‘আমি আর এখন গাড়ির জন্য পাগল নই’: নিজামুদ্দিন আউলিয়া লিপু
সম্প্রতি আফগান স্পোর্টস কার 'দ্য ব্ল্যাক সোয়ান' বেশ সাড়া জাগিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। টয়োটা করোলা ইঞ্জিনের কালো রঙের গাড়িটি নিয়ে নেটিজেনদের যেন উৎসাহের শেষ নেই। এরই মধ্যে ফেসবুক, টুইটারে ভাইরাল হয়েছে গাড়িটির ডিজাইন, ছবি এবং ভিডিও।
গাড়িটি নিয়ে নেটিজেনদের অনলাইন উন্মাদনা অনুসরণের সময় পুরানো একটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল। পুরানো ভক্সওয়াগেন থেকে তৈরি একই রকমের একটি কালো গাড়ির স্মৃতি; ৯০'র দশকের শেষের দিকে ঢাকার রাস্তায় দেখা মিলেছিল গাড়িটির। সে সময়ের লিমোবিল, লিপুসিনসহ সব পুরনো গাড়ি রূপান্তরের কথা মনে আছে আমার। নিজামুদ্দিন আউলিয়া লিপুর কথাও মনে আছে; তিনি একজন বাংলাদেশি কার অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিজাইনার। বর্তমানে পরিবারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
প্রথমত যে বিষয়টি উপলব্ধ হয় তা হলো, লিপু সম্ভবত রক অ্যান্ড রোলের রাজা এলভিস প্রিসলির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি হয়তো বাংলাদেশের এলভিস হতে চেয়েছিলেন, তবে তা সঙ্গীতাঙ্গনে নয় বরং তার অটোমোবাইল ডিজাইনের শিল্পে।
আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, পুরনো অকেজো গাড়িগুলোকে লিপুর চমৎকার বিলাসবহুল গাড়িতে রূপ দেওয়ার অসাধারণ প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারলেই আপনি এলভিস প্রিসলির সঙ্গে তার সংযোগটি বুঝতে পারবেন। পপ, কান্ট্রি, রিদম, ব্লুজ, গসপেলসহ একাধিক মিউজিক জনরায় জনপ্রিয় ছিলেন সঙ্গীতের উস্তাদ এলভিস। অন্যদিকে, গাড়ি রূপান্তরের ক্ষেত্রে লিপুর দক্ষতাও অনেকটা এরকমই বিশাল এবং বিস্তৃত; মূলত এই দক্ষতাই তাকে এই সেক্টরে একজন গুণী বানিয়েছে। আশ্চর্যজনক শোনালেও এটি বাস্তব; তিনি একটি টয়োটা স্প্রিন্টারকে ফেরারিতে, একটি সেডানকে লিমুজিনে এবং একটি ভক্সওয়াগেনকে ল্যাম্বরগিনিতে পরিণত করতে পারেন।
অল্প বয়সেই গাড়ির প্রতি নিজের ভালোবাসা বুঝতে পেরেছিলেন লিপু এবং সেই ভালোবাসার টানেই গত ৪০ বছর ধরে তিনি শত শত গাড়ি রূপান্তর, ডিজাইন এবং কাস্টমাইজ করেছেন। লিপু মূলত পুরোনো চার-সিটারকে নতুন রূপ দিয়ে থাকেন।
তবে অবশেষে ২০১২ সালে, তিনি তার নিজের চার আসন বিশিষ্ট 'সুরুজ' তৈরি করেন। "যেদিন আমি এটি তৈরির কাজ শেষ করেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল যেন একটি পাথর আমার বুকের ওপর থেকে নেমে গেল, (মনে হয়েছিল) যেন আমার মাথার ভেরতে চলতে থাকা ঝড় শান্ত হয়ে গেল; খুবই হালকা লাগছিল নিজেকে।"
"তবে আমি এখন আর গাড়ির জন্য পাগল নই। আমি যা চেয়েছিলাম তা অর্জন করেছি," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে গর্বিত কণ্ঠে এ কথা জানালেন লিপু।
তার কথা হয়তো পুরোপুরি ঠিক। অটোমোবাইলের প্রতি অসীম আগ্রহ এবং কাজের কারণে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এএফপি এবং বিবিসিতে তাকে নিয়ে ফিচার হওয়া, ডিসকভারি চ্যানেলের একটি শো-তে অংশগ্রহণ, হিস্ট্রি চ্যানেলে পিটবুলের সঙ্গে আরেকটি রিয়েলিটি শোর কো-হোস্ট হওয়া এবং অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ই-১১ ভিসা (অভিবাসন নিয়ম অনুযায়ী, যারা নিজেদের কাজে 'সেরাদের সেরা' বলে প্রমাণিত হন তাদেরকে গ্রিন কার্ড দেওয়া হয়) অর্জন করা– এগুলো যদি একজন অভিজ্ঞ গাড়িপ্রেমী এবং বিশেষজ্ঞের জন্য আজীবন কৃতিত্ব না হয়, তাহলে আর কী হতে পারে?
মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম গাড়ি
১৯৬৮ সালে ঢাকার একটি সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লিপু। তার বাবা বাংলাদেশে এবং এরপর সৌদি আরবে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা ছিলেন। জিগাতলা ও ধানমণ্ডি এলাকায় বড় হয়েছেন লিপু; পড়াশোনা করেছেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে।
"ম্যাট্রিক ফাইনাল পরীক্ষায় আমি গণিতে ফেল করেছিলাম। আমি কখনই এই বিষয়ে ভালো ছিলাম না, এরপরেও আমার বন্ধুদের কাছ থেকে নকল করতে চাইনি। আমার বাবা তার শিক্ষাজীবনে কখনও দ্বিতীয় হননি, তিনি আমার ফলাফলে হতাশ হয়েছিলেন।"
"এমন নয় যে তিনি আমার জন্য চেষ্টা করেননি। বাবা আমার প্রাইভেট টিউশনের জন্য সেরা গণিত শিক্ষক ঠিক করে দিয়েছিলেন; এবং সেই ১৯৮০ এর দশকে শিক্ষককে ৬ হাজার টাকা বেতন দিতে হতো। কিন্তু আমি কখনই মনোযোগী ছিলাম না," স্মরণ করেন লিপু।
১৯৮৬ সালে পরিবারের সঙ্গে সৌদি আরবে পাড়ি জমান লিপু; তাকে জেদ্দার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি করা হয়। যেখানে তিনি মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সাতটি লেটার নম্বর নিয়ে পাস করেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে গাড়ির ওপর পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন লিপু।
রিয়াদে সর্বপ্রথম সৌদি রাজকুমারের বিলাসবহুল গাড়ি দেখেছিলেন তিনি। অমন চকচকে ব্র্যান্ডেড সারি সারি গাড়ি আগে কখনো তিনি দেখেননি। ইতালীয় স্পোর্টস কার- ল্যাম্বরগিনি, ফেরারি এবং লিমুজিন ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়।
"ওই গাড়িগুলোর রঙ কাস্টমাইজ করা হয়েছিল; ধনী রাজপুত্ররা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে কপিরাইট কিনে নিয়েছিল। সেখানেই প্রথম আমি একটি লাল ল্যাম্বরগিনি কাউন্টাচ দেখেছিলাম; আমার জন্য সেটি ছিল এক আনন্দ-বিস্ময়ের স্মৃতি," উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জানালেন লিপু।
পরে লিপু সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য কলেজে ভর্তি হলে তার বাবা তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেন এবং সেইসঙ্গে এনে দেন একটি জাপানি মাজদা।
"আমি সেই কাউন্টাচটি কিনতে চেয়েছিলাম; কিন্তু বাবা বলেছিলেন, গাড়ি তো দূরের কথা তিনি ওই গাড়ির টায়ারও কিনতে পারবেন না। তবে এতে আমি মন খারাপ করিনি, কারণ আমার ক্লাসে আমিই একমাত্র ১৬ বছর বয়সী ছিলাম, যার নিজস্ব গাড়ি ছিল," যোগ করেন লিপু।
লিপুর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পড়াশোনা করুক। কিন্তু লিপুর ইচ্ছা ছিল না এতে; তিনি নিজের জন্য সেই কাউন্টাচ বানাতে চেয়েছিলেন এবং তিনি জানতেন, যুক্তরাষ্ট্রে গেলে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন না তিনি। আউলিয়া পরিবার বাংলাদেশে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই লিপু তাদের জিগাতলার বাড়ির গ্যারেজের দখল নিয়ে নেন; নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেন।
