লালবাগ কেল্লা সংস্কার: হাম্মামখানা ফিরল ঠিক আদি রূপে
১৭ শতকে ঢাকার পাশ দিয়ে প্রবাহমান বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছিল লালবাগ কেল্লা। এক সময় আওরঙ্গজেব কেল্লা হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত এই স্থাপনাটি সময়ের সাথে সাথে চাকচিক্য ও ইতিহাস অনেকাংশেই হারিয়েছে। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত কেল্লাটি। স্থাপনাটি সংস্কারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বহু আগে থেকেই তাই চেষ্টা করা হচ্ছিল।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার লালবাগ কেল্লা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে তৎকালীন সময়ে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে স্থাপনাটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বেলেপাথরের টাইলসের পরিবর্তে প্লাস্টার, কংক্রিট ও রডের ব্যবহার করা হয়। চুনাপাথরের ভিত্তির ওপর সিমেন্ট ব্যবহারের ফলে স্থাপনাটির কাঠামো ভেতর থেকে দুর্বল হতে থাকে।
এরও পূর্বে ব্রিটিশ শাসনের সময় লালবাগ কেল্লাকে ব্যারাক ও অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। একইসাথে আলোয় পূর্ণ, খোলামেলা হলগুলোতে ঔপনিবেশিক আদলে দরজা ও জানালা পরিবর্তন করা হয়েছিল। একসময় ব্রিটিশরা স্থাপনাটিতে নিজস্ব স্থাপত্যের আদলে পরিবর্তন আনে।
সম্প্রতি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হেরিটেজ সেলের স্থপতি খন্দকার মাহফুজ আলম সুমন, আমিরুজ্জামান পলাশ ও খাইরুল বাশার সুমনের উদ্যোগে লালবাগ কেল্লার সংস্কার কার্যক্রম কাজ শুরু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'অ্যাম্বাসেডরস ফান্ড ফর কালচারাল প্রিজার্ভেশন (এএফসিপি)' প্রোগ্রাম কর্তৃক এ সংস্কার কাজে অর্থায়ন করা হয়েছে। স্থাপনাটির দেওয়ান-ই-আম (মোগল সুবেদারের বাসস্থান ও কোর্ট) ও হাম্মামখানা (গোসলখানা) অংশের সংস্কার কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে।
প্রজেক্টটি পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের অধ্যাপক স্থপতি ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ। আর উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন শ্রীলঙ্কার রয়েল একাডেমী সোসাইটির আজীবন সদস্য ড. টিএমজে নিলান কুরে।
সংস্কার কাজটি ২০২০ সালের অক্টোবরে শুরু হয়। করোনা মহামারি চলাকালীন কাজে ধীরগতি আসলেও পরবর্তীতে কাজে গতি আসে এবং চলতি বছরের ২২ মার্চ কাজটি শেষ হয়।
একদল স্থপতি, প্রকৌশলী ও প্রত্নতত্ত্ববিদের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে বিভিন্ন সময়ে করা স্থাপনাটির পরিবর্তনগুলো খুঁজে বের করা হয়। পরবর্তীতে স্থাপনাটির নিজস্ব ইতিহাসের আলোকে হাম্মামখানা ও দেওয়ান-ই-আম অংশটি প্রায় পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
স্থপতি ও শিল্পী অগাস্টিন অঞ্জন ব্যাপারীকে হাম্মামখানা ও দেওয়ান-ই-আম এর আদি রূপ ঠিক কেমন ছিল, সেটি আঁকতে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে হাম্মামখানার একদম কেন্দ্রে এসব পেইন্টিং স্থাপন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অঞ্জন ব্যাপারী বলেন, "প্রথমদিকে ধারণা করা হয়েছিল, হাম্মামখানা সম্ভবত মোগল নারীরা ব্যবহার করতেন। আমি সেই অনুযায়ী নারীদের গোসলের ও কথোপকথনের দৃশ্য আঁকি। তবে পরবর্তীতে দেখা যায় যে, নারীরাই যে এখানে গোসল করতো, সে বিষয়ে কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই নারীদের স্থলে শেষ পর্যন্ত পুরুষের ছবি আঁকা হয়েছে। আমার স্ত্রী আফরিনা ইসলাম এ কাজে অনেক সহযোগিতা করেছেন। আমি যথাসম্ভব সৃজনশীলতা দিয়ে হাম্মামখানা ও হাওয়া মহল (দ্বিতীয় তলা) আঁকার চেষ্টা করেছি। এর আগে অবশ্যই এই হল সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে হয়েছে।"
