দুই জার্মান ছাত্রের ফ্রিৎস কোলা এখন কোকা-কোলার জন্য চ্যালেঞ্জ!
ফিচার
হামবুর্গ কলেজের ডর্মে থাকার সময় এক রাতে ঠাণ্ডা পিজ্জা আর কোক খেতে খেতে দুইজনের মাথা থেকে এক নতুন আইডিয়া বেরিয়ে আসলো। মিরকো ভোলফ ভিগার্ট আর লরেঞ্জ হাম্পল নামের দুই তরুণের ব্যবসার আইডিয়া বেশ আকর্ষণীয়ই বলা চলে। তারা এক নতুন ধরনের কোলা তৈরি করবেন। সারা পৃথিবীজুড়ে রাজত্ব করা অন্য ব্র্যান্ডটির তুলনায় তাদের কোলাটি আলাদা হবে, হবে আরও ভালো। চিনির পরিমাণ থাকবে কম, ক্যাফেইনের পরিমাণ হবে বেশি আর সাথে ফ্লেভারটিও থাকবে পরিচিত। কোথা থেকে শুরু করবে সেটি জানা না থাকলেও নতুন এই কোলা উৎপাদনের জন্য তারা তুলে ফেললেন ৭ হাজার ডলার, একইসাথে নামের রেজিস্ট্রেশনের পাশাপাশি খুঁজে বের করলেন কোলার ফর্মুলা তৈরি করার জন্য একজন ম্যানুফ্যাকচারারকে।
কিছুটা সময় লাগলেও ফর্মুলা বের করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বেশ কিছু ট্রায়াল অ্যান্ড এররের পর তাদের নিখুঁত কোলা রূপ নিল বাস্তবতায়। নিজস্ব কোলা প্রথমবার বের হওয়ার পর এক পার্টির আয়োজন করা হলো: পরদিন সকাল পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে পার্টি করা দুই তরুণ নিজেদের কোলাকে সফল হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। এক ফোক্সভাগেন ভ্যানে করে ২৪টি বোতলভর্তি ২৪০টি বক্স ডেলিভারি করা হয় উত্তর জার্মানির বিভিন্ন প্রান্তে।
৪৮ বছর বয়সী মিরকো এখন পুরনো দিনগুলোর কথা মনে করে হাসেন, যখন তাদের জীবন ছিল অভাব, স্বপ্ন আর পার্টিতে ভরপুর। শহরের বার, ক্যাফে আর রেস্তোরাঁগুলোতে গিয়ে সেখানকার মালিকদের সাথে কথা বলে তাদের বানানো কোলাকে বিক্রি করার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানাতেন তারা। মালিকরাও অবাক হয়ে যেতেন বিশ্বের অন্যতম বড় মনোপলি কোকাকোলাকে চ্যালেঞ্জ করার এই দুঃসাহস দেখে, যাদের কাছে পুনঃব্যবহারযোগ্য কাঁচের বোতলে কোলা সরবরাহ করা হতো।
বিশ বছর পর, ফ্রিৎস কোলা কোম্পানিতে এখন ৩০০ কর্মী কাজ করছেন, যেটি পুরো ইউরোপজুড়ে সরবরাহ করা হয়। পাঁচটি কারখানায় উৎপাদিত হওয়া এই কোলা এখন জার্মানিতে বেশ পরিচিত একটি পানীয়, একইসাথে অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের মতো কেদ্রীয় ইউরোপের দেশগুলোতে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বার্লিনের অনেক দোকানেই কেবল এই কোলাই পাওয়া যায়। মিরকো কখনোই ভাবেননি যে, তার ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে ব্যবসায় নেমে পড়া এই কোলা একদিন মহাদেশজুড়ে মিউজিক ফেস্টিভাল স্পন্সর করবে, দৃষ্টিনন্দন বিজ্ঞাপন অভিযান পরিচালনা করবে।
হামবুর্গে থাকা ফ্রিৎস কোলার অত্যাধুনিক হেডকোয়ার্টারে বসে মিরকো জানালেন, "আমরা দক্ষিণে ফ্রান্স এবং স্পেনের দিকে নজর দিচ্ছি, যেখানে আমরা স্থানীয়ভাবেই কোলা উৎপাদন করবো।" মার্কেটিং, কমিউনিকেশন এবং ব্যবসার পুরোটাই হেডকোয়ার্টার থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্যদিকে, কারখানাগুলো জার্মানির বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে; উত্তরে থাকা কারখানা থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়, পূর্বে থাকা কারখানা থেকে পোল্যান্ড এবং চেক রিপাবলিকে, পশ্চিমে থাকা কারখানা থেকে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যে এবং দক্ষিণে থাকা কারখানা থেকে অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ দক্ষিণের দেশগুলোতে ফ্রিৎস কোলা পাঠানো হয়।
হেডকোয়ার্টারের মিটিং রুমে গেলে কোম্পানির উৎপাদন করা লেমন, অরেঞ্জ, অ্যাপল, রুবার্বের মতো বিভিন্ন ফ্লেভারের নাম চোখে পড়বে, যেগুলো গত দুই দশক ধরে তারা কোম্পানির বৃদ্ধির সাথে সাথে বের করেছে। তবে সবার আগে চোখে পড়বে কোম্পানির সাদা-কালো লোগো, যেখানে দুইজন ব্যক্তির হাসিমুখ দেখা যায়। এই দুইজন মূলত দুই প্রতিষ্ঠাতা মিরকো আর লরেঞ্জই। বাজেটের সমস্যায় ডিজাইনার নিয়োগ দিতে পারেননি তারা, তাই তখন নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পিংপং রুমের সাদা দেয়ালকে পেছনে রেখে নিজেদের ছবি তোলেন তারা। এরপর এক দোকানে গিয়ে ছবিটিকে ডিজিটালাইজ করে তাদের এক বন্ধুকে বলেন লোগোর ছায়া তৈরি করে দিতে। তারপর থেকে ফ্রিৎস কোলার লোগো সাদা-কালোই রয়ে গিয়েছে, কারণ সাদা-কালো লোগো প্রিন্ট করা রঙিন কালির তুলনায় সস্তা। বর্তমানে এই লোগো কোম্পানিটির মতোই বহুল পরিচিত।