গাড়ির বিষয়ে কোনো উচ্চশিক্ষা বা একাডেমিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই, লিপু গাড়ির অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজি বুঝতেন।
"পরের তিন বছর, আমি ছয় থেকে সাতটি গাড়ি কিনেছিলাম- পুরানো হোন্ডা, টয়োটা, এমনকি ভক্সওয়াগেন- সেগুলো ভেঙে ভেতরে কী আছে এবং কীভাবে আছে, তা জেনেছি এবং বুঝেছি। আমি শহরের চারপাশে ঘুরে বেড়াতাম এবং মোটর ওয়ার্কশপ খুঁজে খুঁজে দেখতাম তারা কীভাবে, কী ধরনের কাজ করে, কী ধরনের সরঞ্জাম তারা ব্যবহার করে এবং সেগুলো তারা কোথা থেকে আনে। আমি মোটরকার ম্যাগাজিন, বই অর্ডার করেছিলাম এবং সেখান থেকে গাড়ি সম্পর্কে সবকিছু পড়েছি," বলেন তিনি।
যদিও লিপুর বাবা ছেলের আগ্রহে উৎসাহী ছিলেন না, তারপরেও তিনি আর্থিকভাবে লিপুকে সমর্থন দিয়েছিলেন। "আমার নিজের একটি গ্যারেজ ছিল এবং আমার বাবা আমাকে মাত্র ১৭ বছর বয়সে গাড়ি নিয়ে খেলা করার মতো বিলাসিতার সুযোগ দিয়েছিলেন," বলেন লিপু।
১৯৮৯ সালে তিনি একটি পুরানো হোন্ডার চেসিস ব্যবহার করে তার স্বপ্নের গাড়ি ল্যাম্বরগিনি কাউন্টচের একটি কপি তৈরি করে ফেলেন। লিপু গাড়িটির নাম দিয়েছেন লিমোবিল (লিপু মোবিল)
এরপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত লিপু ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এ সময়ে তার বাবা তাকে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য জেনারেল মোটর এডুকেশন প্রোগ্রামে ভর্তি করে দেন, কিন্তু লিপু এই পড়াশোনায় আগ্রহী ছিলেন না। এর পরিবর্তে তিনি লস এঞ্জেলেসের একটি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন, সেখানে তিনি গাড়ি পরিচালনার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
পরে তিনি লস এঞ্জেলসে নিজের ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে অটোমোবাইল মেরামত ও কাস্টমাইজের কাজ শুরু করেন।
লিপু জানান, "এই সময়ের মধ্যে, আমার বাবা আমাকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে যান। আমি একা হয়ে গিয়েছিলাম; আমি আমার নিজের ডিজাইনের গাড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলাম, আমি আমার স্বপ্নপূরণের কাজকে ভীষণভাবে মিস করতে লাগলাম।"
"১৯৯৮ সালে পকেটে মাত্র ২ হাজার ডলার নিয়ে আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। এত বছর আমি যা করছিলাম তাতে আমার পরিবার মোটেই খুশি ছিল না," বলেন লিপু।
দেশে ফিরে একই বছর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার নানা বাড়িতে যান এবং সেখানে গিয়ে তার নানার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেন।
