ড্রাকুলা: বাদুড়, রসুন, যৌনতা ও একটি ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের গল্প!

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
27 March, 2023, 10:00 pm
Last modified: 27 March, 2023, 09:55 pm
কিন্তু ড্রাকুলা প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না, পুরোনো দিনের শৈলীতেই অভ্যস্ত তিনি। সেজন্য তাকে আমরা দেখি ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে, জাহাজ ব্যবহার করতে, চিঠি লিখতে। অন্যদিকে তার শিকারিদের দেখা যায় শর্টহ্যান্ড, কণ্ঠস্বর রেকর্ডের জন্য মোমের সিলিন্ডার, টাইপরাইটার ইত্যাদি ব্যবহার করতে। অর্থাৎ তারা গণমাধ্যমের মূল শক্তিকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ ও আদানপ্রদান করেছেন। আর শেষ পর্যন্ত এ প্রযু্ক্তির কাছেই পরাজয় ঘটে ড্রাকুলার।

১৮৯০-এর দশকের লন্ডন ছিল যাকে বলে চাকচিক্যময় শহর। সেই সঙ্গে বেশ বিপজ্জনকও। লাইসিয়াম থিয়েটারে ম্যানেজারের কাজ করতেন ব্রাম স্টোকার। লন্ডনের অনেক কিছুই দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার। এ শহরে 'জ্যাক দ্য রিপার'-এর আতঙ্ক ততদিনে শেষ; কিন্তু অপরাধ, সুরাসক্তি, ও ব্যাখ্যাহীন মহামারি তখনো লন্ডনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

ব্রাম স্টোকারের ক্লাসিক ড্রাকুলা'র অনুপ্রেরণা ছিল আয়ারল্যান্ডের ভ্যাম্পায়ার ও বানশি'র মিথ। এগুলো তিনি শুনেছিলেন ছোটবেলায় মায়ের কাছে, যখন অসুস্থ ছিলেন। তারপরও ড্রাকুলার শিকারের স্থল হয়েছিল লন্ডন: তথাকথিত 'সভ্য' ইংরেজরা তাদের নিজেদের আধুনিকতার দরুন নিজেরাই বিপদাপন্ন হয়ে উঠেছিল ড্রাকুলার কাছে।

ড্রাকুলার অতিথি

মেরি শেলি'র ফ্রাঙ্কেন্সটাইন-এর মতো ড্রাকুলাও পত্রে লেখা উপন্যাস। তবে ড্রাকুলার ক্ষেত্রে স্টোকার তরুণ আইনজীবী জোনাথন হার্কারের ভ্রমণ ডায়েরির পাশাপাশি চিঠি, জার্নাল, পত্রিকার খবর ইত্যাদিও রেখেছেন।

ক্লায়েন্ট কাউন্ট ড্রাকুলাকে লন্ডনে একটি সম্পত্তি কেনার বিষয়ে সাহায্য করার জন্য কার্পেথিয়ান পর্বতমালায় যেতে হয় হার্কারকে। সেখানে গিয়ে তিনি টের পান, তিনি বন্দি হয়েছেন ড্রাকুলার দুর্গে।

একদিকে হার্কারের শরীর খারাপ হয়, অন্যদিকে তারুণ্য ও শক্তি লাভ করেন কাউন্ট। এক রুশ জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছান কাউন্ট ড্রাকুলা। ওই জাহাজ গন্তব্যে পৌঁছায় ক্রু ছাড়া, ক্যাপ্টেনও মারা যান। ইংল্যান্ডে গিয়ে হার্কারের স্ত্রী মিনা হার্কারের প্রিয়তম বন্ধু লুসি ওয়েস্টার্নরাকে আক্রমণ করেন ড্রাকুলা।

লুসি দুর্বল হতে থাকে। তখন আর্থার হোমউড, জন সিওয়ার্ড ও কুইন্সি মরিস ভ্যাম্পায়ার বিশারদ প্রফেসর আব্রাহাম ভ্যান হেলসিংয়ের পরামর্শ নিতে যান। লুসি মারা যায়।