ফ্রিৎস কোলার এই সাফল্য মূলত তাদের মৌলিকত্ব। এছাড়াও স্থানীয় পণ্য হওয়াও আরেকটি কারণ বলে ব্যাখ্যা করেছেন স্পেনের ইএসআইসি বিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং স্কুলের অধ্যাপক ফ্রান্সিস্কো তোরেব্লাঙ্কা। কোলার ফ্লেভারের সাথে সাথে এর অস্থির লোগো এবং নামও (ইংরেজি 'কে' অক্ষর দিয়ে শুরু Kola) এটিকে পরিচিত করে তুলতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির গল্পের সাথে তাদের উদ্দেশ্য তুলে ধরাও এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে।
স্পেনের বাজারে ঢোকার প্রসঙ্গে মিরকো জানান, "নতুন ভোক্তারা নতুন ধরনের পণ্য খোঁজেন। [পরিবহন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন হওয়ায়] আমাদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ছে, এবং সবাই নতুন পণ্যের স্বাদ নিয়ে দেখতে চান।" ইতিমধ্যেই স্পেনের হাজারের বেশি বার ও রেস্তোরাঁয় ফ্রিৎস কোলা পৌঁছিয়ে গিয়েছে।
কোম্পানি শুরু করার আগেই ব্র্যান্ডের নাম কী হবে তা নিয়ে সম্ভাব্য ভোক্তাদের কাছে জরিপ করেছিলেন দুই প্রতিষ্ঠাতা। হামবুর্গ এবং উত্তর জার্মানির কয়েকটি শহরে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। "অ্যালসার হ্রদের নামে অ্যালস্টার কোলা, এলবা নদীর নামে এলবা কোলা, নর্দার্ন কোলা এবং একটি সাধারণ পুরুষ জার্মান নাম ফ্রিৎস কোলা তালিকায় ছিল। শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে ভোক্তাদের কাছে নামের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। ফ্রেডরিখ নামের সংক্ষিপ্ত রূপ 'ফ্রিৎস'-ই শেষমেশ বেশি ভোট পায়। অন্যদিকে ভিন্ন কিছু করার লক্ষ্য থাকায় কোলা শব্দের প্রথম অক্ষর 'সি' কে বদলে 'কে' করা হয়," বলে নামকরণের ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন মিরকো।
অন্য উদ্যোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ফ্রিৎস কোলা ছেড়ে চলে যান লরেঞ্জ হাম্পল। তবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে অখুশি নন মিরকো। তিনি জানান, "আমাদের লক্ষ্য ইউরোপের বার এবং ক্যাফেতে নিজেদেরকে এক নম্বর কোলা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।" কোম্পানির বর্তমান উপাত্ত অনুযায়ী, বাজারের ৪% তাদের দখলে।
যদিও জার্মানির প্রত্যেক সুপারমার্কেটে ফ্রিৎস কোলা দেখা যাবে, তারপরেও কোকাকোলার ক্যান এবং প্লাস্টিক বোতলের সাথে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। তবে সেটি তাদের টার্গেট অডিয়েন্সও নয়। প্রতিষ্ঠাতারা চেয়েছিলেন তাদের কোলা খাওয়া হবে বিশেষ অনুষ্ঠানে বা পার্টিতে, নিয়মিত নয়। এ কারণেই তারা বৈধ মাত্রার মধ্যে সর্বোচ্চ ক্যাফেইন (প্রতি ১০০ মিলিমিটারে ২৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন) তাদের পানীয়তে যুক্ত করেছেন। ফ্রিৎস কোলাতে চিনির পরিমাণও কম, সাথে হালকা লেবুর স্বাদও রয়েছে। তাছাড়া এটা বিক্রিও হয় ছোট আকারের ০.২ এবং ০.৩৩ লিটারের বোতলে। নিলসেন ডেটার উপাত্ত অনুযায়ী, জার্মান বার এবং রেস্তোরাঁয় বহু বছর ধরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফ্রিৎস কোলা, যাদের বিক্রি পেপসির চেয়েও বেশি।
টেকসই পরিবেশও প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি লক্ষ্য, যে কারণে তারা কেবল কাঁচের বোতলেই তাদের পণ্য বিক্রি করে। জার্মানিসহ কেন্দ্রীয় ইউরোপের অন্যান্য দেশে বোতল ফেরত দেওয়ার পদ্ধতি রয়েছে, যেটি ৫০ বার রিফিল করা যায়। দূরবর্তী অন্যান্য দেশে তারা রিসাইকেল হতে সক্ষম এমন বোতল ব্যবহার করা হয়। মিরকো জানান "আপনি কখনোই আমাদের বোতলগুলোকে সমুদ্র সৈকতে কিংবা সাগরে ভাসতে দেখবেন না।"
সূত্র: এল পাইস
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.