সাদেকার জাদুর প্রদীপ: যেভাবে একজন গার্মেন্টকর্মী থেকে আরএমজি প্রতিষ্ঠানের সিইও

ফিচার

23 March, 2023, 03:20 pm
Last modified: 23 March, 2023, 03:21 pm
মাসিক ৫৬০০ টাকা বেতনে কাটিং হেল্পার হিসেবে চাকরি শুরু করেছিলেন সাদেকা। তিনি বলেন, “আমার সুপারভাইজাররা সবাই ছিল পুরুষ। তারা আমার সাথে খুবই অসম্মানজনক আচরণ করতো। আমি পড়াশোনা চালিয়ে নিতে চাই শুনে আমার সহকর্মীরা হাসাহাসি করতো।“

চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহটা জাপানে বেশ ব্যস্ত সময় কেটেছে সাদেকা বেগমের। নিজের 'আলমা ম্যাটার' এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন (এইউডব্লিউ) এর সঙ্গে জাপানে গিয়েছিলেন তিনি।

সেখানে আমেরিকান ক্লাব টোকিওতে একটি সামিটে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সাদেকা। এটি ছিল এমন একটি সামিট যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়িক নেতা, দূত, অর্থদাতা এবং শিল্প-বাণিজ্য খাতের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়ানো সাদেকা বেগমের সংগ্রাম ও ভাগ্য পরিবর্তনের গল্প শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিল। তাই তো বক্তব্য শেষ হতে না হতেই চারদিক থেকে করতালি ও প্রশংসাবাক্যে মুখর হয়ে উঠেছিল সভাস্থল।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন এর একটি তহবিল সংগ্রহের ইভেন্ট ছিল এই সামিটটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের মুখপাত্র হয়ে সেখানে গিয়েছিলেন সাদেকা। সামিটে নিজের স্বপ্নের প্রকল্প আভা লিমিটেডের গল্প সবার সঙ্গে শেয়ার করেছেন তিনি। আরও চার অংশীদারের সাথে মিলে সম্পূর্ণ নারীদের দ্বারা পরিচালিত একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি হিসেবে আভা লিমিটেড চালু করতে চান সাদেকা।

সাদেকা জানান, তিনি নারীদেরকে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যবস্থাপনামূলক পদে নিয়োগ দিতে চান, বাংলাদেশে যেসব পদ সাধারণত পুরুষদের দখলে থাকে। সেই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি কর্মীকে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।

সাদেকার এ দৃষ্টিভঙ্গি শ্রোতাদের এতটাই অনুপ্রাণিত করে যে একটি শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড ও গ্লোবাল রিটেইলার সাদেকার প্রতিষ্ঠান থেকে মাসে দেড় লাখ ব্লাউজ কিনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে; যদিও আসছে জুলাইয়ের আগে সাদেকার কোম্পানিটি চালু হবে না।

"আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর মা-বাবার সঙ্গে সামিটে আসা একটা জাপানি মেয়ে আমার কাছে এসে বলেছিল- 'আমি তোমার মতো হতে চাই'। জাপান ট্যুরে আমি সবার কাছ থেকে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছি। কিভাবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমি আজকের আমি হয়ে উঠেছি, এই সব গল্প সবারই খুব ভালো লেগেছে", দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন সাদেকা।

উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে একজন বাংলাদেশি নারী নিজের জীবন বদলে দিতে পারে, মধ্য বিশের কোঠায় থাকা সাদেকা বেগম তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

২০১৫ সালে এইচএসসি পাশ করার পর (ঘরে ছিল আংশিক প্যারালাইজড বাবা, যিনি ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি) থেকে সাদেকার সংগ্রাম শুরু হয়। কিন্তু মাত্র আট বছরের মধ্যেই নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

এই আট বছরে সাদেকা বহু প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেছেন এবং নিজের ও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। উপযুক্ত শিক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা পেলে একজন গ্রামের মেয়েও যে সবকিছু অর্জন করতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছেন সাদেকা। 

জাদুর প্রদীপ চাইতেন সাদেকা!