হার্কার ও মিনার সঙ্গে একত্রিত হয়ে ভ্যাম্পায়ার হান্টারের দল ড্রাকুলাকে পরাভূত করতে চেষ্টা করেন। ভ্যাম্পায়ারকে তারা দুই ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। কিন্তু তাকে মারতে হলে তার মস্তিষ্ক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কাঠের খুঁটিতে তাকে পুড়িয়ে মারতে হবে।

যৌনতার অতিক্রমণ

১৮৯০-এর দশকে লন্ডন যেমন নগর হিসেবে বেড়ে উঠছিল, তেমনিভাবে নানা সমস্যাতেও জর্জরিত ছিল এটি। কলেরার মতো রোগ সহসা হাজির হয়ে পুরো শহরে মৃত্যুর মিছিল শুরু করত।

লন্ডনের মানুষ তখন নৈতিকতার স্খলনের আশঙ্কায়ও ছিল। সমাজে স্বাধীনতা লাভ করা 'নব্য নারী'রা চাকুরি, ভোট ও অন্যান্য অধিকার চাইতে শুরু করেছে। সমকামিতা নিয়ে বিভিন্ন খবর পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে প্রচার হচ্ছে।

১৮৯৭ সালে প্রথম প্রকাশিত ড্রাকুলা বাদুড়ে রূপান্তরিত হওয়া, রসুনের ব্যবহার ও পবিত্র ওয়েফারের মতো অনেকগুলো ট্রোপের সূচনা করেছিল। কিন্তু প্রথম ব্রিটিশ ভ্যাম্পায়ার গল্প এটি ছিল না। বনেদি ঘরের তরুণ ইংরেজদের ১৮ ও ১৯ শতকে ইউরোপ মহাদেশে গ্র্যান্ড ট্যুর দেওয়ার সময় স্থানীয় কৃষকদের মুখে ভ্যাম্পায়ারের অনেক ফোকলোর গল্প শুনতে পান বলে জানা যায়।

জন পলিডরির ১৮১৯ সালে প্রকাশিত দ্য ভ্যাম্পায়ার প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ পাঠকদেরকে ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তার গল্পের মূল চরিত্র কাউন্ট রুথভেন কবি লর্ড বায়রন দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। বায়রনের প্রতি নারীরা সহজেই আকৃষ্ট হতেন তার সুদর্শন রূপের জন্য। কাউন্ট রুথভেনেরও এ গুণ ছিল। কিন্তু বায়রনের উভকামী দিকটি নিজের গল্পে আনেননি পলিডরি।

সমকামিতার দিকটি ভ্যাম্পায়ারের গল্পে প্রবেশ করে স্যামুয়েল টাইলর কোলরিজের অসমাপ্ত কবিতা ক্রিস্টাবেল ও শেরিদান ল্যো ফানুর কারমিল্লার মাধ্যমে।

ব্রাম স্টোকার। আনুমানিক ১৯০৬ সাল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

মিথ ও প্যারোডি

হলিউড সিনেমায় যখন পরীক্ষামূলক নির্মাণ শুরু হলো, সেই কাছাকাছি সময়টাতেই ড্রাকুলার প্রকাশ। ফলে হরর সিনেমার সমার্থক হয়ে উঠল ড্রাকুলা। এরপর ড্রাকুলার গল্প অসংখ্যবার পাল্টে গেছে সিনেমায়।

হ্যালোউইনে বাড়ির সবাই একসঙ্গে বসে ড্রাকুলা দেখবেন, এমন চিন্তা করে অনেক নির্মাতাই ড্রাকুলার কমিক সংস্করণ পর্দায় এনেছেন। এ তালিকায় আছে দ্য মান্সটার্স-এর গ্র্যান্ডপা থেকে শুরু করে মকুমেন্টারির ন্যান্ডর দ্য রিলেন্টলেস।

এরকম কৌতুকপূর্ণ সংস্করণ যেমন তৈরি হয়েছে, তার বিপরীতে ড্রাকুলার রাতের অন্ধকারে শিকারি হয়ে ওঠার গল্প নিয়েও অসংখ্য সিনেমা তৈরি হয়ছে। এ তালিকায় আছে অন্যতম হরর সিনেমা লেট দ্য রাইট ওয়ান ইন

গোথিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা

১৮ শতকের শেষের দিকে গোথিক গল্পের আবির্ভাব ঘটে সাহিত্যে। ২০ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশদের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। আর ওই সময়ই জন্ম হয় ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইড, দ্য পিকচার অভ ডোরিয়ান গ্রে-এর মতো গোথিক গল্পগুলোর। আর একই সময়ে ভ্যাম্পায়ার আবার ফিরে আসে ড্রাকুলার মাধ্যমে।