লিপুর নিজের হাতে তৈরি 'লিপুসিন'
লিপু বলেন, "আমি সবসময় স্বপ্ন দেখতাম আমার বিয়েতে আমি একটি লিমুজিনে থাকবো। এর পরিবর্তে, আমি ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় আমার নানার পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে নৌকায় ছিলাম। তখন কিছুই করার মতো টাকা ছিল না আমার।"
একই বছর লিপু ঢাকায় ফিরে আসেন, পুরানো গ্যারেজটি আবারও দখলে নেন এবং নিজের গাড়ি মেরামতের ব্যবসা শুরু করেন। বিশেষভাবে রূপান্তরিত ওই গ্যারেজে লিপু চারজন মেকানিকের সঙ্গে কাজ করতে লাগলেন, জাপানি গাড়িগুলো খুলে ইতালিয়ান স্পোর্টস কারের আকারে কাটা মেটাল দিয়ে গাড়ির বাইরের কাঠামো প্রতিস্থাপন করেছিলেন তিনি।
রিকশা তৈরিতে যে শিট মেটাল ব্যবহার করা হয়, সেটিই তারা কাজে লাগিয়েছিলেন।
"আমি একটি জিনিসই শিখেছি; আর তা হলো, অটোমোবাইল নিয়ে কাজ করা। আমি গাড়ি মেরামত করেছি, সেগুলো কাস্টমাইজ করেছি এবং এদিকে আমার স্ত্রী পরিবারের দেখাশোনা করেছে," বলেন লিপু।
এর কয়েক বছরের মধ্যেই লিপু তার স্বপ্নের আরেকটি গাড়ির কপি তৈরি করে ফেললেন; এবারের কপিটি ছিল ল্যাম্বরগিনি ডায়াবলোর।
"আমার তৈরি ভার্সনটিকে 'লিপু' বলা হয়," যোগ করেন তিনি।
২০০২ সালে লিপু ২.৮-লিটার ডিজেল ইঞ্জিনের বেশ কয়েকটি গাড়ি একসঙ্গে ঢালাই করে একটি ২২ ফুট লম্বা লিমুজিন তৈরি করেন।
"আমি বিয়ে করার সময় লিমুজিন নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি; এর পরিবর্তে, আমি আমার নিজের লিপুসিন বানিয়ে স্ত্রী ও বাচ্চাদের নিয়ে রাজধানীর শেরাটন হোটেলে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমার গাড়ির দিকে সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল," স্মরণ করেন লিপু।
লিমুজিন তৈরি করতে সময় লেগেছিল ৪০ দিন। এই গাড়িটিতে রয়েছে একটি ড্রিংকস ক্যাবিনেট, অনবোর্ড টিভি, ইন্টারকম এবং স্টেরিও। লিপুর অনুমান গাড়িটির বিক্রয়মূল্য কম করে হলেও ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি হবে।
উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি বলেন, "ঢাকার বেশির ভাগ মানুষই এত বড় গাড়ি আগে কখনও দেখেনি।"
২০০৭ সালে বাংলা ব্যাঙ্গার্স থেকে ২০১৫ সালে পিটবুলের সঙ্গে শো
২০০২ সালে লিপুকে নিয়ে এএফপি এবং ২০০৩ সালে বিবিসি ফিচার করে। এরপরে ডিসকভারি চ্যানেলের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন লিপু। ২০০৬ সালে ডিসকভারি চ্যানেল লিপু এবং বার্নি ফাইনম্যানকে নিয়ে ঢাকায় কাস্টমাইজড গাড়ি তৈরির ওপর 'বাংলা ব্যাঙ্গার্স' নামে একটি রিয়েলিটি শো সম্প্রচার করে। ডিসকভারির ওই অনুষ্ঠানের জন্য ৮ সপ্তাহে দুটি গাড়ি তৈরির কথা ছিল লিপুর, তবে বার্নি ফাইনম্যানের সঙ্গে কাজ করে সাত সপ্তাহেই তিনি এই কাজ সম্পন্ন করেছিলেন।