সংস্কারটি 'কেল্লার হাম্মামখানার পুনর্গঠন, সংস্কার ও ত্রিমাত্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রামাণ্য সংরক্ষণ' নামের প্রজেক্টের অধীনে করা হয়েছে। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এ কাজটি করতে প্রায় ২ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ দিয়েছিল।
এ বিষয়ে আবু সাঈদ বলেন, "১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকার স্থাপনাটি সম্পর্কে প্রাপ্ত সকল তথ্য নথিভুক্ত করেছিল। আমরা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে সেসব ড্রয়িং ও নথি সর্বপ্রথম সংগ্রহ করেছি। এরপর আমরা ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের ছড়িয়ে থাকা হাম্মামগুলো বিশ্লেষণ করেছি। পরবর্তীতে লালবাগ কেল্লার হাম্মামটি ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যর হতে পারে সেটি শনাক্ত করেছি।"
এরপর শুরু করা হয় হাম্মামখানার দ্বিমাত্রিক ড্রয়িং তৈরির কাজ। ইমামুর আর্কিটেকস নামের একটি ফার্মের মাধ্যমে বিস্তৃতভাবে দ্বিমাত্রিক ড্রয়িং এর কাজ শেষ করা হয়।
নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে ফ্লোর, সিলিং থেকে শুরু করে পুরো স্থাপনাটির নকশায় যাতে পরিবর্তন না আসে সেটি সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। একইসাথে ড্রোন দিয়ে তোলা ছবির সাথে স্থপতিদের পর্যবেক্ষণ মিলিয়ে স্থাপনাটির ঠিক কোথায় পরিবর্তন আনতে হবে সেটি সনাক্ত করা হয়।
সকল বিষয় নথিভুক্ত করার পর স্থাপনাটির কাঠামোগত পর্যবেক্ষণ পর্যায় শুরু হয়। এতে স্থাপনাটির ইটের শক্তি, দেয়ালের সক্ষমতা, মোজাইকের ফাটল, সিলিং এর সক্ষমতা ইত্যাদি যাচাই করা হয়। এসব রাসায়নিক বিশ্লেষণগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষত বুয়েটের মাধ্যমে করা হয়।
বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ইতিবাচক। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান আমলে যে সংস্কারটি করা হয়েছিল সেটি খুবই কার্যকরী ছিল। বর্তমান মোজাইকের মেঝেতে ফাটল দেখা দিলেও চিন্তিত হওয়ার কিছুই নেই। কেননা সেটি মূল চুনাপাথরের মেঝেতে পৌঁছায়নি।
এরপর উপরিকাঠামোর সক্ষমতা যাচাইয়ে দ্বিতীয় তলায় কয়েক স্তরে ইট বিছানো হয়। এতে করে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে পরখ করা হয় যে, দর্শনার্থীরা দ্বিতীয় তলার উঠলে কোনো ঝুঁকি আছে কি-না। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, দ্বিতীয় তলার সক্ষমতা এখনও বেশ ভালো এবং এটি একই সময়ে ১৯১ জন মানুষের ভার বহনে সক্ষম।
রাসায়নিক বিশ্লেষণ করার ফলে মূল ভবনটি নির্মাণে কী ধরণের উপাদান ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়। এতে করে চুন ও সুরকির ক্ষতি না করেই সংস্কারের জন্য যেসব নতুন উপাদান লাগবে, সেগুলো ঠিক করা হয়।
এ সম্পর্কে আবু সাঈদ বলেন, "সময়ের সাথে সাথে স্থাপনাটি শক্ত থাকার জন্য চুন ও সুরকির পানির সংস্পর্শ প্রয়োজন। তবে পূর্বের সংস্কারে মূল আবরণকে সিমেন্টের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। এতে করে চুন ও সুরকি দীর্ঘদিন পানির সংস্পর্শে আসতে পারেনি।"