গোথিক গল্পগুলোর প্রধান উপাদানের মধ্যে থাকত দুর্গ, ধ্বংসপ্রাপ্ত মনেস্টারি, ঝড়, আতঙ্ক জাগানোর জন্য তৈরি দ্বৈতরূপ ইত্যাদি। ড্রাকুলাতেও এসব ট্রোপ ব্যবহার করেছেন স্টোকার। যেমন, হার্কার ড্রাকুলার দুর্গে প্রথম উপস্থিত হন মধ্যরাতে; চারদিকে কুকুরের গর্জন, একটা ভৌতিক অবয়ব, ও নেকড়ের আক্রমণ।

এরপর হার্কার যখন টের পান, তিনি ড্রাকুলার দুর্গে বন্দি, তখন তার সামনে ধীরে ধীরে কাউন্টের ভয়ংকর সত্তাটি প্রকাশিত হতে থাকে।

সতর্কবার্তা হিসেবে দানব: ইহুদি-বিদ্বেষ

হার্কার ড্রাকুলাকে বর্ণনা করেছেন 'খাঁড়া নাক, কালো দাড়ি, সুচালো গোঁফ বিশিষ্ট একজন দীর্ঘকায় মানুষ' হিসেবে। ১৮৯০-এর ইহুদি ও অপরাধীদের বর্ণনায় এসব উপাদান পাওয়া যেত।

তখন ইহুদিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ প্রচলিত ছিল — তারা নাকি খ্রিস্টান বালকদের হত্যা করে তাদের রক্ত নিজেদের ধর্মীয় আচারে ব্যবহার করত। ড্রাকুলার রক্তের প্রতি আসক্তিও ইহুদিদের ওপর থাকা এ অভিযোগের সঙ্গে সমতুল্য।

প্রাযুক্তিক পরিবর্তন

টাইপরাইটার, টেলিগ্রাম ও রেলগাড়ির মতো আবিষ্কারগুলো ভিক্টোরিয়ান যুগে কাটিং-এজ প্রযুক্তি ছিল। ভ্যান হেলসিং তার সঙ্গী ভ্যাম্পায়ার হান্টারদের বলেছিলেন, তাদের কাছে বিজ্ঞানের উৎস আছে, তারা চিন্তা ও কাজের ব্যাপারে স্বাধীন।

কিন্তু ড্রাকুলা প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না, পুরোনো দিনের শৈলীতেই অভ্যস্ত তিনি। সেজন্য তাকে আমরা দেখি ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে, জাহাজ ব্যবহার করতে, চিঠি লিখতে। অন্যদিকে তার শিকারিদের দেখা যায় শর্টহ্যান্ড, কণ্ঠস্বর রেকর্ডের জন্য মোমের সিলিন্ডার, টাইপরাইটার ইত্যাদি ব্যবহার করতে। অর্থাৎ তারা গণমাধ্যমের মূল শক্তিকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ ও আদানপ্রদান করেছেন। আর শেষ পর্যন্ত এ প্রযু্ক্তির কাছেই পরাজয় ঘটে ড্রাকুলার।

কিন্তু আধুনিকতা যদি ভ্যাম্পায়ার শিকারিদের মহাস্ত্র হয়, তাহলে সেটিই আবার তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও। যেমন, লুসির মা ফোকলোর জানতেন না, তাই ভ্যান হেলসিংয়ের দেওয়া রসুনের ফুল তিনি জানালা দিয়ে ফেলে দেন। এ কারণেই লুসিকে আক্রমণ করতে পারে ড্রাকুলা।

গোথিক দানব হিসেবে ড্রাকুলা অভিবাসী, আধুনিক প্রযুক্তি, ইহুদি, নারীর অধিকার, সমকামিতা ইত্যাদি বিষয়ে দুই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের ভয়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছ। তারপরও প্রকাশের ১২৫ বছর পর ব্রাম স্টোকারের এ অমর সৃষ্টি এখনো আমাদের মননের গভীরতম ভয়কে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।


সূত্র: দ্য কনভার্সেশন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.