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে কৃষিকাজ এবং কাঠমিস্ত্রির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন সাদেকার বাবা। ২০১৪ সালে ব্রেইন স্ট্রোক করার পর থেকে আংশিক প্যারালাইজড হয়ে যান তিনি। ছয় সন্তানের জনক সাদেকার বাবাই ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।

সেসময় সাদেকা এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তার বোন ফাতেহা বেগম (সাদেকার পরেই ছোট বোন তিনি) তখন সবে উচ্চ-মাধ্যমিকের পড়ালেখা শুরু করেছেন। তাদের বড় বোনের ইতোমধ্যেই বিয়ে হয়ে গেলেও, সাদেকা ও ফাতেহার পরেও তাদের আরও তিন ভাইবোন ছিল যারা নিচের ক্লাসে পড়াশোনা করতো।

কিন্তু পড়াশোনার খরচ চালানো তো দূরের কথা, বাবার অসুস্থতার কারণে পরিবারের সবার খাবার জোটানোই তাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পরেছিল। তাই পরিবারের এ সংকটে সাদেকা ও ফাতেহাকে বিয়ে দিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার চিন্তা করেছিল তাদের আত্মীয়স্বজনরা।

"কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল আমি অনেক বড় কিছু করবো। হয়তো আমাদের দুই বোনকে বিয়ে দেওয়া তখন একটা সমাধান ছিল। কিন্তু আমার মা-বাবা আমার পাশে ছিল। তারা শিক্ষিত না হলেও তারা আমাদের পড়াশোনার পেছনে সমর্থন দিয়েছেন এবং আমাদের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন।"

সাদেকা বেগম। ছবি: সংগৃহীত

এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বোনকে নিয়ে ঢাকা আসেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল ঢাকা এসে গার্মেন্টসে কাজ করবেন এবং এর পাশাপাশি নিজেদের পড়ালেখা চালিয়ে নেবেন।

তাদের আংশিক প্যারালাইজড বাবা এসময় তাদের সঙ্গে আসেন। রাজধানী ঢাকায় ছোট একটা বাসা ভাড়া নেন তারা এবং তাদের অভিভাবক হিসেবে তাদের বাবা থাকেন সঙ্গে। তারা দুই বোন একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেন।

মাসিক ৫৬০০ টাকা বেতনে কাটিং হেল্পার হিসেবে চাকরি শুরু করেছিলেন সাদেকা। প্রথম মাসে তিনি ওভারটাইমসহ ৮০০০ টাকা আয় করেন। "শীঘ্রই আমি বুঝতে পারি যে এরকম ভবিষ্যত আমি চাই না", বলেন সাদেকা।

তিনি আরও যোগ করেন, "আমার সুপারভাইজাররা সবাই ছিল পুরুষ। তারা আমার সাথে খুবই অসম্মানজনক আচরণ করতো। আমি পড়াশোনা চালিয়ে নিতে চাই শুনে আমার সহকর্মীরা হাসাহাসি করতো।"

অতীতের স্মৃতিচারণ করে সাদেকা বলেন, "প্রায় প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফিরে আমি কাঁদতাম। আমি একটা জাদুর প্রদীপ চাইতাম যেন এক নিমিষে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।"

এরই মধ্যে আবার সাদেকার গ্রামের বাড়িতেও তাদের দুই বোনকে নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তাদের গ্রাম থেকে তারা দুজনই ছিলেন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে আসা প্রথম নারী। কেউ কেউ এমনও গুজব ছড়িয়েছিল যে তাদের দুজনকে অপহরণ করা হয়েছে! গ্রামবাসীকে মেয়েদের সত্যিকার অবস্থা বোঝাতে এবং তাদের ব্যাপারে বদনাম ছড়ানো রোধ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে সাদেকার মাকে। 

নিজ দৃঢ়তা ও এইউডব্লিউর মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তন

চরম কষ্টের মধ্যেই একদিন সত্যিই জাদুর প্রদীপ সাদেকার হাতে ধরা দিল! সেদিন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন (এইউডব্লিউ) এর একটি দল সাদেকার গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে এসেছিল। তারা তাকে জানায়, গার্মেন্টকর্মীদের জন্য বৃত্তি নিয়ে এইউডব্লিউতে পড়াশোনার সুযোগ আছে।

"আমি জানতাম এই সুযোগটা আমারই জন্য", বলেন সাদেকা। তার এতদিনের প্রার্থনা পূর্ণ হয় সেদিন। সাদেকা এইউডব্লিউর ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।

