূক্ষ্ণ ভারসাম্য বজায় রাখার প্রতি তার সংবেদনশীলতা এবং প্রযুক্তি ও সমাজে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তার যে মনোযোগ, এর মাধ্যমেই এটি প্রমাণিত হয় (ন্যাটের প্রতিবেশির কাউন্সিল হাউজ পাখিদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না, অথচ ন্যাটের পুরনো কটেজে- এর পুরু দেয়াল বেশি নিরাপত্তা দেয়)।

যেসব আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোকে আমরা সঠিক হিসেবে ধরে নেই, সেগুলো যে কতটা ভঙ্গুর তা ডু মরিয়ের গল্পে নিরবচ্ছিন্নভাবে ফুটে ওঠে।

'অল দেম বার্ডস'

১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় সংরক্ষণবাদী র‌্যাচেল কার্সনের লেখা বই 'সাইলেন্ট স্প্রিং', যেখানে আমেরিকার কৃষিতে কীটনাশকের বিরূপ জৈবিক প্রভাব তুলে ধরা হয়। এ বইটি প্রকাশের এক দশক আগে প্রকাশিত হয় ড্যাফনি ডু মরিয়ের 'দ্য বার্ডস'।

কার্সন রোমান্টিক কবি জন কিটসের 'লে বেলা ডেম সানস মার্সি' কবিতার প্রসঙ্গ টানেন, যে কবিতার একটি বাক্যাংশে বলা হয়েছে- 'হ্রদের জলতৃণগুলো শুকিয়ে গেছে/পাখিরা আর গান গায় না'... এর মাধ্যমে কার্সন সাহিত্যে পরিবেশগত সংকটের বিষয়টি তুলে ধরার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

কার্সনের লেখাটি শুরু হয়েছে এক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিয়ে:

নিঃশব্দ বসন্ত। যে সকাল একসময় রবিন, ক্যাটবার্ড, ঘুঘু, জে(রঙিন ডানাযুক্ত পাখি), রেন এবং অন্যান্য পাখির কণ্ঠস্বরে কম্পিত হতো, এখন সেখানে আর কোনো শব্দ নেই; বন-মাঠ আর জলাভূমিতে শুধুই নীরবতা।

পাখিরা হয় মারা যাচ্ছে, নাহয় মৃত; তাদের এই দুর্দশা- হোক তা বাস্তব অথবা প্রতীকী, তা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়। একইভাবে 'দ্য বার্ডস'-এও রাতারাতি শীত চলে আসে এবং জমি শক্ত হয়ে যায়।

কার্সন তার বৈজ্ঞানিক বইটির মাধ্যমে মানুষের দ্বারা প্রকৃতির ক্ষতি বুঝিয়েছিলেন, ডু মরিয়ে সেই একই বিষয় ফিকশনের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন।

'দ্য বার্ডস'-এ ড্যাফনি ডু মরিয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে যুদ্ধ (বিশেষ করে একজন বেসামরিক নাগরিক হিসেবে তিনি নিজে যে যুদ্ধের ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছেন) নিজেই ধ্বংসকারী এবং একই সঙ্গে যান্ত্রিকীকরণের প্রযুক্তিগুলো ও রসায়নের (যেগুলো শুধুই দিন দিন পৃথিবীর ক্ষতিই করে যাচ্ছে) মোবিলাইজার হিসেবে কাজ করে।

'দ্য বার্ডস' একটি হতাশাবাদী গল্প। লন্ডনবাসীকে পাখিদের আক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক করতে ন্যাটের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের নারী 'অধৈর্য, ক্লান্ত' হয়ে পড়েন...

এর ফলে ন্যাটের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়: 'উনি আমার কথা পাত্তাই দিচ্ছেন না। উনি অপেক্ষায় আছেন আজ রাতে সিনেমা দেখতে যাবেন কারো হাত ধরে, আর আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলবেন- 'দেখো আকাশে কত পাখি!'

বর্তমানে ন্যাটের এই মন্তব্য শুনলে মনে হয়, ড্যাফনি ডু মরিয়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত হলিউড ছবিটিকেই যেন বিদ্রুপ করা হলো এই মন্তব্যের মাধ্যমে, কারণ ছবিতে লেখিকার মূল ন্যারেটিভ অস্পষ্ট রয়ে গেছে। আধুনিককালের পাঠকদের ড্যাফনি ডু মরিয়ের 'দ্য বার্ডস' বইটির দিকে আরও ভালোভাবে 'নজর' দিতে হবে, যাতে করে তারা বুঝতে পারে যে "প্রকৃতিতে কিছু একটা আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।"

ড্যাফনি ডু মরিয়ের 'দ্য বার্ডস'-এ পাখিরা মৃত্যুর সহিংস দূত রূপে নেমে আসে। তিনি সমসাময়িক পাঠকদের তার গল্পের ধারণাটি দিয়ে আতঙ্কিত করেছিলেন, যা বর্তমান বাস্তবতার অনেক কাছাকাছি।

 

(স্ক্রল.ইন থেকে অনূদিত এ আর্টিকেলটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে দ্য কনভারসেশন-এ)   

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.