২০০৬ সালের এপ্রিলে ঢাকায় তিন দিনের মোটর শোতে তার তৈরি প্রথম গাড়ি উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। প্রদর্শিত গাড়িটি ২২ বছর পুরনো টয়োটা স্প্রিন্টার চেসিস ব্যবহার করে মাত্র চার সপ্তাহে তৈরি করেছিলেন লিপু। তার তৈরি স্পোর্টস মডেলগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।
একই বছর ৭ মে লিপুর দ্বিতীয় গাড়ি উন্মোচিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জুনে, পূর্ব লন্ডনের রিচ মিক্স সেন্টার একটি গাড়ির প্রজেক্টে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায় তাকে; ওই প্রজেক্টে দুই মাস কাজ করেছিলেন তিনি। সে বছর, লিপুকে লন্ডনে 'আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স' হিসেবে আমন্ত্রণ জানা হয়। কোম্পানির উদ্বোধনী এক্সিবিশন প্রজেক্টে প্রদর্শিত হয়েছিল তার কাজ।
২০০৭ সালে, লিপু 'দ্য অ্যাঞ্জেল কার' নামে একটি গাড়ি তৈরি করেন। লন্ডনের ব্রিক লেনে বৈশাখী মেলায় গাড়িটি প্রদর্শিত হয়।
লিপু এবং বার্নি ফাইনম্যান বাংলা ব্যাঙ্গার্সের সিক্যুয়েল 'দ্য চপ শপ লন্ডন গ্যারেজ' এও অংশ নিয়েছিলেন। এই রিয়েলিটি শো'র প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী কম খরচে কাস্টমাইজড গাড়ি তৈরি করা।
এরপর ২০১৫ সালে হিস্ট্রি চ্যানেলে হাজির হন তিনি; সেখানে স্টিভ পিটবুলের ট্রিম্বল গ্যারেজে 'লিপু অ্যান্ড পিটবুল' নামে একটি রিয়েলিটি শো হোস্ট তিনি করেছিল। শোতে তারা দেখিয়েছেন কীভাবে একটি পুরনো, পরিত্যক্ত গাড়িকে সুপারকারে রূপান্তর করা যায়।
শো চলাকালীন সময়ে লিপু এবং তার পরিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়।
'যেদিন সুরুজ বানিয়েছি, গাড়ির উন্মাদনা যেন আমার ভেতর থেকে একরকম চলেই গেছে'
২০১১ সালে দেশে ফেরার পর, লিপু 'সুরুজ' নামে একটি গাড়ি তৈরি করেন। গাড়ির নামটি তিনি রেখেছেন তার নানার নামে।
"আমার নানা আমার অনুপ্রেরণা ছিলেন। যখনই আমি সমস্যায় পড়তাম, যখনই আমার পরিবার আমার ওপর থেকে আশা হারিয়ে ফেলত, নানা এসে আমাকে সমর্থন করতেন। আমি তাকে গাড়িটি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলাম," ব্যাখ্যা করেন লিপু।
সুরুজের জন্য তিনি সবুজ রং বেছে নিয়েছেন। এই গাড়িটি গ্যাস, তেল এমনকি বিদ্যুতেও চলে। অথচ এর দাম মাত্র ৪ লাখ টাকা।
"আমি প্রত্যেকের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি তৈরি করতে এবং তরুণ উত্সাহীদের জন্য ওয়ার্কশপ বা কর্মশালার ব্যবস্থা করতে চাই; অনেকেই আমাকে নিয়মিত ফোন করে বলে, তারা আমার কাছ থেকে শিখতে চায়," যোগ করেন লিপু।
ক্যালিফোর্নিয়ায় এখন গাড়ির একটি ওয়ার্কশপ আছে লিপুর। সেখানে নিজের কফিতে চুমুক দিতে দিতে জীবন সম্পর্কে ভাবেন তিনি। কাজ শেষে সাধারণত রাত দুইটায় বাড়ি ফেরেন লিপু, তার স্ত্রী তখনও তার অপেক্ষায় জেগে থাকে।