এইউডব্লিউ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন সাদেকা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সম্পূর্ণ বিনা খরচে, বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং সেই সাথে যে ফ্যাক্টরিতে তিনি কাজ করতেন, সেখান থেকেও তাকে বৃত্তি দেওয়া হয়।

সাদেকার আজকের ব্যক্তি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে এইউডব্লিউর পরিবেশই সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রেখেছে। সাদেকা বলেন, "এই জায়গাটা ছিল খুবই বৈচিত্র্যময়। এমনকি আফগানিস্তান ও সিরিয়া থেকে আসা মেয়েরাও আমার রুমমেট ছিল। এরকম একটা ভিন্ন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়া একটা চ্যালেঞ্জ ছিল আমার জন্য।"

কিন্তু খুব শীঘ্রই এইউডব্লিউর 'পাথওয়েস ফর প্রমিজ' প্রোগ্রাম এর মধ্য দিয়ে নিজের যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করেন সাদেকা। খুব দ্রুত তিনি ইংরেজি শিখে ফেলেন। এই মুহূর্তে যদি কেউ সাদেকার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে, তাহলে তার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হবে নিশ্চিত।

ক্যাম্পাস জীবনে পড়ালেখার বাইরেও পাঠ্যক্রম বহির্ভূত নানা কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রেখেছেন সাদেকা। শিক্ষাগত জীবনেও তার পারফরম্যান্স দেখার মতো। ক্লাসে তিনিই সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। সাদেকার ভাষ্যে, "আমি ভ্যালেডিক্টোরিয়ান হিসেবে (সর্বোচ্চ গ্রেডধারী) ২০২০ সালে স্নাতক পাশ করি।"

সাদেকা আরও বলেন, "এইউডব্লিউর পাঠ্যক্রম এমন যে আপনি যেখান থেকেই আসেন না কেন- হোক আপনি একজন গার্মেন্টকর্মী কিংবা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আগত- আপনি এখানে ভালো ফলাফল করবেনই।"

'গ্লাস সিলিং' ভেঙে দেওয়ার পদক্ষেপ

এইউডব্লিউ থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর কক্সবাজারে এক বছর জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠানে পেইড ইন্টার্নশিপ করেছেন সাদেকা। গত দুই বছর যাবত তিনি আইপিডিসি ফাইন্যান্স এর সবচেয়ে তরুণ বিজনেস কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছেন এবং বিশাল এই সংস্থাটির কাজ সামলাচ্ছেন।

সাদেকার সঙ্গেই ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে আসা ফাতেহা এখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তার বাবার স্বাস্থ্যেরও এখন উন্নতি হয়েছে। সাদেকার সবগুলো ছোট ভাইবোনই বর্তমানে কলেজে পড়াশোনা করছে। সাদেকা ও তার বোন মিলে এখন তাদের পরিবারের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করছেন।

সাদেকার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু স্বপ্ন তো কখনো সীমাবদ্ধ থাকে না, স্বপ্ন শুধুই বড় হয়।

সুনামগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে সাদেকা বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে নিজের ও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেখিয়েছেন তিনি।

কিন্তু একই সঙ্গে নারী হিসেবে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে, তা ভুলে যাননি সাদেকা। জাদুর প্রদীপ চেয়ে কান্না এবং রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটানোর দিনগুলোও ভুলে যাননি তিনি।

আর সে কারণেই শুধুমাত্র নারীদের দ্বারা পরিচালিত গার্মেন্ট আভা লিমিটেড চালু করতে যাচ্ছেন তিনি। এ প্রতিষ্ঠান সিইও হিসেবে নেতৃত্ব দেবেন সাদেকা। সাদেকা বলেন, "আমাদের গার্মেন্ট খাতে নারীরা শুধু প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করে। আমরা এই 'গ্লাস সিলিং' ভেঙে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে সত্যিকারের নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে আসবো।"

"আমাদের ফ্যাক্টরিতে যেন কর্মীরা উপযুক্ত সম্মান, মর্যাদা ও ন্যায্য পারিশ্রমিক পায় তা আমরা নিশ্চিত করবো। আমরা একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করবো।"

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.