এরপর সংস্কার কাজে যেসব পরিবর্তন আনা হবে সেটি নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। দেয়ালের প্লাস্টার, মেঝের মোজাইক, হাম্মামের ভেতরকার টাইলস ইত্যাদি সরানোর পরিকল্পনা করা হয়।
১৯৬০ সালে স্থাপনকৃত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আদলের দরজাগুলো সরিয়ে মোগল স্থাপত্যের আদলে দরজা লাগানো হয়। বেশ কয়েকটি প্রবেশদ্বার সিমেন্টের আস্তরণ দিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল। সেগুলো খুলে দেওয়া হয়। পূর্বে আদি সিঁড়ি পুরোপুরি বন্ধ করে একক সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছিল। সেটিও সংস্কার করা হয়।
লালবাগ কেল্লার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে পরিচিত হাম্মামের দ্বিতীয় তলাটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। তবে সেখানে মোগল সাম্রাজ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন কার্পেটও ঝুলানো হয়েছিল। দ্বিতীয় তলার পূর্ব-পশ্চিমের স্তম্ভ ও জানালা-সিমেন্ট এবং কার্পেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এইসব পরিবর্তনগুলোকে ঠিক করে আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।
দেওয়ান-ই-আম এর দেয়ালের ১০ ইঞ্চি প্লাস্টার খোঁড়ার পর মূল দেয়ালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এরপর দেওয়ালগুলোকে আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়।
আবু সাঈদ বলেন, "জাদুঘরে এমন অনেক কিছুই রাখা হয়েছিল যেটি মোগল সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্কিত নয়। আমরা সেসব নিদর্শনগুলো বাদ দেই। একইসাথে সিদ্ধান্ত নেই যে, জাদুঘরে বানানো হলে সেখানে মোগল প্রত্নতত্ত্ব বস্তু রাখব। কনফারেন্স হলের পাশের ব্যারাকটিকে জাদুঘর বানানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।"
আদি দুটি সিঁড়ির ধাপগুলোতে তক্তা লাগানো হয়। কেননা, এতে করে এর উপর দিয়ে হাঁটলে মূল ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
স্থাপনাটির ইট ও পাথরের নকশাগুলোও সংস্কার করা হয়। এক্ষেত্রে কারিগরেরা খুবই পারদর্শিতা পরিচয় দিয়েছে। হাম্মামের কিছু দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সিলিং এর একটা ছিদ্র ছিল; যেটা দিয়ে হাম্মামে আলো প্রবেশ করতো। সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
এ সম্পর্কে আবু সাঈদ বলেন, "হাম্মাম ছিল মূলত একটি গোসলখানা। এটা নিশ্চয়ই একটি গোপনীয় কক্ষ ছিল। মূল স্থাপনায় উপরিভাগের সিলিং এ একটি গোলাকার গর্ত ছিল। পূর্বে যখন সংস্কার করা হয়েছিল, তখন এটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা সেটিকে সংস্কার করে ফের খুলে দেই।"
পরিকল্পনামাফিফ সকল কাজ শেষের আগেই আর্থিক সংকট দেখা দেয়। যদিও সৌভাগ্যবশত বেশিরভাগ কাজই শেষ হয়েছিল। তবে মূল বেলেপাথরের মেঝে ফিরিয়ে আনার জন্য সেগুলো বাইরে থেকে আমদানি করতে হত। তাই সাময়িকভাবে মোজাইকের মেঝেই রেখে দেওয়া হয়েছে।
কংক্রিটের আস্তরণের জায়গায় মার্বেলের আস্তরণ বসানোও আপাতত সম্ভব হয়নি। তবে এ জায়গাগুলোতে সহজে সরিয়ে ফেলা যাবে এমন কাচের ফলক দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। যদি আবার অর্থ বরাদ্দ হয়, তবে অসমাপ্ত কাজগুলো সহজেই শেষ করা যাবে।